লি লিসান (১৮ নভেম্বর, ১৮৯৯ – ২২ জুন, ১৯৬৭) ছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথমদিকের সদস্য এবং ১৯২৮-৩০ সাল পর্যন্ত চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতা এবং পলিটব্যুরো সদস্য এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি সার্বিক, ব্যাপক অভিযানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের ডাক দেন। মাও সেতুং তার বিরোধিতা করেন। মাওকে সামরিক ক্ষমতা ত্যাগের নির্দেশ দেন। মাও সেতুং বরং বিপরীতে লি লিসানের অনুরাগী লিউ তে চাও-কে ‘ফু তিয়েন বিদ্রোহে’ পরাজিত করেন। লি লিসান কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে স্বতন্ত্র হতে চেয়েছিলেন এবং দলীয় সংকীর্ণতাবাদ দ্বারা তাড়িত হন। এর ফলে তিনি যে ভুল করে বসেন তা ‘লি লিসানের ভুল’ নামে পরিচিতি পায়। তিনি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার উপরে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে ব্যর্থ হন।[১]
লি লিসান ও তাঁর সহযোগীবর্গ চীনা বিপ্লবের অসম বিকাশ স্বীকার করেননি, তারা দাবি করে যে শহরের লড়াইয়ের সংগে গ্রামাঞ্চলে লড়াইয়ের, শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের সংগে কৃষক আন্দোলনের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই, যেহেতু সব লড়াই তীব্র হয়েছে। তারা আরও মনে করত যে কেবল বড় বড় শহরের অভ্যুত্থান দ্বারাই দেশব্যাপী বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানো যাবে এবং এক বা কয়েকটি প্রদেশে সাফল্য অর্জন করা যাবে। চীনা গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে কৃষকদের সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামের চূড়ান্ত ভূমিকাকে তারা লঘু করে দেখেছিল।[২]
তিনি ১৮৯৯ সালে হুনান প্রদেশের লিলিং-এ জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার নাম ছিল লি রংঝি। তার পিতা তাকে চিনা ঐতিহ্যবাহী কবিতা ও ধ্রুপদী সাহিত্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য চাংশায় যান এবং সেখানে ফার্স্ট নর্মাল স্কুলের ২৮ স্ট্রোক্স ডাকনামের এক ছাত্রের লেখা এক বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেখেন। তিনি সেই তরুণের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সেই তরুণটিই ছিলেন মাও সেতুং। লি পরে এক যোদ্ধাপ্রভুর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেই বাহিনীর এক কমান্ডার চেং কিয়ান তাকে বেইজিং-এ লেখাপড়ার জন্য পাঠান।
বেইজিং-এ পোঁছে তিনি ফ্রান্সে লেখাপড়ার জন্য দরখাস্ত করেন এবং ১৯২০ সালে ফ্রান্স পৌঁছেন। ফ্রান্সে চৌ এন লাই, লি ফু চুন, তেং ইং চাও-এর সাথে যুক্ত হয়ে চিনা ছাত্রদের সমাজতান্ত্রিক গ্রুপ গঠন করেন। ১৯২১ সনে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্যারিস শাখার প্রচার সম্পাদক হন।
দেশে ফেরার পর লি কিয়াংসিতে লিউ শাও চি’র সাথে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯২৬ সনে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পর বৎসর চেন তু শিউকে সমালোচনা করে নেতৃত্বে চলে আসেন। ১৯২৮ সালে তিনি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। লি লিসান ১৯৩১ সালে নেতৃত্ব থেকে অপসারিত হয়ে মস্কো যান। সেখানে ট্রটস্কির সমর্থন করায় গ্রেপ্তার হন। পরে মুক্ত হয়ে ফিরে এলে আবার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। তখন তিনি হন লিন পিয়াও-এর রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার পর, লি লিসান তাঁর সর্বাধিক বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রটিতে ফিরে গিয়েছিলেন; তাঁকে শ্রম ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শ্রম মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। লি তার পুরানো কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেন এবং শিল্পক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় কিছু পদক্ষেপ ও নির্দেশনা তুলে ধরেন, যা পরবর্তীতে মাও কর্তৃক অংশান স্টিল মিলের সংবিধান হিসেবে বলা হয়। একই সময়ে লি লিসান চীনা জনগণের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন (CPPCC) ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। কোরিয়ান যুদ্ধের সময় তাঁকে ভাইস-প্রিমিয়ার হিসেবে এ্যান্টি এয়ার ডিফেন্স কাউন্সিলে নিয়োগ দেয়া হয়, কেননা তাঁর মস্কোতে থাকাকালীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এন্টি এয়ার দক্ষতা ছিলো।
১৯৫৩-তে আবার পদচ্যুত হন। আত্মসমালোচনার পর ১৯৫৬-তে পুনরায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হলে কাং শেং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এবং লাল ফৌজের মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের কথা আসে। লির মৃত্যু সম্পর্কে রহস্য এখনও রয়েই গেছে। ২২ জুন, ১৯৬৭ তে তাঁর মৃত্যু হয়।[৩]
তথ্যসূত্র ও টিকা:
১. মাও সেতুং, ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ সালে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় স্কুলের উদ্বোধনী বক্তৃতা।
২. হো কান্-চি, চীন বিপ্লবের ইতিহাস; দ্বিজেন গুপ্ত অনূদিত, র্যাডিক্যাল, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১১, পৃষ্ঠা-১৩১-১৩২।
৩. এই লেখার কিছু অংশ সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে; স্বপ্রকাশ, ১ বৈশাখ, ১৪০২ কলকাতা; পৃষ্ঠা-১৭১ থেকে নেয়া।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।