কি করতে হবে
৪. অর্থনীতিবাদীদের সেকেলেপনা ও বিপ্লবীদের সংগঠন
গ. শ্রমিকদের সংগঠন ও বিপ্লবীদের সংগঠন
কোনো কোনো সোশ্যাল — ডেমোক্রাটের কাছে রাজনীতিক সংগ্রাম সংক্রান্ত ধারণাটা মালিকদের আর সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রাম সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে এক হলে স্বভাবতই মনে করা যেতে পারে, তাঁর কাছে বিপ্লবীদের সংগঠন এবং শ্রমিকদের সংগঠন কম বেশি একই। বাস্তবে তাইই ঘটে, যাতে আমরা যখন সংগঠনের কথা বলি, আমরা বলি একেবারেই আলাদা আলাদা ভাষায়। যেমন মোটামুটি সংগতিপূর্ণ একজন অর্থনীতিবাদীর সঙ্গে একবার আলাপের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না [৮৫]। ‘রাজনীতিক বিপ্লব ঘটাবে কারা’? — এই পুস্তিকাখানা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল; সংগঠন সংক্রান্ত প্রশ্নটাকে তুচ্ছ করাই পুস্তিকাখানার প্রধান ত্রুটি, এ বিষয়ে আমরা শিগগিরই একমত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমরা সম্পূর্ণতই একমত ….. কিন্তু আলোচনা এগোতে থাকলে স্পষ্ট হয়ে গেল আমরা বলছিলাম পৃথক পৃথক জিনিসের কথা। ধর্মঘট তহবিল, পারস্পরিক সাহায্য সমিতি ইত্যাদি উপেক্ষিত হয়েছে বলে আমার আলাপসঙ্গী লেখকের বিরুদ্ধে নালিশ তুললেন আর রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটাবার একটা অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিপ্লবীদের সংগঠনের কথাটা ছিলো আমার মনে। মতভেদটা যেই মাত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো তারপর মূলনীতি সংক্রান্ত একটা প্রশ্নেও ‘অর্থনীতিবাদীটির’ সঙ্গে একমত হয়েছিলাম বলে আমার মনে পড়ে না!
আমাদের মতানৈক্যের উৎস ছিলো কোথায়? সেটা হলো এই যে, সংগঠন আর রাজনীতি উভয় প্রশ্নে অর্থনীতিবাদীরা বরাবর সোশ্যাল — ডেমোক্রাসি থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে পড়ছে ট্রেড ইউনিয়নবাদে। মালিকদের আর সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অর্থনীতিক সংগ্রামের চেয়ে সোশ্যাল — ডেমোক্রাসির রাজনীতিক সংগ্রাম ঢের বেশি বিস্তৃত এবং জটিল। তেমনি (বাস্তবিকপক্ষে, সেই কারণে) বৈপ্লবিক সোশ্যাল — ডেমোক্রাটিক পার্টির সংগঠন হতেই হবে এই (অর্থনৈতিক) সংগ্রামের জন্য গঠিত শ্রমিকদের সংগঠন থেকে ভিন্ন রকমের। শ্রমিকদের সংগঠন হওয়া চাই, প্রথমত, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন; দ্বিতীয়ত, সেটা হওয়া চাই যথাসম্ভব বিস্তৃত; আর তৃতীয়ত, সেটার হওয়া চাই অবস্থা অনুসারে যথাসম্ভব প্রকাশ্য (এখানে এবং পরে আমি অবশ্য বলেছি কেবল স্বৈরতান্ত্রিক রাশিয়া প্রসঙ্গে) অন্যদিকে প্রথমত আর সর্বোপরি তাদেরই নিয়ে হওয়া চাই বিপ্লবীদের সংগঠন যারা বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপকে নেয় পেশা হিসাবে (সেই কারণে আমি বলছি, বিপ্লবীদের সংগঠনের কথা — বিপ্লবী বলতে বুঝাতে চাইছি বিপ্লবী সোশ্যাল — ডেমোক্রাট)। এই রকমের সংগঠনের সদস্যদের এই সাধারণ বিশেষক থাকায় বৃত্তিগত আর পেশাগত তো বটেই শ্রমিক আর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যা থাকে সেই সমস্ত পার্থক্য উভয় বর্গ থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া চাই। বাধ্য হয়েই এই রকমের সংগঠন খুব বিস্তৃত হবে না, আর হবে যথাসম্ভব গুপ্ত। এই ত্রিবিধ পার্থক্য নিয়ে বিচার বিবেচনা করা যাক।
রাজনীতিক স্বাধীনতা আছে যে সব দেশে সেগুলিতে ট্রেড ইউনিয়ন আর রাজনীতিক সংগঠনের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট, যেমন স্পষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন আর সোশ্যাল ডেমোক্রাসির মধ্যেকার পার্থক্য। পরে উল্লেখিত আর আগে উল্লেখিতের মধ্যেকার পার্থক্য প্রত্যেকটা দেশেই স্বভাবতই পৃথক হবে ঐতিহাসিক, আইনগত ও অন্যান্য অবস্থা অনুসারে; এ সম্পর্ক হতে পারে কমবেশি ঘনিষ্ঠ, জটিল ইত্যাদি (আমাদের মতে, সেগুলো হওয়া উচিত যথাসম্ভব ঘনিষ্ঠ এবং যথাসম্ভব কম জটিল); কিন্তু মুক্ত দেশগুলিতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের সোশ্যাল — ডেমোক্রাটিক পার্টি সংগঠনের সঙ্গে এক হয়ে যাবার কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। তবে রাশিয়ায় আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় স্বৈরতন্ত্রের জোয়াল সোশ্যাল — ডেমোক্রাটিক সংগঠন এবং শ্রমিক সমিতিগুলির মধ্যেকার সমস্ত পার্থক্য বিলুপ্ত করে দেয়- কেননা সমস্ত শ্রমিক সমিতি এবং সমস্ত পাঠচক্র নিষিদ্ধ, শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের প্রধান অভিব্যক্তি আর অস্ত্র — ধর্মঘট — একটা ফৌজদারী (এবং কখনও কখনও এমনকি রাজনীতিক!) অপরাধ বলে গণ্য হয়। কাজেই আমাদের দেশের অবস্থা অর্থনৈতিক সংগ্রামে ব্যাপৃত শ্রমিকদের রাজনীতিক প্রশ্নাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে প্রবৃত্ত করে একদিকে, আর অন্যদিকে সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের প্রবৃত্ত করে সোশ্যাল ডেমোক্রাসির সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নবাদকে তালগোল পাকিয়ে দিতে (আর আমাদের ক্রিচেভস্কিয়া মার্তিনভরা অ্যান্ড কোং প্রথম ধরনের প্রবৃত্তি নিয়ে অধ্যবসায়ী আলোচনা করে, কিন্তু দ্বিতীয়টি লক্ষ্য করতে অপারগ)। মালিকদের আর সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনীতিক সংগ্রামে যারা পনর আনাই ডুবে রয়েছেন তাঁদের কথাটা ভাবুন তো একবার। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের সক্রিয়তার সমগ্র কালপর্যায়ে (চার থেকে ছয় মাস) বিপ্লবীদের অপেক্ষাকৃত জটিল সংগঠনের প্রয়োজন সম্বন্ধে ভাবার প্রবৃত্তি বোধ করবেন না কখনও। অন্যান্যেরা হয়তো হাতে পাবেন বেশ ব্যাপকভাবেই পরিবেশিত বের্নস্টাইনবাদী সাহিত্য, তার থেকে তারা নীরস দৈনন্দিন সংগ্রামে অগ্রগতির প্রগাঢ় গুরুত্ব সম্বন্ধে দৃঢ়প্রত্যায়ী হয়ে উঠবেন। আরও কেউ কেউ হয়তো প্রলেতারীয় সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং অঙ্গাঙ্গিসম্পর্কের — ট্রেড ইউনিয়ন আর সোশ্যাল — ডেমোক্রাটিক আন্দোলনের মধ্যে সম্পর্কের- নতুন দৃষ্টান্ত দুনিয়াটাকে দেখিয়ে দেবার মনোমোহিনীভাবে মশগুল হয়ে যাবেন। এমন সব ব্যক্তি যুক্তি দেখাতে পারেন যে, কোনো দেশ পুঁজিতন্ত্রের ক্ষেত্রে, আর তার ফলে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের ক্ষেত্রে যত দেরিতে ঢোকে, সে দেশের সমাজতন্ত্রীরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে এবং সে আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারে ততই বেশি, আর অসোশ্যাল — ডেমোক্রাটিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকার কারণ ততই কম এবং অবশ্যয় তাই ঘটবে। এই অবধি যুক্তিটা পুরোপুরি সঠিক, কিন্তু দুঃখের কথা কেউ কেউ আরও ছড়িয়ে গিয়ে ট্রেড ইউনিয়নবাদের সঙ্গে সোশ্যাল — ডেমোক্রাসি মিলে মিশে একেবারে এক হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আমাদের সংগঠন সংক্রান্ত পরিকল্পনার ওপর এমন সব স্বপ্নের হানিকর ক্রিয়া কতখানি সেটা আমরা ঠিকই দেখতে পাবো সেন্ট পিটার্সবুর্গ মুক্তি সংগ্রাম লীগ এর নিয়মাবলির দৃষ্টান্ত থেকে।
অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য শ্রমিকদের সংগঠন হওয়া চাই ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। এইসব সংগঠনের যথাসম্ভব সহায়তা করা এবং এইসব সংগঠনে সক্রিয়ভাবে যথাসম্ভব কাজ করা উচিত প্রত্যেকটি সোশ্যাল — ডেমোক্রাটিক শ্রমিকের। তা ঠিক, কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে সদস্য হওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হবে কেবল সোশ্যাল — ডেমোক্রাটরাই এমনটা দাবি করা আমাদের স্বার্থের অনুযায়ী নয়; কেননা এর ফলে জনগণের মধ্যে আমাদের প্রভাবের পরিধি সঙ্কুচিতই হয়ে যাবে শুধু। মালিক আর সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আবশ্যকতা যে বোঝে এমন প্রত্যেকটি শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দিক। যারা উপলব্ধির অন্তত এই প্রাথমিক মাত্রায় পৌঁছেছে তাদের সবাই ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে সম্মিলিত না হলে, ট্রেড ইউনিয়নগুলি খুবই বিস্তৃত সংগঠন না হলে, ট্রেড ইউনিয়নগুলির লক্ষ্যই হাসিল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সব সংগঠন যত বিস্তৃত হবে ততই ব্যাপক হবে সেগুলির ওপর আমাদের প্রভাব — অর্থনৈতিক সংগ্রামের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের কারণেই শুধু নয়, এই প্রভাবের আরও কারণ হলো সহকর্মীদের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য বৃত্তিগত ট্রেড ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রী সদস্যদের প্রত্যক্ষ এবং সচেতন প্রচেষ্টা। তবে কোনো বিস্তৃত সংগঠন কঠোর গোপনীয়তার পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারে না (কেননা, অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য যা তার চেয়ে ঢের বেশি তালিম আবশ্যক সেজন্যে)। বিরাট সদস্য সংখ্যা আর কঠোর গোপন পদ্ধতি- এই দুটো আবশ্যকতার মধ্যেকার অসংগতিকে খাপ খাওয়ান যায় কেমন করে? ট্রেড ইউনিয়নগুলি আমরা যথাসম্ভব প্রকাশ্য করবো কীভাবে? সাধারণভাবে বলতে গেলে তার উপায় আছে দুটো মাত্র: হয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি বৈধকরণ (কোন কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক আর রাজনীতিক সমিতিগুলির বৈধকরণের আগে সেটা ঘটেছিল), নইলে সংগঠন থাকুক গুপ্ত, কিন্তু এতই মুক্ত অনিয়তাকার, জার্মানিরা যাকে বলে Loose (ঢিলেঢালা) যাতে, সদস্যদের বেশির ভাগের দিক থেকে দেখলে, গোপন পদ্ধতির প্রয়োজন হয়ে যায় নগণ্য ।
রাশিয়ার অসমাজতান্ত্রিক এবং অরাজনীতিক ইউনিয়নগুলির বৈধকরণ শুরু হয়েছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, শ্রমিক শ্রেণির দ্রুত বেড়ে চলা সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক আন্দোলনের প্রত্যেকটা অগ্রগতির ফলে বৈধ প্রচেষ্টার সংখ্যা বাড়বে, সে প্রচেষ্টায় উৎসাহ সৃষ্টি হবে- এইসব প্রচেষ্টার বেশির ভাগ আসছে বিদ্যমান ব্যবস্থার সমর্থকদের মধ্যে থেকে, কিন্তু অংশত শ্রমিকদের নিজেদেরই এবং উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে থেকেও। ভাসিলিয়েভরা এবং জুবাতভরা[৮৬] ইতিমধ্যে বৈধতার ঝান্ডা উড়িয়েছে, ওজেরভরা আর ওয়ার্মস সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সমর্থন দিয়েছে, নতুন ধারার সমর্থকদের এখন দেখা যায় শ্রমিকদের মধ্যে। এখন থেকে এই ধারাটাকে আমরা হিসাবে না ধরে পারি না। সেটাকে হিসাবে ধরতে হবে কীভাবে, সে সম্পর্কে সোশ্যাল — ডেমোক্রাটদের মধ্যে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। এই আন্দোলনের জুবাতভরা আর ভাসিলিয়েভরা, রাজনীতিক পুলিশ আর যাজকেরা যে কোনো ভূমিকায় নামলে সেটাকে আমাদের অটল থেকে উত্থাপিত করতে হবে