সুরমা-মেঘনা নদী প্রণালী বাংলাদেশ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম নদী ব্যবস্থা

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদী প্রণালীর মধ্যে সুরম-মেঘনা নদী প্রণালী বা সুরমা-মেঘনা নদী ব্যবস্থা (ইংরেজি: Surma-Meghna River System) অন্যতম এবং এটি দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের একটি বৃহত্তম নদী ব্যবস্থা। পৃথিবীর বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির প্রায় কাছাকাছি স্থান এই নদী ব্যবস্থার উৎপত্তি স্থল এবং বাংলাদেশের প্রায় ৯০% পানি এই মেঘনা-সুরমা নদী ব্যবস্থা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। 

মানুষের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ামক হিসাবে নদীর নাম উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বড় বড় নদীগুলোর মধ্যে তিনটি বড় নদী বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহত্তম নদীমালা। তবে সব কয়টি বড় নদী এদেশে পরিণত অবস্থায় প্রবাহিত ফলে এদেশের সমভূমি গঠনে নদীগুলোর ভূমিকা সক্রিয়। নদীগুলোর প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং পরিণত অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থিত হওয়ায় নদীগুলো নিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। মেঘনা নদী বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী এবং পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি হিমালয় বহির্ভূত একটি নদী ব্যবস্থা। 

মেঘনা নদীর উৎপত্তি: মেঘনা মনিপুর রাজ্যের উত্তরদিকস্থ পর্বত থেকে উদ্ভূত হয়ে কিছুদুর পর্যন্ত নাগাপাহাড় ও মনিপুর রাজ্যের মধ্যে সীমারেখা রচনা করেছে। তবে বলা যায়, প্রকৃত পক্ষে মেঘনা আসামের নাগামনিপুর পাহাড়ে উৎপন্ন জলবিভাজিকার দক্ষিণ ঢালে বিদ্যমান বরাক নদীর অংশবিশেষ। পরবর্তীতে এটি ভৈরববাজারের কাছে মারকুলি নামক স্থানে মেঘনা নাম ধারণ করে এবং পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।

মেঘনা নদীর নামকরণ: মেঘনা নদীর নামকরণ নিয়ে গল্প কথা প্রচলিত রয়েছে। এতে বলা হয়- আকাশে মেঘ দেখা দিলে মেঘনা উত্তাল হয়ে যায়। এ সময় নৌযান চলাচল নিরাপদ নয়। তাই মেঘনা এর নামের ব্যাখ্যা দাড়ায় মেঘনা অর্থাৎ আকাশে মেঘ দেখা দিলে নাও ছাড়ো না। মেঘনা নামের এই কিংবদন্তী আজও মাঝি মাল্লাদের মনে সক্রিয়ভাবে জাগরুক রয়েছে (ওয়াজেদ)। 

মেঘনা নদী: উৎসস্থল থেকে মোহনা পর্যন্ত মেঘনা নদীকে নিম্নোক্ত ২টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা মেঘনার প্রথম অংশ এবং মেঘনার পরবর্তী অংশ। নিম্নে এগুলোর আলোচনা করা হলোঃ 

মেঘনার প্রথম অংশ: প্রথম অংশ বলতে বোঝায় মেঘনা উৎপত্তি লাভের পর সামান্য পথ অতিক্রম করা পর্যন্ত। অর্থাৎ বরাক নদী ভারতের আসামরাজ্যের কাছাড় জেলার শিলচরের নিকট থেকে পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়ে শ্রীহট্ট জেলার অমলশিদ নামক স্থানে দুটো ধারায় বিভক্ত হয়। এই ধারা দুটি নিম্নরূপঃ ক) সুরমা খ) কুশিয়ারা 

