ভারতের প্রায় সর্বত্র, বিশেষতঃ উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে মেদা লকড়ীর গাছ জন্মে। চির সবুজ পত্রাচ্ছাদিত গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ, সাধারণতঃ ২০। ২৫ ফুটের মতো উঁচু হয়, তবে কোনো কোনো স্থানের গাছ আরো লম্বা হতে দেখা যায়। পশ্চিম বাংলার কোথাও কোথাও ঝোপঝাড়যুক্ত বেশ লম্বা, আবার কোথাও-বা ছোট আকারের গাছ পরিলক্ষিত হয়। পাতার কোনটি লম্বাটে, কোনটি ডিম্বাকৃতি, ডালের দু’পাশে একটির পর একটি সাজানো থাকে। পাতা রোমহীন ও রোমশ দু’প্রকারেরই হয়, লম্বায় ৫ । ৬ ইঞ্চি, সুগন্ধযুক্ত। পাতা মচড়ালে বা থেঁতো করলে যে সুগন্ধ পাওয়া যায়, তা অনেকটা দারুচিনির গন্ধের মত।
গাছ কখনো কখনো বেশ মোটা হয়। গাছের ছাল সাধারণতঃ আধ ইঞ্চির মতো পুরু হলেও কম-বেশি প্রায়ই হয়ে থাকে। ছালের বর্ণ ধূসর-বাদামী, কালচে-ধূসর কিংবা বাদামী-লালচে। এর শুকনো ছালই বাজারে মেদা লকড়ী, মৈদা পকড়ী প্রভৃতি নামে বিক্রয় হয়। ছালে হালকা সুগন্ধ থাকে, তবে পুরাতন হলে সেটি ক্রমশঃ নষ্ট হয়। এছাড়া স্থান-বিশেষের গাছে বর্ণ ও গন্ধের তারতম্য কিংবা কম-বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বাজারে প্রাপ্ত ছালের অধিকাংশই আসে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলসমূহ থেকে।
এই গাছের কাঠ হরিদ্রাভ-ধূসর কিংবা ধূসর-বাদামী রঙের, বেশ শক্ত, নানাবিধ গৃহকর্মাদির কাজে ব্যবহৃত হয়। পাতার কোল থেকে পুষ্পদণ্ড বেরোয়, সেটি খুবই ছোট এবং পুষ্পদণ্ডের মাথায় ছাতার মতো ছোট ছোট হরিদ্রাভ বর্ণের ফুল ফোটে। মে-জুন মাসে ফুল ও তারপরে ফল হয়। ফল আকারে ছোট, গোলাকার, কালো কিংবা গাঢ় বেগুনী রঙের এবং সেটি খাওয়া যায়। বীজে একটা তীব্র গন্ধ থাকায় স্বাদ মোটেই ভাল লাগে না। এর থেকে এক প্রকার তেল পাওয়া যায়। বীজ থেকে গাছ হয়, আবার শিকড় থেকে কাটিং করেও হতে পারে ।
কুকুরচিতা বা মেন্দা-এর অন্যান্য নাম:
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম হলেও অধিকাংশ অঞ্চলে এটি মেদা লকড়ী, মৈদা লকড়ী, মেদাসক নামেই পরিচিত। বাংলায় এটির পরিচিতি মেদা লকড়ী ও কুকুর চিতা নামে। অবশ্য অঞ্চল, বিশেষে নামও বদলে যায়। যেমন মেদিনীপুরের কাঁথি অঞ্চলের বহু জায়গায় এই গাছটিকে পিপলাস গাছ বা পিপলাস পাতার গাছ বলা হয় । ঐসব অঞ্চলে ছালের চেয়ে পাতার ব্যবহারই অধিক। মেদা শব্দটি এসেছে ফারসী মাদা (স্ত্রী জাতি) শব্দ থেকে, তাই মেদা শব্দের অর্থ হলো—মৃদু, নারীসুলভ মৃদু, নিস্তেজ, ঢিলা প্রভৃতি। তাহলে যে লকড়ী বা কাঠ কিংবা ছাল নিস্তেজ, ঢিলা বা মৃদু। কাঠ অবশ্য বেশ শক্ত, তবে গাছের ছাল ততটা শক্ত নয়, সহজে ভেঙ্গে যায়। হয়তো-বা এজন্যই এই নামকরণ করা হয়েছে।