এবং শ্রমিকদের কাছে বুঝিয়ে বলতে হবে তাদের আসল মতলবের কথা। শ্রমিকদের বৈধ সভাগুলিতে উদারপন্থী রাজনীতিকদের বক্তৃতায় যেসব মিলজুল আর সমন্বয়ের সুর শোনা যাবে সেগুলোকেও আমাদের উদঘাটন করে দিতে হবে, সেগুলো শান্তিপূর্ণ শ্রেণিগত সহযোগের বাঞ্ছনীয়তা সম্বন্ধে আন্তরিক প্রত্যয়প্রসূতই হোক, আর হীন তোষামোদ করে কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহ লাভের বাসনাপ্রসূত হোক, কিংবা হোক শুধু সেকেলেপনার ফল, সেসব নির্বিশেষে। শেষে পুলিশ প্রায়ই যে সব ফাঁদ পাতে সেগুলো সম্বন্ধে আমাদের শ্রমিকদের হুঁশিয়ার করে দিতে হবে, এইসব প্রকাশ্য সভা আর অনুমত সমিতিতে পুলিশ গনগনে লোকদের খুঁজে বের করে এবং বেআইনি সংগঠনে প্ররোচনাদাতা চর মোতায়েন করার জন্য বৈধ সংগঠনগুলিকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে।
এই সব কিছু করার অর্থ আদৌ এমনটা নয় যে, এ কথা ভুলে যেতে হবে যে, শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন বৈধকরণের ফলে শেষ পর্যন্ত লাভবান হবো আমরা — জুবাতভরা নয়। তার উলটো গম থেকে আগাছা নিড়বার জন্যে আমাদের সহায়ক হবে আমাদের উদ্ঘাটন অভিযানই। আগাছা কী সেটা আমরা আগেই নির্দেশ করেছি। গম বলতে আমরা বুঝাতে চাইছি সবচেয়ে অনগ্রসর অংশগুলি সমেত ক্রমাগত বেশিসংখ্যক শ্রমিকের মনোযোগ বিভিন্ন সামাজিক আর রাজনীতিক প্রশ্নে আকৃষ্ট করা, এবং মূলত বৈধ যেসব কাজের (আইনসঙ্গত বই পরিবেশন, পারস্পরিক সহায়তা ইত্যাদি) বিকাশের ফলে আমরা আলোড়নের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পরিমাণে মাল মশলা পাব তা অবশ্যম্ভাবী, সেগুলো থেকে আমাদের বিপ্লবীদের মুক্ত করা। এদিক থেকে দেখলে, জুবাতভদের আর ওজেরভদের আমরা একথা বলতে পারি এবং তা আমাদের বলতে হবে; লেগে থাকুন ভদ্রমহোদয়গণ, যথাসাধ্য করুন! যখনই আপনারা শ্রমিকদের পথে কোনো ফাঁদ পাতবেন (সরাসরি প্ররোচনা হিসাবেই হোক, আর স্ত্রুভেবাদের [৮৭] সাহায্যে শ্রমিকদের সততা সহকারে নীতিভ্রষ্ট করেই হোক), তাহলে আপনাদের স্বরূপ যাতে উদ্ঘাটিত হয় তার ব্যবস্থা আমরা করবো। কিন্তু যখনই আপনারা কোনো সত্যিকারের অগ্রপদক্ষেপ করবেন, সেটা অতি দ্বিধাগ্রস্ত আঁকাবাঁকা হলেও আমরা বলবো চালিয়ে যান! আর একমাত্র পদক্ষেপ যা সত্যিকারের অগ্রপদক্ষেপ হতে পারে সেটা হলো শ্রমিকদের কর্মকান্ডক্ষেত্রের সত্যিকারের প্রসার, সেটা ক্ষুদ্র হলেও। এমন প্রত্যেকটা প্রসারের ফলে আমাদের সুবিধে হবে, আর আমরা সেই রকমের বৈধ সমিতির উদ্ভব ত্বরিত করতে সাহায্য করবো যেখানে প্ররোচনাদাতা চরেরা সমাজতন্ত্রীদের খুঁজে বের করে না, সেখানে সমাজতন্ত্রীরা পায় নতুন নতুন অনুগামী। এককথায়, আগাছা দূর করতে প্রচেষ্টা চালানই এখন আমাদের গমের জন্যে জমি সাফ করি। আফানাসি ইভানভিচরা আর পুলখেরিয়া ইভানভনারা [৮৮] যতদিন ফুলের টবের ফসলের যত্ন করছেন ততদিন আমাদের প্রস্তুত রাখতে হবে কাটিয়েদের— আজকের আগাছা কেটে ফেলার জন্যই শুধু নয় আগামী দিনের গম কাটার জন্যও*।
এইভাবে যথাসম্ভব কম গুপ্ত এবং যথাসম্ভব ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ার সমস্যাটার সমাধান বৈধকরণের উপায়ে আমরা করতে পারি নে (কিন্তু) জুবাতভরা আর ওজেরভরা এমন সমাধানের কোন আংশিক সুযোগও আমাদের কাছে খুলে ধরলে আমরা নিশ্চয়ই খুবই খুশি হবো- এই উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আয়াসসাধ্য লড়াই চালাতে হবে!) আর রইল গুপ্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন; যে সব শ্রমিক এই পথ ধরছে (তা আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি) তাদের সম্ভাব্য সমস্ত সহায়তা আমাদের দিতেই হবে। ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলি মহামূল্যবান হতে পারে অর্থনৈতিক সংগ্রামের বিকাশ আর সংহতির জন্যই শুধু নয়, রাজনীতিক আলোড়ন আর বৈপ্লবিক সংগঠনের পক্ষেও সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। এই উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে এবং সোশ্যাল — ডেমোক্রাসির বাঞ্ছিত খাতে জায়মান ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে চালিত করতে হবে, সেন্ট পিটার্সবুর্গের অর্থনীতিবাদীরা প্রায় পাঁচ বছর ধরে যে সংগঠন পরিকল্পনা পোষণ করে আসছেন সেটা কী আজগুবি তা আমাদের প্রথমে স্পষ্ট বুঝতে হবে। সেই পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসের শ্রমিকদের পারস্পরিক কল্যাণ তহবিলের নিয়মাবালীতে (১নং রাবোচায়া মিশল থেকে নিয়ে ৯-১০নং লিস্তক রাবোৎনিকায়) তাছাড়া ১৯০০ সালের অক্টোবর মাসের ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক সংগঠনের নিয়মাবলিতেও (সেন্ট পিটার্সবুর্গে ছাপানো বিশেষ ইস্তেহার, ১নং ইস্ক্রায় তার উল্লেখ ছিলো)। উভয় প্রস্থ নিয়মাবলির একটা প্রধান ত্রুটি আছে; উভয় ক্ষেত্রে বিস্তৃত শ্রমিক সংগঠনকে স্থাপন করা হয়েছে কঠোরভাবে বাঁধাধরা কাঠামোয়, আর সেই সংগঠনকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে বিপ্লবীদের সংগঠনের সঙ্গে। নিয়মাবলির যে প্রস্থটার কথা শেষে উল্লেখ করা হয়েছে সেটাকে ধরা যাক, কেননা এটাকে রচনা করা হয়েছে অধিকতর সবিস্তারে। এতে আছে বাহান্নটা অনুচ্ছেদ; তেইশটা অনুচ্ছেদ হলো শ্রমিক চক্রগুলির গঠন, কর্মপ্রণালী এবং এক্তিয়ার নিয়ে- এই চক্র সংগঠিত হবে প্রত্যেকটা কারখানায় (দশ জনের বেশি নয়), আর তাতে নির্বাচিত হবে কেন্দ্রীয় (কারখানা) গ্রুপ। ২নং অনুচ্ছেদে আছেঃ কারখানায় কিংবা কর্মশালায় যা কিছু চলবে তা লক্ষ্য করবে এবং ঘটনাবলির নথি রাখবে কেন্দ্রীয় গ্রুপে। কেন্দ্রীয় গ্রুপ চাঁদাদাতাদের কাছে মাসিক আর্থিক হিসাব পেশ করবে (১৭ নং ইত্যাদি)। এলাকা সংগঠন নিয়ে আছে ১০টা অনুচ্ছেদ, আর ঊনিশটা অনুচ্ছেদ আছে শ্রমিক সংগঠন কমিটি এবং সেন্ট পিটার্সবুগ মুক্তি সংগ্রাম লীগ এর মধ্যে খুবই জটিল পারস্পরিক সংযোগের কথা (প্রত্যেকটা এলাকায় এবং নির্বাহী গ্রুপগুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা- প্রচারকদের গ্রুপগুলি, বিভিন্ন প্রদেশ আর বিদেশে সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার গ্রুপগুলি গুদাম প্রকাশন আর তহবিল ব্যবস্থাপকের জন্য গ্রুপগুলি)। নির্ধারিত প্রতিনিধিদের মধ্যে খুবই জটিল পারস্পরিক সংযোগের কথা।
