১৪ই অক্টোবর, ১৯৫২
কমরেডস!
যে সমস্ত ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টি ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা এখানে উপস্থিত হয়ে আমাদের পার্টি কংগ্রেসকে সম্মানিত করেছেন, অথবা যাঁরা বন্ধুত্বপূর্ণ অভিনন্দন জ্ঞাপন করেছেন, আমাদের প্রতি আস্থা রেখেছেন, আমাদের আরও সাফল্য কামনা করেছেন, পার্টি কংগ্রেসের নামে তাদের ধন্যবাদ জানানোর অনুমতি আমাকে দিন। (প্রবল দীর্ঘস্থায়ী হাততালি যা হর্ষধ্বনিতে পরিণত হলো।)
এই আস্থার মূল্য আমাদের কাছে অনেক। কারণ, জনগণের জন্য আরও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সংগ্রামে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, শান্তিরক্ষার সংগ্রামে তারা যে আমাদের সমর্থন করতে প্রস্তুত এই আস্থা তা সূচিত করে। (প্রবল, দীর্ঘস্থায়ী হাততালি।)
আমাদের পার্টি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে। এর আর সমর্থনের প্রয়োজন নেই এ ভাবা ভুল হবে। এ হবে ভ্রান্ত চিন্তা। দেশের বাইরের ভ্রাতৃত্বমূলক জনগণের সমর্থন ও সহমর্মিতা, নিরন্তর আস্থা আমাদের পার্টি ও আমাদের দেশের প্রয়োজন এবং সব সময় তা প্রয়োজন হবে।
এই সমর্থনের বিশেষ মূল্য এখানেই যে আমাদের দলের শান্তিরক্ষার সমস্ত প্রচেষ্টাকে ভ্রাতৃপ্রতিম দলগুলোর সমর্থন শান্তিরক্ষায় আমাদের প্রচেষ্টার প্রতি তাঁদের দেশের জনগণের সমর্থন সূচিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর ইংরেজ বুর্জোয়াদের আক্রমণের সময়, ১৯১৮-১৯১৯ সালে ইংল্যাণ্ডের শ্রমজীবীরা “রাশিয়া থেকে হাত ওঠাও” এই স্লোগান তুলে সংগ্রাম সংগঠিত করেছিল। এটাও ছিল সমর্থন, শান্তিরক্ষায় তাদের দেশের জনগণের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন, আবার তা সোভিয়েত ইউনিয়নকেও সমর্থন। যদি কমরেড থোরেজ বা কমরেড তোগলিয়াত্তি ঘোষণা করেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁদের দেশের জনগণ অংশগ্রহণ করতে চায় না (প্রবল হর্ষধ্বনি) – তাহলে সেটাও একটা সমর্থন, সর্বোপরি যারা শান্তির জন্য সংগ্রাম করছেন সেই ইতালি ও ফ্রান্সের শ্রমিক কৃষকের সমর্থন, আর সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তি প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থনও বটে। সমর্থনের এই বিশেষ গুণকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের দলের স্বার্থ শান্তিকামী জনগণের স্বার্থের বিরোধী নয়। কিন্তু এটাই সব নয়। এর বিপরীতে, আমাদের স্বার্থ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সাথে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে (প্রবল হর্ষধ্বনি)। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলতে গেলে বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে তার স্বার্থ সমগ্র দুনিয়ার শান্তির স্বার্থ থেকে আলাদা করা যায় না।
বোঝাই যায়, আমাদের পার্টি ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলোর প্রতি তার দায়িত্ব পালন করবে, মুক্তি সংগ্রামে ও শান্তিরক্ষার সংগ্রামে তাদের এবং তাদের জনগণকে সমর্থন করবে। এই হলো পার্টির করনীয় (প্রবল হর্ষধ্বনি)। ১৯১৭ সালে ক্ষমতা দখলের পর, পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের উচ্ছেদের যথার্থ কার্যক্রম গ্রহণের পর, আমাদের সাহসী ও সফল পদক্ষেপ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির প্রতিনিধিরা আমাদের পার্টিকে দুনিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের ও শ্রমিক আন্দোলনের “শক বিগ্রেড” নামে অভিহীত করেছিলেন। এর ফলে তারা এই আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, “শক ব্রিগেডের” সাফল্য পুঁজিবাদী জোয়ালের অধীনে থাকা জনগণের দুঃখ কষ্ট লাঘব করবে। আমি মনে করি, আমাদের দল বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই আশা পূরণ করেছে। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মান ও জাপানী ফ্যাসিবাদের স্বৈরাচারকে ধ্বংস করেছে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার জনগণকে ফ্যাসিবাদী দাসত্বের বিপদ থেকে মুক্ত করেছে। (প্রবল হর্ষধ্বনি)।
অবশ্য, এই সম্মানজনক কাজ সম্পন্ন করা ছিল খুবই কঠিন কারণ “শক বিগ্রেড” ছিল একটাই। যতদিন সে একা ছিল, ততদিন সে ছিল এই কর্তব্য সম্পাদনের অগ্রগামী বাহিনী। কিন্তু তা অতীতের বিষয়। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন চীন ও কোরিয়া থেকে চেকোশ্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরী – মানচিত্রে নতুন নতুন “শক বিগ্রেডের” আবির্ভাব হয়েছে। এরা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ। এখন আমাদের দলের পক্ষে সংগ্রাম সহজতর হয়েছে এবং কাজও চলছে আরও ভালো। (প্রবল দীর্ঘস্থায়ী হর্ষধ্বনি)
কঠোর বুর্জোয়া শাসনের অধীনে যে সমস্ত কমিউনিস্ট, গণতান্ত্রিক ও শ্রমিক কৃষক পার্টিকে কাজ করতে হচ্ছে এবং যারা এখনও ক্ষমতাসীন হয়নি তাদের দিকে অবশ্যই বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের কাজ নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন। কিন্তু জারের সময়ে রুশ কমিউনিস্টদের কাজ যত কঠিন ছিল তাদের কাজ তত কঠিন। নয়। তখন প্রগতির দিকে সামান্য পদক্ষেপকেই ভয়ংকর অপরাধ বলে মনে করা হতো। রুশ কমিউনিস্টরা অবশ্য দৃঢ় ছিল, তারা অসুবিধা দেখে পিছিয়ে আসেনি এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। এই সমস্ত দলের ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে।
জারতন্ত্রের সময় রুশ কমিউনিস্টদের কাজ যতটা কঠিন ছিল এই সব পার্টির কাজ ততটা কঠিন নয় কেন?
