বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির প্রতিথযশা তাত্ত্বিক কার্ল মার্কসের (৫ মে, ১৮১৮ – ১৪ মার্চ, ১৮৮৩) রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, ইতিহাস ও অর্থনীতি বিষয়ক কয়েকটি উদ্ধৃতি এখানে সংকলিত হয়েছে।
১. শ্রমিক শ্রেণি হয় বিপ্লবী, নয়তো কিছুই নয়। এঙ্গেলস সমীপে মার্কস, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৫
২. যে মুহূর্তে জনগণকে আকৃষ্ট করে সেই মুহূর্তেই ঐ তত্ত্বটি বাস্তব শক্তিতে পরিণত হয়। ‘হেগেলের ফিলসফি অফ রাইট’ সম্বন্ধে আলোচনা।
৩. [প্যারিস] কমিউনের প্রথম ডিক্রিই হলো স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর বিলোপ ও সশস্ত্র জনগণ দিয়ে তার স্থান পূরণ…। ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ
৪. [প্যারিস] কমিউন গঠিত হয় প্যারিসের বিভিন্ন পল্লীতে সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত পৌর পরিষদ সভ্যদের নিয়ে। তারা ছিলো জবাবদিহিতে বাধ্য এবং যে কোনো সময়ে অপসারণীয়। স্বভাবতই তাদের অধিকাংশই ছিলো শ্রমিক, অথবা শ্রমিক শ্রেণির স্বীকৃত প্রতিনিধি… । ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ
৫. পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক যুগে ও সমাজে দেশের উন্নতি বলতেই বোঝায় ধনীক মালিক শ্রেণির উন্নতি।
৬. পুঁজিবাদী সমাজ আর কমিউনিস্ট সমাজ, এই দুই-এর মধ্যে রয়েছে একটি থেকে অপরটিতে বিপ্লবী রূপান্তরের এক পর্ব। তারই সংগে সহগামী থাকে একটি রাজনৈতিক উৎক্রমণ পর্ব যখন রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া কিছুই হতে পারে না। গোথা কর্মসূচির সমালোচনা।
৭. মানুষ মানুষের কাছে সবচেয়ে সমুন্নত জীব। তাই প্রয়োজন সেই সমস্ত সম্পর্কের শর্তহীন উচ্ছেদ যেখানে মানুষ হয়ে রয়েছে হেয়, দাসে পরিণত, বিস্মৃত ও ঘৃণিত জীব। হেগেলের আইনের দর্শনের পর্যালোচনায় প্রদত্ত রচনা
৮. দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগতকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলও তাকে পরিবর্তন করা। ফয়েরবাখ সম্পর্কে থিসিসসমূহ
৯. টাকা হচ্ছে প্রয়োজন ও বস্তুর মধ্যেকার যোগসূত্র_ মানুষের জীবন ও খাদ্যের মধ্যেকার যোগসূত্র… যা আমি মানুষ হিসেবে করতে অক্ষম, অর্থাৎ আমার ব্যক্তিগত মেধা দিয়ে করতে অক্ষম, সেটা টাকা দিয়ে আমি করিয়ে নিতে পারি। সুতরাং টাকা আমাদের মেধাশক্তিগুলোকে পর্যন্ত… তাদের বিপরীতে পরিণত করতে পারে, অক্ষমকে সক্ষম করতে পারে। আমার যদি কিছু খেতে ইচ্ছে হয় অথবা গাড়িতে ভ্রমণ করার ইচ্ছা হয়… টাকা তবে সে খাবার ও গাড়িকে এনে হাজির করতে পারে। অর্থাৎ টাকা আমাদের ইচ্ছাগুলোকে কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। তাদেরকে কল্পিত অস্তিত্ব থেকে বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্বে অনুবাদ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় টাকাই হচ্ছে প্রকৃত সৃজনীমূলক শক্তি। অর্থনৈতিক ও দার্শনিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট
