ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (ইংরেজি: Historical Materialism) হচ্ছে মার্কসবাদের একটি প্রধান তত্ত্ব। এটিকে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাও বলা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে মার্কস ও তাঁর সহযােগীরা প্রমাণ করতে প্রয়াসী হন যে সমাজের বিবর্তন প্রত্যক্ষ কয়েকটি নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং শ্রমশক্তিসম্পন্ন মানুষই ইতিহাসের যথার্থ স্রষ্টা। এই তত্ত্বে দেখানাে হয়েছে যে উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তথা শ্রেণিসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে। তাতে পুরানাে উৎপাদন সম্পর্ক ভেঙে পড়ে এবং প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন উন্নত সম্পর্ক, যার সঙ্গে বর্ধিত নতুন উৎপাদিকা শক্তির সাযুজ্য থাকে।[১]
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যায়, মানুষের সামাজিক জীবনের ইতিহাসের মূল শক্তি হচ্ছে মানুষের জীবন ধারণের জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম। মানুষ তার জীবন ধারণ করে জীবন রক্ষার উপাদানসমূহ সংগ্রহ ও সৃষ্টি দ্বারা। এজন্য তার হাতিয়ার আবশ্যক। এই হাতিয়ার বা উপায়কে মার্কসবাদে উৎপাদনের শক্তি বা ‘ফোর্সেস অব প্রোডাকশন’ বলা হয়। উৎপাদনের উপায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক বা ‘প্রোডাকশন রিলেশনস’।[২]
প্রত্যয়টি সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্কের নির্দিষ্ট এক ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়ােগ বিশেষ। ‘ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি’ গ্রন্থের মুখবন্ধে মার্কস প্রশ্ন তােলেন যে কোন নীতি মানুষে-মানুষে সব সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে? উত্তরে তিনি বলেন যে, সব মানুষ একটাই যে লক্ষ্য অভিমুখে চলে, সেটা হলো জীবন ধারণের জন্য পণ্য উৎপাদন এবং তারপর উৎপন্ন বস্তুর বিনিময়। চিরন্তন সত্যের কিংবা সামাজিক সুবিচারের মধ্যে পরিস্ফুট চিন্তাভাবনা নয়, সমাজ বিবর্তনের প্রকৃত নিয়ন্তা হলো উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থা।
উৎপাদনের উপাদান দুটি প্রকৃতিদত্ত সম্পদ ছাড়াও উৎপাদনে শ্রম ও মানুষের কর্মদক্ষতা (আদিম সমাজে) এবং যন্ত্রপাতি থাকে, যাকে মার্কস উৎপাদিকা শক্তি (productive forces) আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু উৎপাদনে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের প্রশ্নও থাকে, যার নাম দিয়েছেন তিনি উৎপাদন সম্পর্ক (productive relations)। মানুষ ও বস্তুর (উৎপাদিকা শক্তি) সম্পর্ক মানুষকে দ্বিতীয় একটি সম্পর্ক অর্থাৎ মানষ ও মানুষ (উৎপাদন সম্পর্ক) সম্পর্কে নিয়ে যায়। প্রথমটির পরিবর্তন হলে দ্বিতীয়টিরও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
আদিম সমাজে উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তি ছিল সহযােগিতা। ইতিহাসের ধারায় আদিমকালের কোনও এক পর্যায়ে সমাজের কিছু মানুষ উৎপাদিকা শক্তি নিজেদের কুক্ষিগত করে। এই প্রক্রিয়া ক্রমে পুঁজিবাদের জন্ম দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠদের শ্রমের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠরা আধিপত্য শুরু করে। উৎপাদনে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে উৎপাদন সম্পর্ক দুটি পরস্পর বিরােধী শ্রেণির সংঘর্ষে পরিণত হয়।
সমস্ত উৎপাদনের যোগফলে রচিত হয় সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামাে, যে বস্তুগত ভিত্তির উপর অবস্থান করে আইন ও রাজনীতির অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের উপরিকাঠামাে। উৎপাদনের সেই ভিত্তি অনুযায়ী মানুষের রাজনৈতিক চেতনা গড়ে ওঠে। সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেটাকে তিনি নিম্নকাঠামাে বলেছেন, সেটাই ধর্ম, নৈতিকতা, আইন, রাজনীতি প্রভৃতি উপরিকাঠামাের প্রকৃত ভিত্তি। নিম্নকাঠামো উপরিকাঠামােকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। উপরিকাঠামাের উপাদানগুলি শাসক শ্রেণির স্বার্থ চরিতার্থ করে।
প্রাকৃতিক সম্পদের নতুন কোনও ব্যবহার কিংবা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যখন আবিষ্কৃত হয়, উৎপাদিকা শক্তি তখন সাবেকি উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়—বিশেষ করে সম্পদের মালিকানাগত বিষয়ে পুরানো আইনকানুন ও বিধিব্যবস্থা উন্নতিসাধনের পরিবর্তে মানুষকে শৃঙ্খলিত করে। তখন একটা সমাজ বিপ্লব ঘটে। ধরা যাক একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে জমি, যন্ত্রপাতি ও কৃষকের দক্ষতা উৎপাদনের মূল উপাদান। কৃষকদের সঙ্গে সঙ্গতিশীল সম্পর্ক থাকে ভূস্বামীদের। যদি সেখানে কয়লা বা লােহার খনি আবিষ্কৃত হয় তা হলে উৎপাদিকা শক্তি দেখা দেবে। উৎপাদন সম্পর্কেও পরিবর্তন হবে। তখন কৃষকের স্থান নেবে খনির শ্রমিক, শিল্পপতিরা নেবে ভূস্বামীর স্থান। পুরানাে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্থান নেবে নতুন ব্যবস্থা। তাতে সংঘর্ষ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।