ক) সুরমা: সুরমা নদী পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে সিলেট শহরে প্রবেশ করে। এরপর উত্তর পশ্চিম ও পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে সুনামগঞ্জে আসে। এরপর দক্ষিণ-পশ্চিম হয়ে মদনার নিকট কুশিয়ারার সাথে মিলিত হয়। মেঘালয়ের মালভূমি থেকে উৎপন্ন অনেকগুলি নদী ও পানি প্রবাহ উত্তর দিক থেকে সুরমার সাথে মিলিত হয়। পূর্ব থেকে উত্তর দিকে এগুলো হলো- লুভা, হরি (কুশিয়া), গোয়াইন গাঙ্গ (চেঙ্গার খাল), পিয়াইন, বোগাপানি, যদুকাটা, সোমেশ্বরী এবং কংশ।

মোহনগঞ্জের দক্ষিণে মগরার নিকট সুরমা দুইভাগে বিভক্ত হওয়ার পূর্বে কংশ নদীর পানিকে ধারণ করে। পশ্চিমের এই নদীটির উপরের অংশ ধানু, মাঝের অংশ বাউলি এবং নীচের অংশ ঘোড়াউতরা নামে পরিচিত। এই প্রবাহধারা কুলিয়ার চর পর্যন্ত এসে মিলিত হয়। 

খ) কুশিয়ারা: বরাক নদীর দক্ষিণ অংশ কুশিয়ারা নামে পরিচিত। এটা উত্তরে মৌলভীবাজারের দক্ষিণে উলিবাজারে এসে ২ ভাগ হয়। বিভক্ত হওয়ার পূর্বে কুশিয়ারা নদী মনু নদীর পানিকে ধারণ করে। কুশিয়ারার বিভাগগুলি নিম্নরূপঃ 

আরো পড়ুন:  গঙ্গা নদী বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম আন্তঃসীমান্ত নদী

* উত্তরের অংশ বিবিয়ানা। 

* দক্ষিণের অংশ বরাক।

বিবিয়ানা কিছুদুর চলার পর কালনী নাম ধারণ করে। আজমীরিগঞ্জের নিকট কালনী সুরমার সাথে মিলিত হয়। কুশিয়ারার অপর অংশ বরাক নদী পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে আগত গোপলা এবং খোয়াই নদীর সাথে মিলিত হয় এবং এরপর মদনার নিকট সুরমায় পতিত হয়। 

মেঘনার পরবর্তী অংশ: সুরমা ও কুশিয়ারার দুই অংশ মিলিত হওয়ার পর আজমীরিগঞ্জের নিচে মেঘনা নাম ধারণ করে এবং পরবর্তীতে এই নদী হাওড় বেসিনে মিলিত হয়। এখানে পানি প্রবাহটি ২ ভাগে বিভক্ত হয়। 

ক) আপার মেঘনা 

খ) লোয়ার মেঘনা

ক) আপার মেঘনা: আপার মেঘনা কুলিয়ার চর থেকে ষাটনল পর্যন্ত অবস্থিত। এটি অপেক্ষাকৃত ছোট নদী। 

খ) লোয়ার মেঘনা: এই নদীটি ষাটনল এর নিচ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রশস্ততম নদী হিসাবে পরিচিত। লোয়ার মেঘনার সাথে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও গঙ্গার পানি এসে মিশেছে এবং এই প্রবাহ পরে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

মেঘনার শাখানদী: মেঘনার প্রধান প্রধান শাখা নদীগুলো নিম্নরূপঃ পাগলী, উর্বমদি, কাঁঠালিয়া, ধনালিয়া, ধনাগদা, মতলব।

মেঘনা এবং উপরোক্ত শাখানদীগুলির সাথে ত্রিপুরার পার্বত্য এলাকা থেকে কিছু প্রবাহ এসে মিলিত হয়। এগুলো হলো গোমতী, বালুঝুরি, হান্দাছড়া, হাওড়া, কুরিলিয়া, জঙ্গোলিয়া, সোনাইবুড়ি, সোনাইছড়ি, দুরদুরিয়া। এসব পাহাড়ী নদীগুলো মেঘনা নদীর কারণে যে আকস্মিক বন্যা হয় সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

