ভূমিকা: বিলেতী চাঁপা, ম্যাগনোলিয়া, উদয় পদ্ম (বৈজ্ঞানিক নাম: Magnolia grandiflora ইংরেজি: Magnolia, Bull Bag, Great Laurel, Lili Tree) Magnoliaceae পরিবারের Magnolia গণের বৃক্ষ।
উদয়পদ্ম বা হিমচাঁপা-এর বর্ণনা:
উদয় পদ্ম ছোট বা মাঝারি আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ। এই গাছ ঋজু বা সোজা, সরল শাখা হয় ও এদের বাকলের রং মসৃণ ধূসর।
পাতা সরল, একান্তর, দীর্ঘায়ত থেকে বিডিম্বাকার আকৃতির। পাতার দৈর্ঘ্য ১২-২৫ সেমি ও প্রস্থ ৬-১০ সেমি, পুরু এবং চর্মবৎ, পাতার উপরের অংশ উজ্জ্বল এবং চকচকে হয়, নিচের অংশ তামাটে বাদামী।
পাতার কুঁড়ি মরিচা বর্ণের ও রোমশ আবরণ দ্বারা বেষ্ঠিত যা পাতার ভাঁজে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। পুষ্প একক, উপশাখার প্রান্তে এবং ১৫ থেকে ২৫ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট।
বৃত্যংশগুলো বৃহৎ, দলসদৃশ। পাপড়ি বিডিম্বাকার, কেন্দ্রে এক গুচ্ছ ঘন রক্তবেগুনি বর্ণের পুংকেশর নিয়ে বিস্তৃত, প্রথমে উজ্জ্বল সাদা পরে ননী বর্ণের, মিষ্ট গন্ধ যুক্ত।
পুংকেশর অসংখ্য, মুক্ত, ১.২-২.০ সেমি লম্বা, পরাগধানীলগ্ন, হলুদ, অন্তর্মুখী। গর্ভপত্র অসংখ্য, ১.৫-৩.০ সেমি লম্বা, ১-২ টি ডিম্বক বিশিষ্ট।
ফল কম বেশী নিরেট ডিম্বাকার। বীজ ১.০-১.২ সেমি লম্বা, উজ্জ্বল লাল, বীজের ফিউনি সর্পিল ভেসেলের প্যাচ খুলে লম্বা হয়।
উদয়পদ্ম বা হিমচাঁপা বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী একটি সংরক্ষিত উদ্ভিদ।
এর সুগন্ধের কারণে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আমেরিকার আদি জন্মস্থানে গাছ বড় হলেও আমাদের দেশে ৬ থেকে ১০ মিটার উঁচু হয়। গাছের গড়ন হালকা ও কিছুটা লম্বাটে।
বংশ বিস্তার ও চাষাবাদ:
উদয় পদ্মের ফুল ও ফল ধারণ করে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। বসন্তের শেষভাগে ছোট ডালের মাথায় কলি ধরতে শুরু করে। হিমচাঁপার ফল ডিম্বাকার।
কিছুটা গোলাপি রঙের, ৮ থেকে ১০ সেমি লম্বা। ফল বীজে পরিপূর্ণ। হিমচাঁপার বৈজ্ঞানিক নামের দ্বিতীয়াংশের উৎপত্তি ল্যাটিন grandis থেকে যার অর্থ বড় আর flora মানে ফ্লাওয়ার বা ফুল।
ফুলের আকারের জন্য এমন নাম হতে পারে। দাবাকলম ও শাখা কলমের সাহায্যে এর বংশ বিস্তার ঘটে থাকে।
বীজ পাখিদের প্রিয়, পাখি ও অন্যান্য প্রাণির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। লবণাক্ত মাটি, বায়ুপূর্ণ সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাতেও এটি ভালো হয়। [১] ক্রোমোসোম সংখ্যা : 2n = ১১২, ১২৪ [২]
উদয়পদ্ম-এর বিস্তৃতি:
শুষ্ক পাহাড়ী এলাকা এদের জন্য উপযুক্ত স্থান। এদের আদি নিবাস আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল।
এটি মূলত আমেরিকার ফ্লোরিডা ও টেক্সাসের প্রজাতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের জাতীয় ফুল এটি।
সেখানে প্রায় প্রতিটি রাস্তা বা বাড়ির সামনে এই ফুলের গাছ আছে। এছাড়া পূর্ব হিমালয় থেকে চীনের দক্ষিনাঞ্চলেও জন্মে।
গ্রীষ্ম ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশিয়া, মেক্সিকো, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং মালয়েশিয়াতেও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে এই গাছ বাগান ও নগরোদ্যানের জন্য চাষ করা হয়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
হিমচাঁপা গাছের কাঠ ভারী ও শক্ত। আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। আমেরিকার গৃহ যুদ্ধকালে কনফেডারেট আর্মি হিমচাঁপাকে তাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে।
উদয়পদ্মের পাতা এবং ফুল থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। ফুলের তোড়া সাজাতে ফুল বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
এর কাঠকে অধৌত মন্ডে রুপান্তর করা যেতে পারে যা দিয়ে খেলনা, মুখোশ, ইত্যাদি তৈরী করা যায়।
জাতিতাত্বিক ব্যবহার:
পাতার চূর্ণ দাঁতের ব্যথায় আরাম পাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। শোনা যায় এর বাকল উদ্দীপক ও সুগন্ধিযুক্ত বলবর্ধক এবং ম্যালেরিয়া ও বাতজ্বরে ব্যবহৃত হয়। উদয় পদ্ম নগরের দূষিত আবহাওয়া সহিষ্ণু।
সংরক্ষণ ও অন্যান্য তথ্য:
বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৯ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) উদয় পদ্ম প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশে উদয় পদ্ম সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে শোভাবর্ধনের জন্য চাষাবাদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। [১]
তথ্যসূত্র:
১. এস কে দত্ত (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৯ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৪১৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. Kumar, V. and Subramaniam,, B. 1986 Chromosome Atlas of Flowering Plants of the Indian Subcontinent. Vol.1. Dicotyledons Botanical Survey of India, Calcutta. 464 pp.
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।