মনোবৈজ্ঞানিক যুদ্ধতত্ত্ব (ইংরেজি: Psychoanalytic theory of war) হচ্ছে সেই যুদ্ধ তত্ত্ব যাতে যুদ্ধ সংঘটনের কারণ হিসেবে মানুষের সহজাত আক্রমণাত্মক প্রবণতাকে দায়ী করা হয়। এই মতের সমর্থক চিন্তাবিদেরা বলার চেষ্টা করেন যে মানুষ সহজাতভাবেই হিংস্র, মানব প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে যুদ্ধের কারণ অথবা তারা বলেন যে মানুষ জন্মগতভাবেই যুদ্ধবাজ প্রাণী। মূলত পুঁজিবাদ আবির্ভাবের পর থেকেই পুঁজিবাদী ও বিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করেন যুদ্ধের এই মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) মনে করতেন যে মানুষের প্রকৃতির ভিতর একটা আক্রমণাত্মক প্রবণতা (aggressive instinct) রয়েছে এবং যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সেই প্রবণতার প্রকাশ।[১] আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ থেকে সামন্ত সমাজ পর্যন্ত মানুষকে সমস্ত দার্শনিকরাই উল্লেখ করতেন সমাজবদ্ধ সামাজিক জীব হিসেবে। কিন্তু বুর্জোয়ার উৎপত্তি হবার সাথে সাথে প্রয়োজন পড়লো মানুষের সামাজিক পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে মানুষকে নৃশংস, আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখানোর। এক ব্যক্তিবাদী সমাজবিচ্ছিন্ন জন্তুরূপে মানুষকে দেখাতে হলো আগ্রাসী লোভী হিসেবে। দার্শনিক টমাস হবসের (১৫৮৮-১৬৭৯) জবানিতে বুর্জোয়ারা মানুষকে নেকড়ের মতো হিংস্র, লোভি, নোংরা পশু হিসেবে সর্বপ্রথম উপস্থিত করে।[২]
আধুনিক যুগের বিভিন্ন মনস্তত্ববিদ এবং নৃতত্ত্ববিদরা ফ্রয়েডের এই মতবাদ সম্পূর্ণ স্বীকার করেন না। যুদ্ধ করার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মানুষের অন্তরে নিহিত আছে বলে তাঁরা মনে করেন না। Malinowski, Clyde Kluckhohn প্রমুখ নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে মানুষ যখন তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি চরিতার্থ করার পথে বাধা পায় তখনই তার মনে আক্রমণাত্মক প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তার নিরাপত্তা বা স্বাভাবিক যৌথ জীবন যখন কোন কারণে ব্যাহত হয় তখনই তার মনে সংগ্রাম স্পৃহা বা আক্রমণাত্মক প্রবণতা সষ্টি হয়ে থাকে। অতএব তাঁরা মনে করেন যে আক্রমণাত্মক প্রবণতা মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নয়—পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের মনে এই ধরনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়।[৩]
কোন কোন মনস্তত্ববিদরা মনে করেন যে যুদ্ধ করার কোন স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষের না থাকলেও অন্যের উপর নিজের তাধিপত্য বিস্তার করার প্রবত্তি মানুষের মধ্যে দেখা যায়। আলফ্রেড এ্যাডল্যার (Alfred Adler) বলেন যে অন্যের তুলনায় নিজেকে বড় করে তােলার প্রবত্তি (longing for superiority) মানুষের মধ্যে খুব প্রবল এবং এই প্রবত্তি দ্বারা তার আচরণ বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কারেন হনে (Karen Horney) এ্যালডারের এই কথা মােটামুটি ভাবে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন যে যারা বাল্যকালে অবহেলিত হয় এবং বিশেষ কোন মর্যাদা পায় না তাদের মনে এক ধরনের হীনমন্যতাভাব জাগরিত হয় এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবতী জীবনে যেভাবেই হােক এবং যে পথেই হােক কৃতকার্যতা লাভ করে এবং অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করে অতীত জীবনের ব্যর্থতা ও অপমানের প্রতিশােধ নিতে চায়। লাসওয়েল (Harold D. Lasswell) রাজনৈতিক সমস্যার মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন যে সমাজে যারা নিজেদেরকে অবহেলিত এবং যােগ্য মূল্য ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত মনে করে তাদের কারও কারও মধ্যে উদগ্র ক্ষমতাহা দেখা দেয় এবং জনস্বাধের নামে তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করার চেষ্টা করে। ক্ষমতা লাভ করাই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠে এবং তার সাহায্যে তারা জীবনের অন্য ক্ষেত্রের ব্যর্থতাকে ভুলতে চায়। এই ধরনের মানুষকে লাসওয়েল ‘political type’ বলে বর্ণনা করেছেন (এই বিষয়ে লাসওয়েলের মতবাদের জন্য তাঁর লেখা Power and Personality এবং Harold D. Lasswell ও Abraham Kaplan-এর লেখা Power and Society বই দ্রষ্টব্য)।
অনেক মনস্তত্ববিদের ধারণা যে জীবন সংগ্রামে ও প্রতিযােগিতার ক্ষেত্রে বিফলতার ফলে যে নৈরাশ্যের (frustration) উদয় হয় তা কোন কোন সময় মানুষের মনে এক ধংসাত্মক ও আগ্রাসী (aggressive) মনোভাবের সষ্টি করে এবং সেই আক্রমণাত্মক মনোভাব যে কোন মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে পারে। এই কথা জাতি সম্বন্ধেও প্রযােজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিফলতা এবং ভাসাইএর অপমানের পর জার্মানীতে যে নৈরাশ্যের ভাব সষ্টি হয় তা হিটলারের নেতৃত্বে এক চরম আগ্রাসী মনােভাবের রপ নেয়। এই কথা ঠিক যে এ্যাডলার বা হনে কখনও বলেননি যে নিজেকে বড় বরে তােলার বা অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করার প্রবত্তি একমাত্র রাজনৈতিক পথেই চরিতার্থ করা সম্ভব। পুরুষ মানুষ স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী প্রভৃতির উপর বিভিন্ন ভাবে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। হনে এই কথাই বলেছেন যে প্রথম জীবনের গ্লানি ও ব্যর্থতার ফলে