সোশ্যাল ডেমোক্রাসি = শ্রমিকদের আর্থনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী গ্রুপগুলি! অর্থনীতিবাদীদের ভাব ভাবনা কিভাবে সোশ্যাল ডেমোক্রাসি থেকে বিচ্যুত হয়ে চলে যায় ট্রেড ইউনিয়নবাদে, আর মুক্তির জন্য সমগ্র প্রলেতারীয় সংগ্রাম পরিচালিত করতে যা সক্ষম বিপ্লবীদের এমন সংগঠন নিয়েই যে কোনো সোশ্যাল — ডেমোক্রাটের ব্যাপৃত থাকা চাই প্রথমত আর সর্বোপরি, এমন কোনো ভাব ভাবনা তাদের কাছে কতখানি বিজাতীয়, সেটা এর চেয়ে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা দুষ্কর। শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতিক মুক্তি এবং জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বলার সঙ্গে সংগঠনের এমন সব নিয়মাবলীর খসড়া রচনার অর্থ হলো সোশ্যাল — ডেমোক্রাসির যথার্থ কাজ সম্পর্কে একেবারেই কোনো ধারণাই না থাকা। জনগণের মধ্যে সম্ভাব্য ব্যাপকতম রাজনীতিক আলোড়ন চালানো আবশ্যক, যে আলোড়নে বিশিষ্ট হয়ে উঠবে রুশ স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যেকটা দিক এবং রাশিয়ার বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির বিশেষত্বগুলো, এমন উপলব্ধির একটা ক্ষীণ আভাসও ফুটে ওঠেনি ওই গোটা পঞ্চাশেক অনুচ্ছেদের একটায়ও। রাজনীতিক লক্ষ্য তো দূরের কথা ট্রেড ইউনিয়ন লক্ষ্য হাসিল করার জন্যও এই রকমের নিয়মাবলী কোনো কাজের নয়। কেননা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত হয় বৃত্তি অনুসারে, তাতে তার কোনো উল্লেখ নেই।
তবে বোধ হয় সবচেয়ে বিশেষক হলো সমগ্র ব্যবস্থাটার বিস্ময়কর মাথা ভারি অবস্থা, তাতে প্রত্যেকটা পৃথক কারখানা আর তার কমিটিতে বাঁধা ছকের হাস্যকর রকম তুচ্ছ ধরনের নিয়ম এবং তিন পর্বের নির্বাচন ব্যবস্থার স্থায়ী সূত্র ধরে বেঁধে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থনীতিবাদের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে আবদ্ধ মন হারিয়ে গিয়েছে নানা খুটিনাটির মধ্যে, সেগুলোতে লাল ফিতে আর আমলাতান্ত্রিকতার বোটকা গন্ধ একেবারে সুস্পষ্ট। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য ধারাগুলোর তিন চতুর্থাংশ কখনও প্রযোজ্য নয়; আর অন্যদিকে এই রকমের গুপ্ত সংগঠন যাতে প্রত্যেকটা কারখানায় থাকে কেন্দ্রীয় গ্রুপ তাতে রাজনীতিক পুলিশদের ব্যাপক পরিসরে হামলা চালানো খুবই সহজ হয়ে পড়ে। পোল্যান্ডের কমরেডরা তাদের আন্দোলনের একটা অনুরূপ পর্ব পার হয়ে এসেছেন, তাতে প্রত্যেকটা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের বিস্তৃত সংগঠনের বিষয়ে সোৎসাহ ছিলেন, কিন্তু যখন তারা দেখেছিলেন এমন সংগঠন রাজনৈতিক পুলিশের জন্য ফলাও মৌসুমই যোগায় শুধু, তখন তাঁরা এ চিন্তা ছেড়েছিলেন চটপট। ব্যাপক গ্রেফতার নয়, শ্রমিকদের বিস্তৃত সংগঠন যদি আমরা চাই আমরা যদি গোয়েন্দা পুলিশের মনোতুষ্টির ব্যবস্থা করতে না চাই তা হলে আমাদের এমন ব্যবস্থা করতেই হবে যাতে এই সব সংগঠনের কঠোরভাবে বাঁধাধরা কোনো আনুষ্ঠানিক গড়ন না থাকে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সেগুলি কী সক্রিয় থাকতে পারবে? দেখা যাক কাজ কর্মগুলি কী; কারখানায় যা কিছু চলে তা লক্ষ্য করা এবং ঘটনাবলির নথি রাখা (নিয়মাবলির ২নং অনুচ্ছেদ) আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত গ্রুপ থাকা এই উদ্দেশ্যে সত্যিই কি আবশ্যক? বিশেষ বিশেষ গ্রুপ স্থাপন না করে বেআইনি পত্র পত্রিকাগুলিতে চিঠিপত্র লেখালেখি দিয়েই কি এই উদ্দেশ্য আরও ভালভাবে সাধিত হতে পারে না? … কর্মশালার অবস্থা উন্নীত করার জন্য শ্রমিকদের সংগ্রাম পরিচালন (নিয়মাবলির ৩নং) এর জন্যেও তো কোনো বাঁধাধরা সাংগঠনিক আকারের দরকার নেই। কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো আলোড়ক সাধারণ কথাবার্তার মধ্যে শ্রমিকদের দাবি দাওয়া জেনে নিয়ে সেগুলো কোনো ইস্তেহারে প্রকাশ করার জন্য বিপ্লবীদের কোনো — বিস্তৃত নয়— সঙ্কীর্ণ সংগঠনের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন। … একটা তহবিল গড়া… তাতে রুবল দুই কোপেক করে চাঁদা দিতে হবে (৯নং), আর তারপর চাঁদাদাতাদরে কাছে মাসিক আর্থিক হিসাব পেশ করা (১৭নং), সেসব সদস্য চাঁদা দেয় না তাদের বহিষ্কৃত করা (১০নং) ইত্যাদি। এটা তো পুলিশের একেবারে স্বর্গরাজ্য, কেননা কোনো কেন্দ্রীয় কারখানা তহবিলের এমন গোপনীয়তার ভিতরে অনুপ্রবেশ করে টাকা বাজেয়াপ্ত করে সেরা সেরা লোকদের গ্রেফতার করার চেয়ে সহজ তাদের পক্ষে আর কিছুই হতে পারে না। কোনো সুপরিচিত (খুবই সঙ্কীর্ণ, খুবই গুপ্ত) সংগঠনের মোহর ছাপানো এক কোপেক কিংবা দুকোপেকের কুপন বের করা, কিংবা কোনো রকমের কুপন ছাড়াই চাঁদা তুলে কোনো বেআইনি কাগজে সঙ্কেত বিবরণ প্রকাশ করাটা কি আরও সহজ নয়? তাতে উদ্দেশ্য সাধিত হয়, কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষে কোনো সুলুক পাওয়াটা হয় শতগুণ কঠিন।
