উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া রীতির উপশ্রেণী চটকা গান (ইংরেজি: Chatka song) হচ্ছে এক প্রকার রঙ্গগীতি। এ গান চটুল এবং দ্রুত তালের, অর্থাৎ এই গান তাল-প্রধান। গ্রাম্য ‘চট’ (অর্থ তাড়াতাড়ি) শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গান্তর করে ‘চটকা’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এই ধরনের গানে যথেষ্ট হাস্যরসের উপাদান থাকে। চটকা গানের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, মনোমালিন্য, সন্তান-সন্ততি কামনা, সংসার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি বিষয় ব্যক্ত হয়। চটুল কথা বা চুটকি কথার জারকে জারিত উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া রীতির উপশ্রেণী হচ্ছে এই চটকা গান।
সুরে কথায় ও ছন্দের বিন্যাসে চটকা মানবিক আবেদন সহজেই সৃষ্টি করতে পারে। চটকা গান হালকা মেজাজের যদিও, কিন্তু বিষয়ে আছে এর বহুমুখীতা। আবার বহু বিষয়ের এই গান নিরাভরণ বা অলংকারের ঠাট ঠমক তেমন নেই। ভাওয়াইয়ার সারল্য এতেও দেখা যায়।[১]
লেখক আশুতোষ ভট্টাচার্য চটকা গানকে ভাওয়াইয়ার অধঃপতিত ধারা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘দৈনন্দিন জীবনের নিতান্ত লঘু বিষয় ইহার অবলম্বন। ইহাদের গীতিগুণ যাহাই থাকুক, কোনো সাহিত্যগুণ নাই’।[২]
একটি খুব জনপ্রিয় চটকা গান হচ্ছে আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান্দ’। বহুল প্রচারিত এই গানটি গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। বক্তব্য সাদামাটা কিন্তু অর্থহীন উচ্ছ্বাসবাচক শব্দের ব্যঞ্জনাই এই গানের বৈশিষ্ট্য। প্রতি পঙক্তির শেষে ধ্বনির এমন সুষম ব্যবহার কাব্যের ভাবোন্মোচনে অন্য মাত্রা সংযোজন করেছে। অন্য কোনো শ্রেণির গানে তা দুর্লভ। হাসির হালকা রসের গানে এই জাতীয় ধ্বনি মাধুর্য গান শেষেও শ্রোতার মনে অনুরণিত হতে থাকে। এখানেই চটকা গানের সাফল্যের চাবিকাঠি।
কয়েকটি চটকা গান
প্রেম জানে না প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁদ
প্রেম জানে না প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁদ
ও মোর জুড়িয়া থাকে মন।
কত দিনে বন্ধুর সনে হবে দরিশন বন্ধু হে।।
বন্ধু রে নদীর ওপার তোমার বাড়ি
যাওয়া আসা অনেক দেরী
যাব কি রব কি সদাই করি মানা
হাঁটিয়া যাইতে নদীর পানি
খ্যাক্লুম কি খুক্লুম কি খাল্লাও খাল্লাও করে রে
ও বন্ধু রে।।
বন্ধু রে একলা ঘরে শুইয়া থাকুম
পালঙ্ক উপরে মন মোর
আবিল বিলবিল করে।
পরত ফিরতে মরার পালং
কাররত কি কুররত কি
কারাল কারাল করে রে
হায় হায় নিদয়ার বন্ধুরে।।
ও বন্ধুরে
তোমার আশায় বসিয়া থাকিম
বটবৃক্ষের তলে, মন মোর
উড়াম পাইরাম করে
ভাদর মাইসা দেওয়া ঝড়ি
টাপ্পাস কি টুপ্পুস কি
ঝমঝমাইয়া পড়ে রে
হায় হায় প্রাণের বন্ধু রে।।
প্রেম জানে না রসিক কালাচাঁদ গানটি ইউটিউবে শুনুন
হাওয়া গাড়ী চলিয়া গেল, বন্ধু আইল কৈ
হাওয়া গাড়ী চলিয়া গেল, বন্ধু আইল কৈ,
জলপাইগুড়ির চিড়ামুড়ি গৌরীর হাটের দৈ,
খাবার বেলা মনে পড়ে গাে আমার চেংরা বন্ধু কৈ।
জলপাইগুড়ির রেশমী চুড়ি পয়সা পয়সা দাম,
তারই মধ্যে লেখা আছে আমার চেংরা বন্ধুর নাম।
ওকি হাওয়ার গাড়ী চলিয়া গেল, আমার বন্ধু আইল কৈ!
হাওয়ার গাড়ি চইলা গেল রে আমার বন্ধু আইল না, শিল্পী স্বপন বসুর কণ্ঠে ইউটিউবে শুনুন
ও মদনের মাও, আগুন জ্বালাও মশা মারি পােন্ পােন্ করে।
ও মদনের মাও, আগুন জ্বালাও মশা মারি পােন্ পােন্ করে।
মাছের মধ্যে মাছ সেনে ইলিসা সেনে মাছ।
ও তাের রুইওক পােচে কে?
চান্দা ধুতুরা মাচে সংসার রাইখছে।
ও মদনের মাও, আগুন জ্বালাও মশা মারি পােন্ পােন্ করে।
নারীর মধ্যে নারী সেনে ধওলা সেনে নারী,
ও তাের কালকে পােচে কে?
ঘ্যাগা আর কুজা নারী সংসার রাইখাছে।
ও মদনের মাও, আগুন জ্বালাও মশা মারি পােন্ পােন্ করে।
ডাইল পাক করো রে কাচা মরিচ দিয়া
ও বউ ডাল ডাইল পাক করো রে
ডাইল পাক করো রে কাচা মরিচ দিয়া,
হিদুল শুটকির বর্তা বানাও নিরলে বসিয়া,
ও বউ ডাল ডাইল পাক করো রে।।
ছােটো বউ চড়ায় ডাল মাঝলা বউ ঝাড়ে,
(হারে) বড়াে বউ আসিয়া কাঠি দিয়া নাড়ে।
ডাল পাক করো রে।
(আমার) শ্বশুর করে ঘুসুর-ঘুসুর ভাসুর করে গােসা,
(আজি) নিদয়া স্বামী এসে ধরল চুলের ঘােসা,
ডাল পাক করো রে।
(আমার) শাশুড়ি আছে, ননদ আছে, আছে ভাগনা-বউ,
এমন করে মার মারিল আইগ্যালাে না কেউ,
ডাল পাক কর রে।
‘ওরে পতিধন বাড়ি ছাড়িয়া না যান’, ‘পানিয়া মরা মোক মারিলু রে’, ‘ওরে কাইনের ম্যায়ার ঠসক বেশি/ ব্যাড়ায় শালী টাড়ি টাড়ি’ প্রভৃতি গান এই ধরনের অন্তর্ভুক্ত।
তথ্যসূত্র
১. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ৭২-৭৩
২. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর, প্রথম খন্ড, এ মুখার্জি এন্ড কোম্পানি প্রা. লিমিটেড, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৪৮১।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।