ইনেসা আরমান্দ সমীপে লেনিন

২৪শে জানুয়ারি, ১৯১৫

প্রিয় বন্ধু,

তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরি হলো বলে মার্জনা চাই। কালই উত্তর দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু ফিরতে দেরি হলো বলে আর লিখবার সময় পাইনি।

খসড়া পুস্তিকার বিষয়ে বলি। আমি দেখলাম ‘স্বাধীন প্রেমের দাবি’ কথাটা অস্পষ্ট রয়ে গেছে, এবং তুমি কী চাও বা ইচ্ছা করো তার অপেক্ষা না রেখেই (যা আমি বলেছিলাম যে প্রশ্নটা হলো বাস্তব শ্রেণি সম্পর্কের এবং তোমার আত্মমুখী ইচ্ছা নয়)

বর্তমান সমাজের অবস্থা অনুসারে দাবিটি বুর্জোয়া দাবি হয়ে দাঁড়াবে, সর্বহারা দাবি নয়। তুমি মানছ না? বেশ। আর একবার বিষয়টি দেখা যাক। না বস্তুত আমি ১০টি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছি (শ্রেণী সংগ্রামের অবস্থার অনিবার্য ব্যাখ্যা) এবং আমি মন্তব্য করেছি যে, আমার মতে ১নং থেকে ৭নং পর্যন্ত ব্যাখ্যা ঠিক শ্রমিকশ্রেণীর নারীদের জন্য আর ৮নং থেকে ১০নং পর্যন্ত ব্যাখ্যা ঠিক বুর্জোয়া নারীদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।

এ যদি অস্বীকার কর তবে তোমাকে দেখতে হবে যে :

(১) ব্যাখ্যাগুলি মিথ্যে (তাহলে তোমার সেগুলির জায়গায় অন্যরূপ ব্যাখ্যা দিতে হবে অথবা মিথ্যে ব্যাখ্যাগুলি প্রত্যাহার করতে হবে)।

(২) সেগুলি অসম্পূর্ণ (সুতরাং সেগুলি সম্পূর্ণ করতে হবে)।

(৩) অথবা দেখতে হবে যে, সেগুলি সর্বহারা এবং বুর্জোয়া ব্যাখ্যা হিসাবে। আলাদা করা যায় না। কিন্তু তুমি এসব কিছুই করছ না।

(৪) তুমি ১নং থেকে ৭নং পর্যন্ত বিষয় স্পর্শ করনি। সুতরাং আমি ধরে নিতে পারি যে তুমি সেগুলির সত্যতা স্বীকার করছ (সাধারণভাবে)। তুমি শ্রমিক নারীদের পতিতাবৃত্তি সম্বন্ধে এবং তাদের নির্ভরশীলতা সম্বন্ধে যা লিখেছ-‘তাঁদের পক্ষে যে না বলা অসম্ভব’ সে সব ১নং থেকে ৭নং বিষয়ের মধ্যে ঠিকই আছে। যাহোক, এ প্রশ্নে আমাদের মধ্যে কোনো রকম মতানৈক্য নেই। আর এ কথাও তুমি অস্বীকার  করনি যে, এ হলো সর্বহারা ব্যাখ্যা। তাহলে বাকি রইল ৮নং থেকে ১০নং বিষয়।  

আরো পড়ুন:  সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে নারী শ্রমিক আন্দোলনের কর্তব্য

তুমি একেবারেই ‘সে সব বোঝনি’ এবং তুমি প্রতিবাদ কর ‘আমি বুঝতে পারি কি করে কেউ ১০নং বিষয়ের সঙ্গে স্বাধীন প্রেমকে এক করে দেখতে পারে (তোমার ভাষায়) ??!)। এর অর্থ দাঁড়ায় যে আমি এক করে দেখছি, আর তুমি তার জন্য আমাকে ভর্ৎসনা করতে ও গুঁড়ো করে দিতে প্রস্তুত। এর মানে কি ?