কারণ, প্রথমত, তাদের সামনে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য গণপ্রজাতন্ত্রী দেশগুলোর সংগ্রাম ও সাফল্যের উদাহরণ। তাই, এই সব দেশের সাফল্য ও ভুল থেকে তাঁরা শিক্ষা নিতে পারে আর এই ভাবে তাঁদের কাজকে সহজ করতে পারে।
কারণ, দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা আন্দোলনের ভয়ংকর শত্রু পুঁজিপতিরা নিজেই আলাদা, বাস্তবে পাল্টে গেছে, আরও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে। তারা জনগণের সহযোগিতা হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বোঝাই যায়, এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর কাজ সহজ হয়ে যাবে। (প্রবল হর্ষধ্বনি।)
আগে বুর্জোয়ারা নিজেদের উদারনীতিবাদী বলে জাহির করত। তারা জাহির করত যে তারা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে এবং এইভাবে তারা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু এখন উদারনীতিবাদের ছিঁটেফোটাও নেই। “ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা” বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আর নেই, একমাত্র পুঁজির মালিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার কথাই তারা এখন স্বীকার করে। অন্য সব মানুষকে কাঁচামাল বলে মনে করা হয়। তারা আছে শুধু শোষণের জন্য। জনগণের ও বিভিন্ন জাতির সমঅধিকারের নীতি এখন ধুলায় লুণ্ঠিত। একে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের শোষণের অধিকারের নীতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত নাগরিকদের কোনও অধিকারই নেই। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পতাকা ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। আমি মনে করি, আপনারা যারা বিভিন্ন সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক দলের প্রতিনিধি এই পতাকাকে তারা তুলে নেবেন এবং যদি অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পেতে চান তবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার আর কেউ নেই। (প্রবল হর্ষধ্বনি)
আগেকার দিনে, জাতির প্রধান হিসাবে, বুর্জোয়ারা ছিল জাতির অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে এবং তাকে তারা সবার উপরে স্থান দিত। এখন এই “জাতীয় নীতির” আর ছিঁটেফোটাও অবশেষ নেই। এখন বুর্জোয়ারা ডলারের বিনিময়ে অধিকার ও স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দিচ্ছে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে আপনারা, গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দলের প্রতিনিধিরা এই পতাকাকে অবশ্যই উর্ধ্বে তুলে ধরবেন। আর আপনারা যদি দেশপ্রেমিক হতে চান, যদি জাতির নেতৃত্বকারী শক্তি হতে চান তবে এই পতাকাকে আপনারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। (প্রবল হর্ষধ্বনি)
বর্তমানে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই রকম।
বোঝা যায় এই পরিস্থিতি সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর কাজকে সহজ করে দেবে।
তাই, পুঁজিবাদী দেশে ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলোর সাফল্য ও বিজয়ের সর্ববিধ ভিত্তি আছে। (প্রবল হর্ষধ্বনি)
আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দলগুলো জিন্দাবাদ! (দীর্ঘস্থায়ী হর্ষধ্বনি)
ভ্রাতৃপ্রতিম দলগুলোর নেতাদের দীর্ঘজীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি! (দীর্ঘস্থায়ী হর্ষধ্বনি)
জনগণের মধ্যে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হোক! (দীর্ঘস্থায়ী হর্ষধ্বনি)
যুদ্ধবাজরা নিপাত যাক!
(সবাই উঠে দাঁড়ালেন। প্রবল দীর্ঘস্থায়ী হাততালি হর্ষধ্বনিতে পরিণত হলো। শোনা গেল “কমরেড স্ট্যালিন দীর্ঘজীবী হোন!” “দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের মহান নেতা কমরেড স্ট্যালিন জিন্দাবাদ!” “মহান স্ট্যালিন!” “জনগণের মধ্যে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হোক!” এই সব স্লোগান।)
(সি পি এস ইউ এর ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে বক্তৃতা। ডায়েৎস প্রেস, বার্লিন, ১৯৫২, পৃঃ ৫-১৫)।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যোসেফ স্তালিনের এই লেখাটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশ কংগ্রেসে প্রদত্ত ভাষণের লিখিত রূপ। লেখাটি “Speech of the 19th Party Congress of the Communist Party of the Soviet Union” লেখাটির বঙ্গানুবাদ। বাংলা লেখাটি রোদ্দুরে ডট কম গ্রহণ করেছে, জে ভি স্ট্যালিন নির্বাচিত রচনাবলী চতুর্থ খন্ড, প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ মে ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৭৭-২৮০ থেকে।
জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন বা যোসেফ স্তালিন বা জোসেফ স্ট্যালিন (১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ৫ মার্চ ১৯৫৩) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মানে এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দীর্ঘতম সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ তথা বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম যোসেফ ভিসারিওনোভিচ সোসো, স্তালিন নামটি তিনি ১৯১০ সালে ‘লৌহমানব’ অর্থে ধারণ করেন। তাঁকে মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা ও জনগণের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়।