নিয়মাবলির বিশ্লেষণ চালিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু আমি মনে করি, যা বলা হলো সেটাই যথেষ্ট। সবচেয়ে বিশ্বস্ত, অভিজ্ঞ এবং পোক্ত শ্রমিকদের একটা ছোট সুসংবদ্ধ কেন্দ্রী ভাগ, তার প্রতিনিধিরা থাকবে প্রধান এলাকাগুলিতে কঠোর গোপনতার সমস্ত নিয়ম অনুসারে সেটা যুক্ত থাকবে বিপ্লবীদের সংগঠনের সঙ্গে — জনগণের ব্যাপকতম সমর্থনে এবং কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠন ছাড়াই সেটা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের সমস্ত কাজকর্ম চালাতে পারে, তার ওপর সেটা চালাতে পারে এমনভাবে যা সোশ্যাল — ডেমোক্রাসির পক্ষে বাঞ্ছনীয়। একমাত্র আমরা এই উপায়েই সমস্ত গোয়েন্দা পুলিশ সত্ত্বেও সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সংহতি আর বিকাশ নিশ্চিত করতে পারি।
এই মর্মে আপত্তি উঠতে পারে যে, সংগঠন এতই loose যা সুনির্দিষ্টভাবে গড়াও নয়, যার কোনো তালিকাভুক্ত আর রেজিস্ট্রি করা সদস্য শ্রেণিও নেই, সেটাকে আদৌ সংগঠনই বলা যায় না। হয়তো তাই-ই, আমি নামের পিছনে ছুটছি না। কিন্তু এই সদস্যবিহীন সংগঠন যা আবশ্যক সেই সবই করবে এবং একেবারে শুরু থেকেই আমাদের ভবিষ্যৎ ট্রেড ইউনিয়নগুলি এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে নিবিড় সংযোগ নিশ্চিত করবে। স্বৈরতন্ত্রের আমলে নির্বাচন, রিপোর্ট, সর্বজনীন ভোটাধিকার ইত্যাদি নিয়ে শ্রমিকদের বিস্তৃত সংগঠন চাইতে পারে কেবল কোনো সংশোধনের অসাধ্য স্বপ্নবিলাসী।
এর থেকে পাওয়া নীতি শিক্ষাটা সহজ সরল: বিপ্লবীদের একটি শক্তিশালী সংগঠনের পোক্ত ভিত্তি দিয়ে শুরু করলে আমরা সমগ্রভাবে আন্দোলনের সুস্থিতি নিশ্চিত করতে পারি, আর সোশ্যাল — ডেমোক্রাসি এবং খাস ট্রেড ইউনিয়ন দুইয়েরই লক্ষ্য সাধন করতে পারি। কিন্তু আমরা যদি শুরু করি বিস্তৃত শ্রমিক সংগঠন দিয়ে, যাকে নাকি ধরতে হবে জনগণের সবচেয়ে বেশি নাগালের মধ্যে বলে (কিন্তু আসলে যা গোয়েন্দা পুলিশের বেশি নাগালের মধ্যে এবং বিপ্লবীদের এনে ফেলে পুলিশের সবচেয়ে বেশি নাগালের মধ্যে), তাহলে আমরা একটা কিংবা অন্যটা কোনো লক্ষ্যই হাসিল করতে পারবো না; আমাদের হাতুড়ে প্রণালী দূর হবে না, আর আমরা ইতস্তত ছড়িয়ে থাকি বলে এবং পুলিশ সর্বক্ষণ আমাদের শক্তি ভেঙে দেবার দরুন আমরা জুবাতভ আর ওজেরভ ধরনের ট্রেড ইউনিয়নগুলিকেই শুধু জনগণের আরও বেশি নাগালের মধ্যে এনে দেব।
যথাযথভাবে বলতে গেলে বিপ্লবীদের সংগঠনের কাজ কর্ম হওয়া উচিত কী? বিষয়টা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে আমাদের সন্ত্রাসবাদীর উপস্থাপিত খুবই নমুনাসই একটা যুক্তি প্রথমে বিচার বিবেচনা করা যাক- তিনি (কপাল মন্দ) এ ব্যাপারে অর্থনীতিবাদীর পাশের বাড়ির পড়শী। শ্রমিকদের জন্য প্রকাশিত সভবোদা নামে পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় সংগঠন শীর্ষক প্রবন্ধটির লেখক তাঁর ইভানভো-ভজনেসেস্কের অর্থনীতিবাদী শ্রমিক বন্ধুদের স্বপক্ষে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন:
“জনগণ যখন মূক, অচেতন, যখন আন্দোলন ওঠে না নিচ থেকে, সেটা খারাপ। যেমন ধরুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শহরের ছাত্ররা গ্রীষ্মের কিংবা অন্য কোনো ছুটিতে বাড়ি গেল, আর অমনি শ্রমিক আন্দোলন থেমে গেল। যে শ্রমিক আন্দোলনকে বাইরে থেকে ঠেলে ঠেলে দিতে হয় সেটা কি কোনো সত্যিকারের শক্তি হতে পারে? তা হয় না। …সেটা এখনও হাটতে শেখেনি, সেটা এখনও দড়ি ধরে হাটি হাটি পা পা অবস্থায়। সব ব্যাপারেই তাই। ছাত্ররা চলে গেল আর সব কিছু থেমে গেল। যারা সবচেয়ে যোগ্য তাদের ধরে ফেলা হয় — ননী তোলা দুধ টকে যায়। কমিটি গ্রেফতার হলে নতুন কমিটি গড়তে পারা অবধি সব কিছু স্তব্ধ। পরে কি রকমের কমিটি স্থাপিত হবে তা জানবার জো নেই- সেটা হতে পারে একেবারেরই আগেরটার মতো নয়। প্রথমটা বলেছিল এক কথা, দ্বিতীয়টি বলতে পারে উলটো কথা। গতকাল আর আগামীকালের মধ্যেকার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যায়, অতীতের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শকের কাজ করতে পারে না। আর এই সব কিছুরই কারণ এই যে শিকড় গাড়ে নি গভীরে- জনগণের মধ্যে; শত মূককে নিয়ে নয়, কাজ চলে ডজনখানেক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়ে। ডজনখানেক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে এক তুড়িতে সাফ করে দেওয়া যায়, কিন্তু সংগঠন যখন হয় জনগণকে জুড়ে, সবকিছু আসে জনগণের মধ্যে থেকে, তখন যত চেষ্টা করুক কেউই আদর্শকে বানচাল করতে পারে না।” (পৃষ্ঠা ৬৩)।