স্বাধীন প্রেম বলতে বুর্জোয়া নারীরা ৮নং থেকে ১০নং বিষয় বোঝে এই হলো আমার মতবাদ। তুমি কি এর অস্বীকার কর? তাহলে আমাকে বল বুর্জোয়া মহিলারা স্বাধীন প্রেম বলতে কি বোঝে ? তুমি আমাকে বলনি। সাহিত্য ও জীবন, এই দুটি জিনিসই কি প্রমাণ করে না যে, বুর্জোয়া নারীরা স্বাধীন প্রেম বলতে এই জিনিসই বোঝে? সম্পূর্ণভাবেই তা প্রমাণ করে। তোমার নীরবতা দ্বারাই তুমি এ কথা মেনে নিয়েছ। ঘটনা যখন এই- এই মেয়েদের শ্রেণী অবস্থা থেকে উদ্ভূত- তখন একথা ‘অস্বীকার করা অসম্ভব আর মুর্খামি।

তফাতটা পরিষ্কার করে বুঝতে হবে আর সর্বহারা দৃষ্টিভঙ্গিতে জিনিসটা অন্যরকম করে তুলে ধরতে হবে। বাস্তব ঘটনাগুলি বিবেচনা করে দেখতে হবে। তা না হলে ওরা তোমার পুস্তিকা থেকে উপযোগী অনুচ্ছেদগুলি তুলে নিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করবে। তোমার পুস্তিকাটি তাদেরই কলে তেল দেওয়ার কাজ করবে। তারা তোমার চিন্তাধারাকে শ্রমিকদের সামনে বিকৃত করবে। শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবে। তাদের মধ্যে এই ভয় জাগাবে যে, তুমি হয়তো তাদের মধ্যে কোনো বিরোধী ধারণা আনছ। আর এই নারীদের হাতেই আছে আজেবাজে খবরের কাগজ পত্রিকা ইত্যাদি।

আর তুমি বাস্তব ও শ্রেণীগত অবস্থা সম্পূর্ণ পরিহার করে আমাকে আক্রমণ করছ, স্বাধীন প্রেমের সঙ্গে ৮নং থেকে ১০নং বিষয় মিলিয়ে দিচ্ছি বলে আমার উপর দোষারোপ করছ। অবাক করলে, অবাক করলে……

‘এমন কি ক্ষণিকের অনুরাগ, অবৈধ প্রণয়ের অনুরাগও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অভ্যাসজনিত ‘প্রেমবিহীন চুম্বন’ বিনিময়ের চেয়ে বেশি ‘কবিত্বপূর্ণ ও নিষ্কলুষ’ তাই তুমি লিখেছ এবং তুমি এই কথা তোমার পুস্তিকায় লিখবে বলে প্রস্তাব করেছ। চমৎকার ! এভাবে উল্টো করে কথা তুলে ধরা কি ন্যায়সঙ্গত?

আরো পড়ুন:  নারী মুক্তি আন্দোলন প্রসঙ্গে

অভ্যাসবশত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে চুম্বন বিনিময় হয় তা অপবিত্র ! মানছি। উল্টো কথাটা তুমি কি বলতে চাও ? দেখা যাচ্ছে তাহলে প্রেমপূর্ণ চুম্বন না। তুমি উল্টো কথাটা বলছ ‘ক্ষণস্থায়ী’ (ক্ষণস্থায়ী কেন ?) ‘অনুরাগ’ (প্রেম নয় কেন ?)। এর থেকে এই দাঁড়ায় যে, প্রেমবিহীন চুম্বন যেহেতু ক্ষণস্থায়ী, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেমবিহীন চুম্বনের বিপরীত……অদ্ভুত।

তার চেয়ে একটি গণপ্রচার পুস্তিকায় প্রেমবিহীন দুষিত অপবিত্র মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী বা কৃষকদের বিবাহের পরিবর্তে সর্বহারার প্রেমপূর্ণ নাগরিক বিবাহ তুলে ধরাই কি ভালো হবে না। (আর যদি তুমি লিখতেই চাও তবে বলতে পার যে, ক্ষণিকের অবৈধ প্রণয় বা অনুরাগ দুষিতও হতে পারে পবিত্রও হতে পারে) ? (আবার নোটের ৬নং বা ৫নং বিষয় দেখ)।

