
উত্তরবঙ্গের অরণ্য প্রকৃতির গাম্ভীর্যপূর্ণ মৌনতা, নদনদীর ক্ষিপ্র গতি, সেখানকার মানুষের মন দ্বারা বাহিত হয়ে সুর তাল ছন্দ নিয়ে রূপ পেয়েছে ভাওয়াইয়া লোকগান (ইংরেজি: Bhawaiya song)। লেখক তপন রায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘উত্তরাঞ্চল বা উত্তরবঙ্গের ধারাগুলোর প্রধান ধারাটি ভাওয়াইয়া’।[১] ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতভেদ রয়েছে। ভাব (মনের অনুভূতি) ভাও+ইয়া; অর্থাৎ যে সমস্ত গানের মধ্য দিয়ে গহিন মনের অনুভূতি প্রকাশ করা হয় তাই ভাওয়াইয়া।
ভাওয়াইয়া গানের সুর চড়া এবং সেই সুরের মধ্যে অনেক ভাঁজ এবং কাজ পরিলক্ষিত হয়। উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুড়িগ্রাম, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও গোয়ালপাড়া জেলার অধিবাসীদের মধ্যে এ গানের প্রচলন দেখা যায়।
ভাওয়াইয়ার বিষয়বস্তু বা বিষয়শ্রেণি
ভাওয়াইয়া গান বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে চার ধরনের। এইগুলো হচ্ছে প্রণয়, চটকা, ক্ষীরোল, এবং ভাবপ্রধান। এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের কৃষিজীবী জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জীবন ও জীবিকাকে কেন্দ্র করে ভাওয়াইয়ার ভাগ করলে পাওয়া যায় গাড়িয়াল গান, মৈষাল বন্ধুর গান, এমনকি হাতির মাহুত বন্ধুর গান।
প্রণয়ের ভাওয়াইয়া
ভাওয়াইয়া গানের মূল বিষয় নর-নারীর প্রণয় বা রাগ অনুরাগ। প্রণয়ের বিচ্ছেদ জ্বালাই এতে অধিক রূপায়িত হয়। মৈশাল, গাড়োয়ান, মাহুত প্রমুখ এই প্রণয়গীতির নায়ক। এই ধরনের গানে নর-নারীর, বিশেষত নবযৌবনাদের অনুরাগ, প্রেমপ্রীতি ও ভালোবাসার আবেদন ব্যক্ত হয়। এরূপ গানের মধ্যে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘কোন দ্যাশে যান মইশাল বন্ধুরে’, ‘নউতোন পিরিতির বড় জ্বালা’ ইত্যাদি অধিক জনপ্রিয়।[২] একটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া হচ্ছে
‘তোর্ষা নদীর উতলি পাতালি কার বা চলে নাও।
নারীর মন মোর উতলি পাতলি কার বা চলে নাও।[৩]
চটকা গান
অপরপক্ষে চটকা এক প্রকার রঙ্গগীতি। এ গান চটুল এবং দ্রুত তালের, অর্থাৎ এই গান তাল-প্রধান। গ্রাম্য ‘চট’ (অর্থ তাড়াতাড়ি) শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গান্তর করে ‘চটকা’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এই ধরনের গানে যথেষ্ট হাস্যরসের উপাদান থাকে। চটকা গানের মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, মনোমালিন্য, সন্তান-সন্ততি কামনা, সংসার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি বিষয় ব্যক্ত হয়। চটুল কথা বা চুটকি কথার জারকে জারিত উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া রীতির উপশ্রেণী হচ্ছে এই চটকা গান।
সুরে কথায় ও ছন্দের বিন্যাসে চটকা মানবিক আবেদন সহজেই সৃষ্টি করতে পারে। চটকা গান হালকা মেজাজের যদিও, কিন্তু বিষয়ে আছে এর বহুমুখীতা। আবার বহু বিষয়ের এই গান নিরাভরণ বা অলংকারের ঠাট ঠমক তেমন নেই। ভাওয়াইয়ার সারল্য এতেও দেখা যায়। লেখক আশুতোষ ভট্টাচার্য চটকা গানকে ভাওয়াইয়ার অধঃপতিত ধারা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ইহাদের গীতিগুণ যাহাই থাকুক, কোনো সাহিত্যগুণ নাই’।[৫]
খিরোল গান
দীর্ঘ ও চটকা— এই দুই ধরনের গানের সুরের মিশ্রণে অপর এক ধরনের গানও প্রচলিত, যা খিরোল বা ক্ষীরোল গান নামে পরিচিত। এইরকম দুটি গানের উদাহরণ হচ্ছে ‘আমায় এত রাতে কেনে ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে’ এবং ‘কোন-বনে ডাকিলু কোকিলরে।’ একুশ শতকে খিরোল গান লিখেছেন শিল্পী সন্তোষ কুমার বর্মন।