বাস্তব অবস্থাগুলির বর্ণনা সঠিক। আমাদের সেকেলেপনার চিত্র আঁকা হয়েছে ভালভাবেই। কিন্তু সিদ্ধান্তটা রাবচায়া মিসল-এরই পক্ষে উপযুক্ত- নির্বুদ্ধিতা আর রাজনৈতিক বোধহীনতা এই দুই দিক থেকেই। সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ, কেননা এই লেখক আন্দোলনের শিকড়ের গভীরতা সংক্রান্ত দার্শনিক আর সামাজিক ঐতিহাসিক প্রশ্নটাকে গুলিয়ে ফেলেছেন গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সেরা প্রণালী সংক্রান্ত টেকনিক্যাল আর সাংগঠনিক প্রশ্নের সঙ্গে। ওটা চূড়ান্ত রাজনৈতিক বোধহীনতা, তার কারণ খারাপ নেতাদের কাছ থেকে ভাল নেতাদের উদ্দেশ্যে আবেদন জানাবার বদলে লেখক আবেদন জানিয়েছেন সাধারণভাবে নেতাদের কাছ থেকে জনতার উদ্দেশ্যে। রাজনৈতিক আলোড়নের জায়গায় উত্তেজনাকর সন্ত্রাসবাদ স্থাপন করার ধারণা আমাদের রাজনীতিগতভাবে যতখানি পিছনে টেনে নেয়, এটা সেই পরিমাণেই আমাদের সংগঠনগতভাবে পিছনে টেনে নেবার চেষ্টা। বাস্তবিকপক্ষে, আমি পড়েছি একেবারে প্রাচুর্যের দরুন ফ্যাসাদ (embarras de richesses) এর অবস্থায়; সভবোদা যে জট পাকিয়েছে সেটাকে যে কোথা থেকে খুলতে শুরু করবো তা আমার বোঝা শক্ত। স্পষ্টতার জন্যে আমি একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে শুরু করতে চাইছি। জার্মানদের কথা ধরুন। তাদেরটা গণ-সংগঠন, হাঁটতে শিখেছে, এটা কেউ মেনে নিতে নারাজ হবেন না আশা করি। তবু লক্ষ্য করুন, এই লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ডজনখানেক পরীক্ষিত নেতাকে কত মূল্যবান মনে করেন, কী দৃঢ়ভাবে তারা আঁকড়ে আছে ঐ নেতাদের। পার্লামেন্টে বৈরভাবাপন্ন পার্টিগুলির সদস্যরা সমাজতন্ত্রীদের বিদ্রুপ করে প্রায়ই বলেছে: তোমরা খাসা গণতন্ত্রী বটে! তোমাদেরটা শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন শুধু নামেই, আসলে সর্বদাই চোখে পড়ে নেতাদের সেই একই ঘোট, সেই একই বেবেল, আর একই লিবকেখট- বছরের পর বছর আর তাই চলে আসছে দশকের পর দশক। নির্বাচিত বলে ধরে নেওয়া তোমাদের শ্রমিক প্রতিনিধিরা সম্রাটের উপযুক্ত আমলাদের চেয়ে স্থায়ী। কিন্তু নেতাদের বিরুদ্ধে জনতাকে লাগিয়ে দেবার, জনতার মধ্যে অসার দাম্ভিক আর কুপ্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলার এবং ডজনখানেক বিজ্ঞ ব্যক্তির প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে আন্দোলনের মজবুতি আর সুস্থিতি কেড়ে নেবার এইসব বাগাড়ম্বর পূর্ণ অপচেষ্টাকে জার্মানরা শুধু হেসে উড়িয়ে দেয়। রাজনীতিক চিন্তন জার্মানদের মধ্যে যথেষ্ট বিকশিত; আর পেশাগতভাবে সুশিক্ষিত, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দীক্ষিত এবং ষোল আনা মিলজুল রেখে কর্মরত এই ডজনখানেক সুপরীক্ষিত এবং প্রতিভাবান নেতা (প্রতিভাবান মানুষ জন্মায় না শতে-শতে) ছাড়া আধুনিক সমাজে কোন শ্রেণি কৃতসঙ্কল্প সংগ্রাম চালাতে পারে না সেটা বুঝবার মতো যথেষ্ট রাজনীতিক অভিজ্ঞতা তাদের সঞ্চিত হয়েছে। জার্মানদের মধ্যেও থেকেছে বক্তৃতাবাগিশেরা, তারা শত মূকের স্তবকতা করেছেন তাদের তুলে ধরেছে ডজনখানেক বিজ্ঞ জনের ঊর্ধ্বে, গুণগান করেছে জনগণের কড়া পড়া হাতের, আর (মস্ট আর হাসেলমানের মতো) তাদের তাড়িত করেছে বেপরোয়া বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে এবং দৃঢ় আর অবিচলিত নেতাদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসের বীজ ছড়িয়েছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিতরকার সমস্ত বক্তৃতাবাগীশদের বিরুদ্ধে দৃঢ় আর ক্ষমাহীন লড়াই চালিয়েই সমাজতন্ত্র বাড়তে পেরেছে, আর যেমনটা তেমনি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অথচ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে-ওঠা জনগণকে পরিচালিত করাবার জন্য যথেষ্ট তালিম পাওয়া পরিপক্ক এবং অভিজ্ঞ নেতার অভাব আছে, সম্পূর্ণত এই কারণেই রাশিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্রাসি যখন চলেছে সঙ্কটের ভিতর দিয়ে তখন আমাদের পন্ডিতম্মন্না মূর্খরা নির্বোধের প্রগাঢ়তাসহকারে তারস্বরে বলছেঃ ‘আন্দোলনটা যখন নিচে থেকে ওঠে না সেটা খারাপ ব্যাপার’!
‘ছাত্রদের নিয়ে গড়া কমিটি কোনো কাজের নয়, ওটা সুস্থিত নয়।’ খুব ঠিক কথা। কিন্তু এর থেকে যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেটা এই যে, আমাদের চাই পেশাদার বিপ্লবীদের কমিটি, আর পেশাদার বিপ্লবী হতে সক্ষম কোনো শ্রমিক কিংবা ছাত্র তাতে কিছু এসে যায় না। আপনারা কিন্তু সিদ্ধান্ত করছেন এই যে, শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনকে বাইরে থেকে ঠেলে দেওয়া চলবে না কিছুতেই। রাজনীতিক হাবাগোবা ভাবের দরুন আপনার দেখতে পাচ্ছেন না যে, আপনারা আমাদের অর্থনীতিবাদীদের সুবিধে করে দিচ্ছেন, আর পরিপুষ্ট করে তুলছেন আমাদের আনাড়ীপনাকে। জিজ্ঞেস করতে পারি কি — আমাদের ছাত্ররা আমাদের শ্রমিকদের ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে সেটা কিসে? সেটা এই অর্থে যে, ছাত্রদের নিজেদের রাজনৈতিক জ্ঞানের যে টুকরোটাকরা ছিল সমাজতান্ত্রিক ভাব ধারণার ছিঁটেফোটা যা তারা আয়ত্ত করে উঠতে পেরেছে (কেননা আজকালকার ছাত্রদের মূখ্য মানসিক খোরাক বৈধ মার্কসবাদ তাদের দিতে পারে শুধু জ্ঞানের প্রাথমিক উপাদান, শুধু টুকরোটাকরা) সেটা তারা নিয়ে গেছে শ্রমিকদের কাছে। এমন বাইরে থেকে ঠেলা মারার আধিক্য কখনও হয়নি; বরং তার উল্টো- এযাবত আমাদের আন্দোলনে সেটা হয়েছে খুবই কম, লজ্জাকর ও জঘন্য পরিমাণে কম, কেননা আমরা নিজেদের রসে ভাপে সিদ্ধ হচ্ছি বড় বেশি অধ্যাবসায় সহকারে, মালিক আর সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের প্রাথমিক অর্থনৈতিক সংগ্রামের প্রতি আমরা নতি স্বীকার করেছি বড় বেশি দাসের মতো। আমাদের পেশাদার বিপ্লবীদের এই রকমের ঠেলে দেবার কাজ করতে হবে আমরা এ যাবৎ যা করেছি তার চেয়ে শতগুণ বেশি জোরসে এবং তা আমরা করবো। কিন্তু আপনারা বেছে নিয়েছেন বাইরে থেকে ঠেলে দেবার মতো বিকট কথাটা,- যারা শ্রমিকদের কাছে বাইরে থেকে রাজনৈতিক জ্ঞান এবং বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে তাদের সবার প্রতি শ্রমিকদের (অন্তত আপনাদের মতো সমান অনগ্রসর শ্রমিকদের) অবিশ্বাস বোধ জাগিয়ে না তুলে পারে না এই কথাটা এমন সমস্ত লোককে বাধা দেবার সাহজিক ইচ্ছা জাগিয়ে না তুলে পারে না এই কথাটা- এর থেকেই প্রমাণ হয় যে আপনারা বক্তৃতাবাগীশ, আর বক্তৃতাবাগীশেরা শ্রমিক শ্রেণির নিকৃষ্টতম শত্রু।