মেঘনা নদীর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ: বরাক-মেঘনার দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০৪ কিমি। ভৈরববাজার ব্রীজের নিকট এর প্রশস্ততা .৭৫ কিমি। অপরদিকে ষাটনলের নিকট মেঘনার প্রশস্ততা ৫ কিমি। ষাটনল থেকে ১৬ কিমি দূরে গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র যমুনা মেঘনার সাথে মিলিত হয় তখন এর প্রশস্ততা দাড়ায় ১১ কিমি (বর্ষাকালে)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মেঘনার দক্ষিণভাগ পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলির একটি। 

সারনী ২.৪.১. সুরমা মেঘনা নদীর প্রকৃত দৈর্ঘ্য এবং অন্তর্ভুক্ত এলাকা (মাইল) নিম্নে (ছকের) মাধ্যমে উল্লেখ করা হলোঃ 

মোট দৈর্ঘ্যঅন্তর্ভুক্ত এলাকা (মাইলে)
মাইলকিমি 
৪১৬৬৬৯সিলেট- ১৮০ কুমিল্লা – ১৪৬ বরিশাল-৯০
উৎস: Statistical Yearbook, 2000.

এছাড়াও আপার মেঘনার দৈর্ঘ্য ৯৪৯.৩ কিমি এবং লােয়ার মেঘনার দৈর্ঘ্য ১৬০.৯ কিমি (হারুনুর রশিদ, জিওগ্রাফি অব বাংলাদেশ)।

মেঘনা নদীখাত: প্রাথমিক পর্যায়ে নদীখাত সংকীর্ণ ধরনের হলেও বার্ধক্য/পরিণত পর্যায়ে নদীখাত প্রশস্ত হয়। এক্ষেত্রে বলা যায়, মেঘনা নদীতে প্রশস্ত খাত দেখা যায়। এর প্রকৃত কারণ হলো উৎপত্তিস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন খাত অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়া। অর্থাৎ মেঘনা নদী একটি পরিণত পর্যায়ের নদী। 

মেঘনা নদীর পানিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যাবলী

পানিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বলতে সাধারণত পানির নির্গমন, পানি সমতল, লবণাক্ততা, বন্যা, অববাহিকার আয়তন ইত্যাদি বোঝায়। নিম্নে এগুলোর বর্ণনা করা হলো:

পানি নির্গমন: সুরমা নদীতে ১৯৫০ এবং ১৯৫৮ সালে পানির নির্গমন পরিমাপ করা হয় সর্বোচ্চ ৫৩০০৮ কিউসেক (১৫ আগষ্ট, ১৯৫৮) এবং সর্বনিম্ন ৪৮৭ কিউসেক (২১মার্চ ১৯৫৪)। অপরদিকে কুশিয়ারায় বর্ষাকালে ১৫০০০ কিউসেক পানি নির্গমন ঘটে। ভৈরববাজার ব্রীজের নিকট পানির নির্গমন পরিমাপ করা হয় প্রায় গড়ে ৭১০০ ঘনমিটার/সে (মে মাসের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত)।

সারনী: সিলেট স্টেশনে ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে সুরমা নদীর পানি নির্গমনের কালিক বন্টন (ঘন মিটার/ সেকেন্ড)

আরো পড়ুন:  হাড়ভাঙ্গা খাড়ি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আন্তঃসীমান্ত নদী
মাসনির্গমনের পরিমাণ
এপ্রিল২.৮৫৫
মে৬.৫৮৬
জুন৯.৩৫২
জুলাই১০.২৭৫
আগষ্ট১০.৩৩৩
সেপ্টেম্বর৯.২৩৫
অক্টোবর৭.৪৮৫
নভেম্বর৫.৬৯২
ডিসেম্বর৩.৯৬৯
জানুয়ারী২.৬৩৯
ফেব্রুয়ারী২.২৫৭
মার্চ৫.০৯০
বার্ষিক৭৫.৭৬৮
উৎসঃ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পানি বছর এপ্রিল-মার্চ)।