তুমি একটার বিপরীত অন্য যেটা দেখাচ্ছ তা বিভিন্ন শ্রেণীর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদাহরণ নয়- ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা মাত্র- অবশ্য সেগুলিও ঘটতে পারে। কিন্তু বিষয়টি কি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা নিয়ে ? তুমি যদি তোমার বিষয়বস্তু হিসাবে বিবাহিতদের মধ্যে অপবিত্র চুম্বন এবং ক্ষণিকের অবৈধ প্রেমের পবিত্র চুম্বনের ব্যক্তিগত ঘটনা গ্রহণ কর তা হবে। একটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু (যেহেতু উপন্যাসের মধ্যে থাকে ব্যক্তিগত জীবনের বর্ণনা, চরিত্র বিশ্লেষণ, কয়েকটি বিশেষ ধরনের মনস্তত্ত্ব)- কিন্তু একটা পুস্তিকাতে ?

একজন সুযোগ্য প্রেমের পণ্ডিতের ভূমিকা গ্রহণ করা যে ‘মুর্খতা’ এ সম্বন্ধে এলেন কী—[১] এর অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতির বিষয় সম্বন্ধে আমার মনের কথা তুমি চমৎকার।

অনুধাবন করেছ। সত্যি। আর ‘ক্ষণিকের প্রেমের পণ্ডিতের ভূমিকা নেওয়া সম্পর্কে কি বলা হবে ?

আমি তর্কাতর্কি নিয়ে থাকতে চাই না। আমি বরং এই চিঠিটা রেখে দিয়ে আমাদের পরবর্তী সাক্ষাৎকারের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু আমি চাই যে, পুস্তিকাটি ভালো হোক, আর কেউ যেন তার থেকে তোমার নামে কোনো অবাঞ্ছিত উদ্ধৃতি তুলে ধরতে না পারে (অনেক সময় একটিমাত্র কথা এক ফোঁটা চোনার কাজ করে), যাতে তুমি যে কথা বলতে চাওনি, কেউ যেন তোমার মুখ দিয়ে সেই কথা না বলতে পারে।

আরো পড়ুন:  কামিনী রায় কবিতায় তুলে এনেছেন ব্যর্থতা ও হতাশার ভেতর জীবনের জয়গান

আমি নিশ্চিত জানি যে যা তুমি লিখেছ তা “কিছু মনে করে লেখনি” এবং আমি এই চিঠি তোমাকে পাঠাচ্ছি শুধু এই জন্য যাতে আমার এই চিঠির ফলে তুমি আমার পরিকল্পনা আরও বিশদভাবে চিন্তা করতে পার- যা কিনা আলোচনার পর অপেক্ষাকৃত ভালো হয়েছে, কারণ পরিকল্পনা হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

তুমি কি কোনো ফরাসি সোস্যালিস্ট মেয়েকে চেন ? তার কাছে ১নং থেকে ১০নং বিষয় এবং তোমার ক্ষণিকের প্রেম ইত্যাদির বিষয় বক্তব্য অনুবাদ করে শোনাবে (যেন ইংরাজি থেকে অনুবাদ করছ)। তাকে লক্ষ্য করে দেখবে ও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনবে। বাইরের লোকেরা কোন বিষয়ে কি মনে করে, তাদের মনে কি ছাপ পড়ে, এবং তারা পুস্তিকা থেকে কি আশা করে, তা জানলে একটু অভিজ্ঞতা হবে।[২]

টিকা:

১. এলেন কী একজন সুইডিস বিদুষী মহিলা (১৮৪৯-১৯২৬)। তিনি নারীদের প্রশ্নের উপর ও শিশু শিক্ষার উপর বই লিখেছিলেন এবং শ্রমিকদের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন।

২. লেনিনের এই প্রবন্ধটি কনক মুখোপাধ্যায় (সেপ্টেম্বর ২০০৬)। নারী মুক্তির প্রশ্নে, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড। পৃষ্ঠা ১০০-১০২ থেকে নেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!