ভাবগান
আধ্যাত্মিক চেতনাসমৃদ্ধ ভাওয়াইয়া গানও পরিলক্ষিত হয়, যেমন: ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’, ‘ছাড় রে মন ভবের খ্যালা’ ইত্যাদি। ভাওয়াইয়া গানের মূল উপজীব্য বিষয় প্রেম হলেও এর মধ্যে অধ্যাত্মবাদ, ভাবতত্ত্ব সব কিছুই মেলে।
আধ্যাত্মিক ভাব গানের ভেতরে বিশ শতকের দিকে ঢুকেছে পরলোক চর্চা। এই ধরনের গানগুলিকে বলা হয় ‘তুকখা’। এছাড়াও অধ্যাত্ম দর্শন কেন্দ্রিক রয়েছে খ্যাপা গান ও যুগীর গান।
ভাওয়াইয়ার সুরের ধারা
উত্তরবঙ্গের প্রধান সুরের কাঠামো বা ভাওয়াইয়া সুরের কাঠামো থেকে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের গান। অর্থাৎ ভাওয়াইয়ার মধ্যে অনেকগুলো উপধারা তৈরি হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানের সুর দুই প্রকার, দীর্ঘ সুরবিশিষ্ট ও চটকা সুরবিশিষ্ট। দীর্ঘ সুরবিশিষ্ট গানগুলো হচ্ছে ভাওয়াইয়া প্রণয় বা রাগ-অনুরাগের গান।
ভাওয়াইয়ার মধ্যে যেগুলি চটুল সেগুলিকে বলি চটকা। এগুলো হালকা চালের দ্রুত তালের গান।
এছাড়াও ভাওয়াইয়ার এই দীর্ঘ ও চটকা সুর থেকেই বের হয়ে এসেছে আরো কিছু সুরের ধারার গান। প্রধান দুটি ভাওয়াইয়ার সুরের উপধারা হচ্ছে খন গান এবং কুশাণ গান ইত্যাদি।
তবে পূর্ববঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের গানের মধ্যে সুরগত তেমন তফাৎ আমরা পাই না। উত্তরবঙ্গেও ভাটিয়ালি সুরের প্রচলন অনস্বীকার্য। এই অঞ্চলের গান সুরের আকুতি ফুটিয়ে তোলার জন্য ভাটিয়ালির মতো উচ্চগ্রামে গাওয়া হয় না। ভাটিয়ালিতে ব্যবহৃত খাম্বাজ রাগের ব্যবহার এই অঞ্চলের গানে আমরা দেখতে পাই কিন্তু তা কোমল নিষাদ স্বরটি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এই অঞ্চলের অধিকাংশ গান মধ্যমকে জান করে বা মধ্যমকে ‘সা’ করে পরিবেশন করা হয়ে থাকে—কথা ও সুরের আকুতিকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য। তাই উত্তরাঞ্চলের গানে মাঝ খাম্বাজের ব্যবহার লক্ষণীয়।[৪]
জনপ্রিয় কয়েকটি ভাওয়াইয়া গান শুনুন ইউটিউব থেকে নিচে ক্লিক করে
যন্ত্র ও অনুষঙ্গ
ভাওয়াইয়া গান করা হয় দোতারা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে। এই গান যারা করেন, তাঁদের ‘বাউদিয়া’ বলা হয়। অনেকে মনে করেন ‘বাউড়া’ বা বিবাগী শব্দ থেকে ‘বাউদিয়া’ শব্দের উৎপত্তি। আর ‘ভাব’ শব্দ থেকে এসেছে ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দটি। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ ভাওয়াইয়া গান জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁর কন্যা ফেরদৌসী রহমান এবং পুত্র মোস্তফা জামান আব্বাসীও এ গানের জনপ্রিয় শিল্পী।
এছাড়াও উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে আমরা পাই— দীঘলনাশা, পালাগান, জাগগান, মনসার গান, রাজবংশী সম্প্রদায়ের নিজস্ব কিছু আচার অনুষ্ঠানমূলক গান ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র
১. তপন রায়, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬০২-৬০৩।
২. সমবারু চন্দ্র মহন্ত, বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এসিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ১ মার্চ ২০১৫, http://bn.banglapedia.org/index.php?title=ভাওয়াইয়া
৩. চিত্তরঞ্জন দেব, বাংলার পল্লীগীতি, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ২০৯।
৪. তপন রায়, পূর্বোক্ত।
৫. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর, প্রথম খন্ড, এ মুখার্জি এন্ড কোম্পানি প্রা. লিমিটেড, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৪৮১।