অন্য প্রজাতি:
এই গাছটির বোটানিক্যাল নাম Litsea glutinosa (Lour) Robinson, পূর্বে এটি নাম ছিল L. chinensis Lamk, L. sebifera Pers, Sebifera glutinosa Loui প্রভৃতি । এই গণের প্রায় ৪৩টি প্রজাতি ভারতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে আর একটি প্রজাতির গাছের ছালও মেদা লকড়ী নামে পরিচিত। সেটির বোটানিক্যাল নাম Litsea monopetala (Roxb.) Pers., পূর্বে এটির নাম ছিল Litsea polyantha Juss. এটিকে ভারতের যত্র-তত্র দেখা গেলেও হিমালয়-সংলগ্ন স্থান তরাই থেকে আসাম এবং অন্য পাহাড়ী জায়গায় অধিক পাওয়া যায়। এই প্রজাতিটির গাছের ছালেও মৃদু মিষ্টি সুগন্ধ আছে এবং পাতা মচড়ালে কিংবা থেঁতো করলে দারুচিনির গন্ধ পাওয়া যায়। দু’টি প্রজাতিতে সাদৃশ্য ও গুণগত মিল প্রচুর। গাছের শুকনো ছাল দেখে বোঝাই মুশকিল—কোনটা কোন গাছের। এটি পশ্চিম বাংলার কোথাও কোথাও দু’একটি পরিলক্ষিত হয় এবং তা বড় কুকুর চিতা নামেই পরিচিত। এগুলি সবই Lauraceae পরিবারের গাছ ।
কুকুরচিতা বা মেন্দা-এর ব্যবহার্য অংশের গুণ:
ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ— গাছের ছাল, মূল ও পাতা। এবারে মেদা লকড়ীর গাছের বিভিন্ন অংশকে কিভাবে রোগ-প্রতিকারে কাজে লাগানো যেতে পারে, সেটাই বলা হচ্ছে।
১. গাছের ছাল: স্বাদে কটু, তিক্ত ও কষায় রসযুক্ত, স্বভাবে উষ্ণ, স্নিগ্ধ, পিচ্ছিল, মৃদুধারক, কামোদ্দীপক, বিষম, শোথ ও বেদনানাশক, কফনিঃসারক, অগ্নিদ্দীপক, কফবাতঘ্ন, বলকর; এটি প্রবাহিকা, অতিসার, প্রমেহ, কামাবসাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য। মচকানো ব্যথা ও ফোলায় এবং বাতের ব্যথায় ছালের প্রলেপ (ঠাণ্ডা জলে বেটে ) অত্যধিক উপকারী। ছালের গুঁড়ো ক্ষতনাশক। বিছা ও বোলতার হুলের জ্বালায় এর প্রলেপ যন্ত্রণা ও ফোলা দুই-ই কমিয়ে দিয়ে বিষ নষ্ট করে। এর ছালে লাউরোটোনিন ট্যানিন ও এক প্রকার লালচে বাদামী রঙের ক্ষারীয় তত্ত্ব পাওয়া যায়।
২. মূল ও মূলের ছাল: স্বাদে মধুর ও তিক্ত, পিচ্ছিল, সঙ্কোচক, বাতপিত্তম, বলকর, শোথ ও বেদনানাশক, কামোদ্দীপক, ঋতুস্রাবক ও স্তন্যবর্ধক। এটি জ্বর, কুষ্ঠ, দাহ, ক্ষয়, কাসি প্রভৃতিতে ব্যবহার্য।
৩. পাতা: পিচ্ছিল, স্নিগ্ধ, শোথ ও বেদনানাশক ও বিষয়। পাতার মত ফুলের কুঁড়িও প্রায় একই রকম উপকারী।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র:
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সপ্তম মুদ্রণ ১৪২৬, পৃষ্ঠা, ১৭১-১৭৩।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি flowersofindia.net থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Thingnam Girija
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।