মিনতি করি, বিতর্কে আমার অ-কমরেডসুলভ প্রণালীর কথা তুলে তড়িঘড়ি হৈ-হল্লা জুড়ে দেবেন না যেন। আপনাদের অভিপ্রায়ের বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ করার এতটুকু ইচ্ছাও আমার নেই। আমি যা আগেই বলেছি, তা রাজনীতিক হাবাগোবা ভাব থেকেও কেউ বক্তৃতাবাগীশ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আমি দেখিয়েছি আপনারা নেমে গেছেন বক্তৃতাবাগীশের পর্যায়ে, আর বক্তৃতাবাগীশেরা যে শ্রমিক শ্রেণির নিকৃষ্টতম শত্রু একথা বার বার বলতে আমি কখনও ক্লান্তিবোধ করবো না। নিকৃষ্টতম শত্রু, তার কারণ, তারা জনগণের মধ্যে হীন সহজ প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে, যারা তাদের বন্ধু বলে পরিচয় দেয়, এবং কখনও কখনও সেটা আন্তরিকভাবেই তাদের মধ্যে কাউকে শত্রু বলে চিনতে অনগ্রর শ্রমিকরা অপারগ। নিকৃষ্টতম শত্রু তার কারণ অনৈক্য আর দোদুল্যমানতার কাল পর্যায়ে যখন আমাদের আন্দোলন সবে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে এমন সময়ে জনগণকে বিপথ চালিত করার জন্যে বক্তৃতাবাগীশির চেয়ে সহজ প্রণালী আর কিছুই নয়, এই জনগণ তাদের ভুল বুঝতে পারে শুধু পরে- তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে। এই কারণেই রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের আজকের শ্লোগান হওয়া চাই- সভবোদ আর রাবোচিয়ে দিয়োলোর বিরুদ্ধে সুদৃঢ় সংগ্রাম, উভয়েই নেমে গেছে বক্তৃতাবাগীশির পর্যায়ে।
ডজনখানেক বিজ্ঞজনকে সাফ করে দেওয়া যায় শত মূঢ়ের চেয়ে সহজে। এই আশ্চর্য সত্যটাকে (যার জন্যে শত মুক আপনাদের প্রশংসা করবে সবসময়েই) স্বতঃপ্রতিপন্ন মনে হয় তার একমাত্র কারণ এই যে, যুক্তিটার একেবারে মধ্যেই আপনারা একটা থেকে লাফিয়ে অন্য প্রশ্নে চলে গেছেন, আপনারা শুরু করেছিলেন একটা কমিটি উৎখাত করার কথা দিয়ে, এবং সংগঠনের উৎখাত হবার কথা দিয়ে, আর তাই নিয়ে বলে চলছিলেন, তারপর আপনারা লাফিয়ে চলে গেলেন গভীরে আন্দোলনের শিকড় বের করা প্রশ্নে। প্রকৃত অবস্থা অবশ্য এই যে, আমাদের আন্দোলনের অসংখ্য হাজার শিকড় জনগণের মধ্যে গভীর অনুপ্রবিষ্ট রয়েছে বলেই তা উৎখাত হতে পারে না; কিন্তু আলোচ্য বিষয়টা তা নয়। গভীরে শিকড় নিয়ে বললে আমাদের যাবতীয় আনাড়ীপনা সত্ত্বেও আমরা এখনও উৎখাত হব না, অথচ আমরা সবাই অভিযোগ করি, এবং অভিযোগ না করে পারি নে যে সংগঠনগুলি উৎখাত হচ্ছে, তার ফলে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অসম্ভব। কিন্তু আপনারা যেহেতু সংগঠনগুলি উৎখাত হওয়ার প্রশ্ন তুলছেন এবং মতটা আঁকড়ে ধরেই থাকছেন, তাই আমি বলবো, শত মূঢ়কে উৎখাত করার চেয়ে ডজনখানেক বিজ্ঞজনকে উৎখাত করা ঢের বেশি কঠিন। আমার গণতন্ত্র বিরোধী অভিমত ইত্যাদির জন্যে আপনারা আমার বিরুদ্ধে জনগণকে যতই উত্তেজিত করুন না কেন, এই মতাবস্থান আমি বজায় রাখব। আমি বার বার যা বলেছি, সংগঠন প্রসঙ্গে বিজ্ঞজন বলতে আমি বুঝিয়েছি পেশাদার বিপ্লবীদের- তারা গড়ে উঠুক ছাত্রদের কিংবা মেহনতিদের মধ্য থেকে সেটা নির্বিশেষে। আমি দৃঢ়োক্তি করছিঃ ১) যা ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এমন নেতাদের সুস্থিত সংগঠন ছাড়া কোনো বিপ্লবী আন্দোলন টিকে থাকতে পারে না; ২) যত ব্যাপক জনগণ স্বতঃস্ফূতভাবে সংগঠনের মধ্যে এসে পড়ে আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করবে এবং তাতে অংশগ্রহণ করবে, এমন সংগঠনের প্রয়োজন হবে ততই জরুরি, আর এই সংগঠন হওয়া চাই ততই বেশি পোক্ত (কেননা জনগণের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অংশগুলিকে ভিন্ন পথে চালিত করা হরেক রকমের বক্তৃতাবাগীশদের পক্ষে অনেক সহজ); ৩) এমন সংগঠন হবে প্রধানত এমন সব লোক নিয়ে পেশাগতভাবে বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপে ব্যাপৃত; ৪) স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা এমন সংগঠনের সদস্যপদ যত বেশি সীমাবদ্ধ রাখবো এমনসব লোকেদের মধ্যে যারা পেশাগতভাবে বৈপ্লবিক ক্রিয়াকলাপে ব্যাপৃত এবং যারা রাজনীতিক পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিদ্যা আয়ত্ত করেছে পেশাগতভাবে, সংগঠনকে উৎখাত করা হবে ততই বেশি কঠিন; এবং ৫) শ্রমিক শ্রেণি এবং অন্যান্য সামাজিক শ্রেণি থেকে যারা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে তাদের সংখ্যা হবে ততই বেশি।