১০. বিকাশের গতিপথে শ্রমিক শ্রেণি পুরোনো বুর্জোয়া সমাজের স্থলে এমন সমিতি স্থাপন করবে যাতে শ্রেণি ও তাদের বৈপরীত্য বর্জিত হবে; সত্যকার কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতাও থাকবে না, কেননা রাজনৈতিক ক্ষমতাই হলো বুর্জোয়া সমাজের অভ্যন্তরে শ্রেণি-বৈপরীত্যের সরকারি অভিব্যক্তি। দর্শনের দারিদ্র্য
১১. উৎপাদনশীল পুঁজি যতই বেড়ে যায়, শ্রম-বিভাগ এবং যন্ত্রপাতির প্রচলনও তত প্রসার পায়। আবার শ্রম-বিভাগ এবং যন্ত্রপাতির প্রচলন যতই বেড়ে চলে মজুরদের মধ্যে প্রতিযগিতাও ততই বাড়ে, মজুরিও তত কমে যায়। মজুরি-শ্রম ও পুঁজি
১২. কর আর কিছুর নয় সরকারি শাসনযন্ত্রেরই অর্থনৈতিক ভিত্তি।… আয়কর ধরে নেয় যে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির আয়ের বিভিন্ন উৎস আছে আর তাই এ সমাজ পুঁজিবাদী সমাজ। গোথা কর্মসূচির সমালোচনা।
১৩. পুঁজি হলো সেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা, বুর্জোয়া সমাজে যা সব কিছুর উপরে প্রাধান্য করে। অর্থশাস্ত্র বিচার প্রসঙ্গে
১৪. পুঁজির স্বার্থ ও মজুরি-শ্রমের স্বার্থ পরস্পরের একান্ত বিপরীত। মজুরি-শ্রম ও পুঁজি
১৫. পুরনো বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হলো ‘নাগরিক’ সমাজ; নতুন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হলো মানবিক সমাজ বা সমাজীকৃত মানবসমাজ। ফয়েরবাখ সম্পর্কে থিসিসসমূহ
১৬. প্রত্যেক বিপ্লবই পুরনো সমাজকে ভেঙ্গে ফেলে ও সেই পরিমাণেই তা সামাজিক। প্রত্যেক বিপ্লবই পুরনো ক্ষমতাকে উৎখাত করে ও সেই পরিমাণেই তা রাজনৈতিক। Critical Marginal Notes on the article The King of Prussia and Social Reform. By a Prussian
১৭. প্রলেতারিয়েতের পক্ষে তার অন্নের চেয়েও বেশি আবশ্যক তার সাহস, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা জ্ঞান এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ। Rheinischer Beobachter-এর কমিউনিজম
১৮. সকল শ্রেণির বিলুপ্তি হলো শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির শর্ত। দর্শনের দারিদ্র্য
১৯. যথেষ্ট মুনাফার ক্ষেত্রে পুঁজি ভারি সাহসী। সুনিশ্চিত শতকরা দশে পুঁজি যে কোনো জায়গায় পুঁজির নিয়োগ সম্ভব করবে; সুনিশ্চিত শতকরা কুড়িতে সৃষ্টি হবে আগ্রহ; সুনিশ্চিত শতকরা পঞ্চাশে তার ঔদ্বত্ত্য সীমা ছাড়াবে, শতকরা একশোয় তা সমস্ত মানবিক নিয়ম পদদলিত করতে প্রস্তুত থাকবে; শতকরা ৩০০ এমন অপরাধ নেই যাতে সে কুণ্ঠিত, এমন ঝুঁকি নেই যা সে নেবে না, এমনকি পুঁজির মালিকের ফাঁসি হতে পারে জেনেও ছুটবে লাভের অদম্য লালসায়। যদি হাঙ্গামা ও সংঘর্ষে মুনাফা আসে, তবে অবাধে দুয়েরই উসকানি দেবে সে। যা বলা হলও তা যথেষ্ট প্রমাণিত হয়ে গেছে চোরা-চালান ও ক্রীতদাস-বাণিজ্যে। টি. জে ডানিং-এর লেখা গ্রন্থ ‘ট্রেডস ইউনিয়ন্স এন্ড স্ট্রাইক্স’ থেকে মার্কস ব্যবহার করেছেন পুঁজি গ্রন্থের ৮ম অধ্যায়ে।
২০. বুর্জোয়া উৎপাদনপদ্ধতি তখনই উচ্ছেদ হতে পারে যখন তার বৈষয়িক ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে, যখন তার উচ্ছেদ হওয়াটা প্রয়োজন। তার পূর্বে যদি সর্বহারা বুর্জোয়ার রাজনৈতিক শাসনের ইতি ঘটায়, তবে সে জয় হবে সাময়িকমাত্র। Moralizing Criticism and Critical Morality; Marx and Engels, Collected Works, Vol_6, Page_ 319.