এছাড়া লোয়ার মেঘনা প্রতি বছর গড়ে ৮৭৫ মিলিয়ন একর ফুট পানি নির্গমন করে এবং আপার মেঘনা ৯২ মিলিয়ন একর ফুট (MAF) পানি নির্গমন করে।

পানি সমতল: ১৯৯৯ -২০০০ সালে যে তথ্য পাওয়া যায় সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, সেই বছর মেঘনা নদীর পানি সমতল এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ছিল। তবে সর্বনিম্ন মানও সে নদীতে ছিল। অর্থাৎ বলা যায়, ১৯৯৯-২০০০ সালে ভৈরববাজার স্টেশনে মেঘনা নদীর পানি সমতল এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ছিল। 

সারনী: মেঘনা ও সুরমা নদীর পানি তল এর পরিমাণ

নদীস্টেশনসর্বোচ্চসর্বনিম্ন
মেঘনাভৈরববাজার৪৯.৮০০.০০
সুরমাসিলেট১১.২৫২.২৫
উৎস: BWDB, Water year (April-March)

বন্যা: এই নদী ব্যবস্থায় বছরে ২ থেকে ৩ বার বন্যা হয়, যা সাধারণতঃ জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসসমূহে ঘটে থাকে। তবে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে মে মাস থেকে বন্যা হয় (সারণী)। 

সারণী: বন্যার সময় (দিন), বিপদসীমার পূর্বে ১৯৮৮

নদীস্টেশনজুলাইআগস্টসেপ্টেম্বরমোট
মেঘনাভৈরববাজার২৫১৩২৫৬৩
লোয়ার মেঘনাচাঁদপুর ২৬১৯৪৫
উৎস: Nizamuddin, K, (2001), Disaster in Bangladesh: Selected Readings.

প্রধান নদীর সাথে অনেক ছোট ছোট পাহাড়ী নদীর জলধারা এখানে মিলিত হয়। এ কারণে পাহাড়ী ঢল নামে এবং হঠাৎ বন্যা হয়। একে Flash Flood বা হড়কা বান বলে। মধুপুর গড় ব্যতীত প্রায় সমগ্র মেঘনা উপত্যকা বর্ষার সময় সম্পূর্ণ প্লাবিত হয় এবং প্রতি বছর এ অঞ্চলের মৃত্তিকার একটি করে নতুন পলির আস্তরণ পড়ে। 

পানির রাসায়নিক গুণাগুণ

সুরমা-মেঘনা নদী ব্যবস্থার পানির রাসায়নিক গুণাগুণ পর্যালোচনা করার জন্য ভৈরববাজার স্টেশনের পানিকে নমুনা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এখান থেকে পানির PH, CO2, CA, MG, CO3, HCO3, SO4, -এর মান বের করা হয়। নিম্নে (ছকের) মাধ্যমে দেখানো হলো: 

সারনী: সুরমা-মেঘনা নদীর রাসায়নিক মান 

নদীর নাম ও স্টেশনPhCO2CaMgCO3HCO3SO4ClSalinityTER
সুরমা-মেঘনা ভৈরববাজার মার্চ ১৯৮৩9.912.9411.008.212.3543.6337.736.9542.54280
উৎস: Technical Journal, River Research Institute (Faridpur), Vol. 02, No. 01, Jan. 1995.