আমাদের অর্থনীতিবাদী, সন্ত্রাসবাদী এবং অর্থনীতিবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের* আমি আহ্বান জানাচ্ছি তাঁরা খন্ডন করুন তো এইসব উপস্থাপনা। এখন আমি শেষের দুটো কথা নিয়ে আলোচনা করছি। কোনটাকে সাফ করে দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ- ডজনখানেক বিজ্ঞজনকে, না শত মূঢ়- এ প্রশ্নটা উপরে আলোচিত পর্যবসিত হয়: কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা যখন অপরিহার্য সেক্ষেত্রে গণ সংগঠন থাকা সম্ভব কিনা। যে পরিমাণে গোপনীয়তা ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে অটল ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের প্রশ্ন ওঠে না ততখানি গোপনীয়তা আমরা গণসংগঠনে রক্ষা করতে পারিনে। যথাসম্ভব স্বল্প সংখ্যক পেশাদার বিপ্লবীর হাতে সমস্ত গোপন কাজকর্ম কেন্দ্রীভূত করার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা সবার হয়ে চিন্তা করবেন, আর জনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় আসবে না। বরং তার উল্টো, জনতা তার কাতার থেকে ক্রমাগত বেশি সংখ্যক পেশাদার বিপ্লবীদের তুলে ধরবে, কেননা জনতা তখন জানতে পারবে যে, আর্থনীতিক সংগ্রামে ব্যাপৃত মুষ্টিমেয় ছাত্র কিংবা মুষ্টিমেয় মেহনতি মানুষ কমিটি গড়ার জন্য জড় হওয়া যথেষ্ট নয়- পেশাদার বিপ্লবী হতে বছরের পর বছর তালিম নিতে হয়; কেবল আনাড়ী ধরনের প্রণালী সম্বন্ধে নয়- এমন তালিম সম্বন্ধে জনতা চিন্তা করবে। সংগঠনের গোপন কাজকর্মের কেন্দ্রীকরণ বলতে কোনক্রমেই আন্দোলনের সমস্ত কাজ কর্মের কেন্দ্রীকরণ বোঝায় না। বেআইনি সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোপন কাজকর্ম ডজনখানেক পেশাদার বিপ্লবীর হাতে কেন্দ্রীভূত বলে ওই সংবাদপত্রে জনগণের বিস্তৃততম অংশের অংশগ্রহণ কমবে না, বরং সেটা বাড়বে দশ গুণ। এইভাবে এবং কেবল এইভাবেই আমরা এটা নিশ্চিত করবো যাতে বেআইনি সংবাদপত্র পড়া, তার জন্যে লেখা এবং কিছু পরিমাণে তা বিলি করাও প্রায় আর গোপন কাজ থাকবে না, কেননা যে কাগজ বিলি হচ্ছে হাজারে হাজারে তার প্রতিটি কপি নিয়ে বিচার সংক্রান্ত আর প্রশাসনিক লালফিতের কার্যধারা চালানো যে বোকামি এবং অসম্ভব সেটা পুলিশ বুঝতে পারবে অচিরে। সংবাদপত্রের ব্যাপারেই শুধু নয়, আন্দোলনের প্রত্যেকটা কাজকর্মে এমনকি বিক্ষোভ প্রদর্শনের ব্যাপারেও এটা প্রযোজ্য। তাতে জনগণের সক্রিয় এবং ব্যাপক অংশগ্রহণের ক্ষতি হবে না তার উল্টো, সেটার সুবিধেই হবে, কেননা পেশাগত তালিম পুলিশের চেয়ে কম যায় না এমন ডজনখানেক অভিজ্ঞ বিপ্লবীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকবে সমস্ত কাজের গোপন দিক-ইস্তেহার লেখা, মোটামুটি পরিকল্পনা রচনা; প্রত্যেকটা শহর মহল্লার জন্যে, প্রত্যেকটা কারখানা মহল্লার জন্যে এবং প্রত্যেকটা শিক্ষায়নের জন্য নেতৃসংস্থা নিয়োগ করা ইত্যাদি (আমি জানি আমার অগণতান্ত্রিক অভিমতে আপত্তি উঠবে, কিন্তু একেবারেই কা-জ্ঞান বর্জিত এই আপত্তির পুরো জবাব আমি নিচে দেব)। বিপ্লবীদের একটা সংগঠনে সবচেয়ে গোপনীয় কাজকর্ম কেন্দ্রীভূত হলে বহুসংখ্যক অন্যান্য সংগঠনের ক্রিয়াকলাপের পরিধি বাড়বে এবং গুণ উন্নততর হবে, সেগুলি কমবে না, সেইসব সংগঠন বিস্তৃত জনসাধারণের জন্যে, কাজেই যথাসম্ভব ঢিলাঢালা এবং যথাসম্ভব অগুপ্ত- যেমন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন; শ্রমিকদের আত্মশিক্ষাচক্র এবং বেআইনি সাহিত্যের পাঠচক্র; তাছাড়া, জনসমষ্টির অন্যান্য সমস্ত অংশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক চক্রও ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনসব চক্র ট্রেড ইউনিয়ন এবং সংগঠন আমাদের সর্বত্র আবশ্যক যথাসম্ভব বেশি সংখ্যায়, সেগুলির কর্মবৈচিত্র্য হবে ব্যাপকতম; কিন্তু ব্যাপরটা হবে অযৌক্তিক অদ্ভুত এবং হানিকর যদি সেগুলিকে বিপ্লবীদের সংগঠনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়; যদি এই দুইয়ের মধ্যেকার সীমারেখাটাকে মুছে দেওয়া হয়; গণআন্দোলনের সেবা করতে হলে আমাদের এমন সব লোক থাকা চাই যারা একমাত্র সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক ক্রিয়াকলাপেই ব্যাপৃত থাকবে এবং পেশাদার বিপ্লবী হওয়ার জন্য এমনসব লোককে ধৈর্যসহকারে এবং অবিচলিতভাবে তালিম দিতে হবে এটা যে খুবই ক্ষীণভাবে স্বীকৃত সেটাকে যদি আরও অস্পষ্ট করে ফেলা হয়।
হ্যাঁ, এই স্বীকৃতিটা অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষীণ। সংগঠনের ব্যাপারে আমাদের নিকৃষ্টতম অপরাধ হলো এই যে, আমাদের আনাড়ীপনা দিয়ে আমরা রাশিয়ার বিপ্লবীদের মর্যাদা খর্ব করেছি। তত্ত্ব সংক্রান্ত প্রশ্নে যে তুলতুলে আর নড়বড়ে যার দৃষ্টিভঙ্গি সঙ্কীর্ণ, নিজ কুঁড়েমির কৈফিয়ত হিসেবে যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততার ওজর দেখায়, জনগণের মুখপাত্রের চেয়ে ট্রেড ইউনিয়ন সম্পাদকের সঙ্গে যার মিল বেশি, এমনকি বিরোধীরাও যার প্রতি সসম্ভ্রম হবে এমন বিস্তীর্ণ এবং বলিষ্ঠ পরিকল্পনার কথা যে ভাবতে পারে না, নিজ পেশাগত বিদ্যায়- রাজনৈতিক পুলিশের বিরুদ্ধে লড়ার বিদ্যায়- যে অনভিজ্ঞ এবং জোবড়া জোবড়া, এমন লোক বিপ্লবী নয়, সে হতভাগা আনাড়ী।
কোনো সক্রিয় কর্মী এইসব অকপট মন্তব্যে যেন অসন্তুষ্ট হবেন না, কেননা তালিম যে যথেষ্ট নয়, সেটা প্রথমে এবং সর্বোপরি আমি প্রয়োগ করছি নিজের ওপর। আমি একটা পাঠচক্রে কাজ করতাম- সেটা খুবই বিস্তৃত এবং সর্বতোমুখী কাজ হাতে নিয়েছিলো; আমরা সবাই, সেই চক্রের সদস্যরা এই উপলব্ধি থেকে যন্ত্রণা আর জ্বালা বোধ করেছিলাম যে, ইতিহাসের যে মুহূর্তে আমরা একটা সুবিদিত উক্তি একটু বদলে বলতে পারতাম; “বিপ্লবীদের একটা সংগঠন আমাদের দাও, তাহলে রাশিয়াকে আমরা পাল্টে দেব”। তখন আমরা কাজ করছিলাম আনাড়ীর মতো। তখন আমি যে নিদারুণ লজ্জা বোধ করেছিলাম সে কথা আমার যতই মনে পড়ে ততই বেশি আমি তিক্ততা বোধ করি সেইসব নকল সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের প্রতি যাদের প্রচার বিপ্লবীর মর্যাদাকে কলঙ্কিত করেছে, যারা এটা বুঝতে অপারগ যে, বিপ্লবীকে আনাড়ীর পর্যায়ে অধঃপতিত করার ধ্বজাধারী হওয়া নয়, আমাদের কাজ হলো আনাড়ীদের বিপ্লবীর পর্যায়ে উন্নীত করা।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।