২১. বস্তুত ধারনা, চিন্তা, ভাব হচ্ছে চেতনা থেকে সৃষ্ট। জার্মান ভাবাদর্শ থেকে। Conceptions, thoughts, ideas are in fact all the products of consciousness. German Ideology.
২২. গির্জার সম্পত্তি লুঠ, রাষ্ট্রীয় জমির জুয়াচুরি হস্তান্তর, সর্বজনীন ভূমির অপহরণ, সামন্ত ও কৌম সম্পত্তি জবরদখল করে বেপরোয়া সন্ত্রাসের পরিস্থিতিতে তাকে আধুনিক ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিবর্তন_ এই হলো আদি সঞ্চয়ের কতকগুলি পদাবলীসুলভ পদ্ধতি। পুঁজিবাদী কৃষির জন্য তা ক্ষেত্র জয় করে, জমিকে করে তোলে পুঁজির অঙ্গীভূত অংশ, এবং শহুরে শিল্পগুলির জন্য একটি ‘মুক্ত’ এবং আইনের আশ্রয়হীন প্রলেতারিয়েতের প্রয়োজনীয় সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেয়। পুঁজির উদ্ভব, পুঁজি ৮ম অধ্যায়।
২৩. রাজা যখন প্রতিবিপ্লবে মেতে ওঠে, তখন জনগণ সঠিকভাবেই বিপ্লব দিয়ে তার যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর দেয়। ১৮৪৯ সালে ‘আইনের শাসনের’ বক্তৃতায়
২৪. উৎপাদন শিল্প গঠন করার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত ছিলো পুঁজির সঞ্চয়। আমেরিকার আবিষ্কার তা আরো সহজ করে দেয়।
এটা ভালোভাবে প্রমাণিত যে, বিনিময়-মাধ্যমের প্রবৃদ্ধির ফলে একদিকে মজুরি ও ভূমি খাজনার মূল্যমান হ্রাস পায়, অপরদিকে কল-কারখানার মুনাফার হার বৃদ্ধি পায়। অন্যকথায়ঃ যে পরিমাণে সম্পত্তিবান শ্রেণি, শ্রমজীবী শ্রেণি, সামন্ত শ্রেণি এবং জনসাধারণ গরিবি হালতে ডুবে যায়, সেই পরিমাণে পুঁজিপতি শ্রেণি ধনশালী হয়ে ওঠে। দর্শনের দারিদ্র, ১৮৪৭
২৫. ইতিহাস সম্পর্কে যাঁর সামান্য ধারণা আছে তিনি অবশ্যই জানেন যে বিশাল আকারের সামাজিক পরিবর্তনকারী জাগরণ ব্যতিরেকে নারী জাগরণ অসম্ভব। ১২ ডিসেম্বর, ১৮৬৮, কুগেলমানের কাছে চিঠিতে মার্কস
বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিজ্ঞান ও অর্থনীতির প্রতিথযশা তাত্ত্বিক কার্ল মার্কস (৫ মে, ১৮১৮ – ১৪ মার্চ, ১৮৮৩) প্রুশিয়ার রাইল ল্যান্ড প্রদেশের ট্রিভ্স নামক স্থানে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪৭ সালের বসন্তে মার্কস ও এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট লীগ’ নামে একটি গুপ্ত প্রচার সমিতিতে যোগ দেন। ১৮৪৭ এ নভেম্বরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত লীগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং কংগ্রেস থেকে দায়িত্ব পেয়ে সুপ্রসিদ্ধ ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ রচনা করেন। ১৮৫০-এর দশকের শেষদিক ও ৬০-এর দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন মার্কসকে আবার প্রত্যক্ষ কার্যকলাপের মধ্যে টেনে আনে। ১৮৬৪ সালে (২৮ সেপ্টেম্বর) বিখ্যাত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সঙ্ঘ— প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে। মার্কস ছিলেন এই সমিতির প্রাণস্বরূপ। ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ আরাম কেদারায় বসে মার্কস নীরবে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।