মার্কস সমাজ বিবর্তনের ধারায় পাঁচ ধরনের আর্থনীতিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন: আদিম সাম্যবাদ, দাসমালিক, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক। আদিতে মানুষের অস্তিত্ব একেবারে প্রকৃতি ও পরিবেশ নির্ভর হওয়ার কারণে জীবিকার উপায়সমূহ যৌথভাবে ব্যবহার বা প্রয়োগ এবং তার ফলকে যৌথভাবে ভোগ করা ব্যতীত উপায়ান্তর ছিল না। মানুষের আদিকালের এই যৌথজীবন ও সমাজব্যবস্থাকে আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা বা পর্যায় বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এমন অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে না। অধিকতর স্বচ্ছন্দ্য জীবন যাপনের জন্য মানুষ জীবনধারণের উপায়সমূহকে ক্রমান্বয়ে উন্নত করে তোলে। উন্নততর উপায়সমূহ সকলের হাতে সমানভাবে না থাকার কারণে এরূপ উপায় বা শক্তির মালিকগণ এরূপ উপায় বা শক্তির অমালিকগণের চাইতে অধিকতর শক্তিমান হয়ে পড়ে। শক্তিমানরা শক্তিহীনদের তুলনায় উন্নততর উৎপাদনী উপায় প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহে সমর্থ হন। সংগৃহীত সম্পদকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বলে গণ্য করতে থাকেন।[২]
আদিম যৌথ বা সাম্যবাদী সমাজ ভেঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও তার মালিক এবং অ-মালিক তথা পরস্পরবিরোধী অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। মার্কসবাদী তত্ত্বে সমাজ বিকাশের এই পর্যায়কে দ্বিতীয় বা দাস পর্যায় বলে উল্লেখ করা হয়। এই দাসপর্যায়ের মূল বৈশিষ্ট্য এই যে, এই পর্যায়ে শক্তিমান শ্রেণী শক্তিহীন দাসদের মাধ্যমে জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রী,সম্পদ ইত্যাদি সংগ্রহ করত। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ছিল দাসভিত্তিক বা দাসদের শ্রমের শোষণভিত্তিক। এই দাস পর্যায় পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে একই সময়ে ছিল কি না এবং তার আয়ুষ্কালের পরিধি কোথায় কি পরিমাণ ছিল তা এখনো গবেষণা এবং তর্কসাপেক্ষ। তথাপি মার্কসবাদ দাসপর্যায়কে মানবসমাজের অতিক্রান্ত ইতিহাসের একটি সাধারণ পর্যায় বলে গণ্য করে।[২]
শস্য উৎপাদনের নতুনতর হাতিয়ারাদির উদ্ভাবন, দাসদের বিদ্রোহ এবং নতুন উৎপাদনে দাসব্যবস্থা ক্রমান্বয় প্রতিবন্ধক বলে বোধ হতে থাকা প্রভৃতির মাধ্যমে দাসব্যবস্থার স্থানে নতুন অপর একটি অর্থনৈতিক পর্যায়ের উদ্ভব ঘটে। এটি সমাজ বিকাশের ইতিহাসে তৃতীয় বা সামন্ততান্ত্রিক পর্যায়। এই পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে জমির শস্য এবং জমির উপর দখল সামাজিক জীবনের শক্তির আঁধার হয়ে দাঁড়ায়। জমির জবরদস্তি বা শক্তিমান মালিকরা সামন্তপ্রভু এবং গোড়াতে কৃষিতে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত কৃষকদের ভূমিদাস এবং পরবর্তীতে কৃষক বলে অভিহিত করা হয়। এই পর্যায়ও কোনো দেশে কিরূপ ছিল এবং এর কালপরিধি কি ছিল সে সম্পর্কে এখনো গবেষণা চলছে।[২]
সামন্ত যুগে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার সংঘটিত হয়। মাটির অভ্যন্তরে শক্তির আধার কয়লা উদঘাটিত হয়। দ্রব্যের উৎপাদন অধিকতরভাবে পণ্য উৎপাদন ও পণ্য বিনিময় তথা পণ্য বিক্রয়ের রূপ লাভ করতে থাকে। শহরকেন্দ্রিক এবং উন্নততর যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ প্রথমে ইউরোপে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে পুঁজিভিত্তিক যন্ত্রশিল্প তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক থেকে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে ঊনবিংশ শতকে প্রধান এবং প্রবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপ গ্রহণ করে। মানব সভ্যতার বিকাশের এই স্তরকে চতুর্থ তথা ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী পর্যায় বলে অভিহিত করা হয়। মার্কসবাদের মতে এর পরবর্তী বা পঞ্চম পর্যায় হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।[২] সমাজ বিবর্তনের বিশ্লেষণে নতুন যুক্তিবাদী ভাবনাচিন্তা অথবা ন্যায়নীতি ও সত্যের বিষয়ে নতুন কোনও প্রত্যয় সমাজ বিবর্তনকে প্রভাবিত করে না। কারণ সেগুলি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামাের অন্তর্গত।
দ্রষ্টব্য: উৎপাদন ব্যবস্থা, ভিত্তি ও উপরিকাঠামাে
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৮-৬০।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৮০-২৮১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।