একজন মানুষ যে কোন ক্ষেত্রে—চিন্তার ক্ষেত্রে, ধর্ম বা শিল্পের ক্ষেত্রে, সামাজিক কাজে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইত্যাদি—কৃতকার্যতা অর্জন করার চেষ্টা করতে পারে। সমস্যা হল যে যদি এই ধরনের মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাভ করে তবে তার ব্যক্তিত্বের জটিলতার জন্য নানারকম রাজনৈতিক সমস্যা এবং যুদ্ধের সম্ভাবনাও সন্টি হতে পারে। লাসওয়েল যাদের ‘political type’ বলে বর্ণনা করেছেন অথবা বিফলতা ও পরাজয়ের ফলে যাদের মন ধংসাত্মক ও আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে তারা যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন একই সমস্যা দেখা দেয়। যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক কারণ সম্বন্ধে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকে রাষ্ট্রীয় নেতাদের ব্যক্তিত্ব গঠনের (personality stiucture) উপর, বিশেষভাবে গুরুত্ব আরােপ করেন। সমাজে সকলের সাথে মিলেমিশে থাকার অনেক সমস্যা আছে। সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপণ সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হলে মানুষের মনে নানাবিধ অস্বস্তি, উদ্বেগ ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই ধরনের মানুষ অনেক সময় অপরিচিত লােককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। এই রকম অস্বাভাবিক মানুষ যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করে তবে অন্তজাতিক শান্তি ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনার বদ্ধি পায়। তারা অনেক সময় যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী মনে করে নেয় এবং যুদ্ধের জন্য দেশকে প্রস্তুত করে তােলে।
অনেক যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রীয় নেতাদের অস্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্ততঃক্ষে আংশিকভাবে দায়ী করা চলে। নাৎসী জার্মানীর কার্যকলাপ আলোচনা করতে গেলে হিটলারের ব্যক্তিগত দষ্টিভঙ্গির মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা প্রয়ােজন। হিটলার সম্বন্ধে কারেন হনে (Karen Horney) লিখেছেন যে প্রথম জীবনে তাঁকে অনেক অপমান ও গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে এবং তারপর বহু লােকের উপর নিজের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে তিনি তার প্রতিশােধ নেওয়ার চেষ্টা করেন।[৪] ইতিহাসে এমন অনেক অস্বাভাবিক ক্ষমতাপ্রিয় নেতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যাঁরা নিজেদের প্রভাবপ্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য দেশকে যুদ্ধের পথে পরিচালিত করেছেন। প্রুশিয়ার বিখ্যাত রাজা ফ্রেডারিক দি গ্রেট (Frederick the Great) বলেছেন যে তাঁর যৌবন, উচ্ছাস, গৌরব অর্জনের দুনিবার আকর্ষণ, কৌতূহল এবং এক স্বতঃস্ফত আবেগ তাঁকে শান্তির পথ থেকে দূরে টেনে এনেছে। তিনি বলেন যে পত্রিকাতে নাম উঠবে এবং শেষে ইতিহাসে নাম লেখা থাকবে এই আনন্দ তাঁকে যুদ্ধে পরিচালিত করেছে।[৫]
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর উদ্যোগে যুদ্ধ সমস্যা নিয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্যানট্রিল (Professor Cantril)-এর সভাপতিত্বে আলোচনা করেন। এই সব আলোচনা Cantril-এর সম্পাদনায় Tensions that Cause Wars নামক পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। এই আলোচনায় যাঁরা যােগদান করেছিলেন তাঁরা সকলেই স্বীকার করেন যে মানুষের স্বাভাবিক প্রবত্তির অনিবার্য ফল হিসেবে যুদ্ধকে মেনে নেওয়ার কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না, তবে পরােক্ষ ভাবে বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নেতাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গী অনেক সময় যুদ্ধের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে।[৬]
তথ্যসূত্র:
১. “Men are not gentle, friendly creatures wishing for love, who simply defend themselves if they are attacked……… A powerful measure of desire for aggression has to be reckoned as part of their instinctual endowment……..Civilized society is perpetually menaced with disintegration through this primary hostility of men towards one another,” sigmund Freud, Civilization and its Discontents.
২. অনুপ সাদি, “পুঁজিবাদী সমাজে টাকা ও মুনাফা মানুষকে পশুতে পরিণত করার অস্ত্র“, ২৫ নভেম্বর, ২০১২; প্রতিকথা হানিফ রাশেদীন সম্পা. বর্ষ ৫ সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০১৮-এর পৃষ্ঠা ৫-৯
৩. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১৬৮-১৭১।
৪. “Among recent historical figures Hitler is a good illustration of a person who went through humiliating experiences and gave his whole life to & fanatic desire to triumph over an ever-increasing mass of people.”
৫. “My youth, the fire of passions, the desire for glory, yes, to be frank, even curiosity, finally a secret instinct has torn me away from the delights of tranquility. The satisfaction of seeing my name in the papers and later in history has seduced me.”
৬. “The greatest menage to the world to-day are leaders in office who regard war as inevitable.”
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।