সুরমা-মেঘনা নদীর উপরোক্ত সারণীতে প্রাপ্ত রাসায়নিক মান বিশেষত PH মান দেখে বলা যায় এ নদীর পানিতে ক্ষারকত্ব বেশি। এছাড়া পানি স্বচ্ছ প্রকৃতির। 

লবণাক্ততা: পদ্মার সাথে মিলিত হবার পূর্ব পর্যন্ত মেঘনা লবণাক্ত পানি বহন করে। নীলকমল, দৌলতখান, চাঁদপুর, ষাটনলে নদীর পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা করা হয়। সুরমা-মেঘনা নদীর পানি ভৈরববাজারে যে লবণাক্ততার পরীক্ষা করা হয় তার মান ৪২.৫৪। 

অববাহিকা আয়তন: মেঘনার অববাহিকা উপমহাদেশের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃষ্টিবহুল অঞ্চল এবং প্রবাহ মূলত বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। উৎস হতে মেঘনা অববাহিকার আয়তন ৬৪৭৫০ বর্গকিলোমিটার এর মধ্যে ২০৭২০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের অন্তর্গত।

সারনী: আপার মেঘনা এবং লোয়ার মেঘনার অববাহিকার আয়তন (মিলিয়ন একর) 

নদীঅববাহিকার আয়তন (মিলিয়ন একর)
আপার মেঘনা২০
লোয়ার মেঘনা৪১৬
উৎসঃ হারুনুর রশিদ, Geography of Bangladesh.

উপরোক্ত দুটি নদীর অববাহিকার আয়তন লক্ষ্য করলে খুব সহজেই বোঝা যায় আপার মেঘনা অপেক্ষা লোয়ার মেঘনা নদী বড় এবং প্রশস্ততম নদী। নদী দুটি বাংলাদেশে অন্তর্গত। এবং এই নদী দুটির অববাহিকার আয়তন তাই নাগা পাহাড় থেকে পরিমাপ করা হয়নি। বরং বাংলাদেশের কুলিয়ারচর থেকে পরিমাপ করা হয়েছে। 

আরো পড়ুন:  তিস্তা নদী হচ্ছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী

এক নজরে সুরমা-মেঘনার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহ

• মেঘনা একটি বৃহৎ নদী। এ নদীর উদ্যোমে এখনও ভাটা পড়েনি। সুরমা-মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা-গঙ্গার মিলিত স্রোতধারা এ নদীর সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ। 

• এ নদী বিপুল এলাকা দিয়ে প্রবাহিত। নদীটি ভাঙ্গন প্রবন।

• মেঘনার নীচের দিকে প্রচুর চর রয়েছে। মেঘনা অত্যন্ত গভীর ও নাব্য নদী, সারা বছর নৌ চলাচল করতে পারে। 

• ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত হওয়ার স্থানে দুই নদীর পানির রং এ সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। এখানে মেঘনার পানি

পরিস্কার নীলাভ সবুজ। আর ধলেশ্বরীর বাদামী (ওয়াজেদ)। 

• মেঘনার তীরে প্রসিদ্ধ স্থানগুলি হলো- সিলেট, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, ভোলা, চাঁদপুর, বরিশাল প্রভৃতি।

• উল্লেখযোগ্য নৌ ও বাণিজ্যবন্দর হলো- ভৈরববাজার, কুলিয়ারচর, কালুপুর, পুরাতন চাঁদপুর, মারকুলী, আজমীরিগঞ্জ, মদনা, বৈদ্যের বাজার, রামদাসপুর । 

• কুলিয়ারচর পৃথিবীর অন্যতম মৎস বাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা ও আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এ নদীর তীরে

অবস্থিত। 

মেঘনা নদী ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক ইস্যু

মেঘনা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীর উৎসস্থল ভারতে হওয়ায় এই নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান। ভারত মেঘনার উজানে আসামের বরাক ও তুইড়ী নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। ড্যামটির উচ্চতা ১৬১ মি ও দীর্ঘ ৩৯০ মিটার যাতে ১৫.৯ হাজার মিলিয়ন ঘন মিটার পানি মজুদ রাখা যাবে। এই পানি দিয়ে ভারত সেচ নৌ চলাচল ও শুকনা মৌসুমে পানি প্রবাহ বাড়ানোর কাজ চালাবে। 

ভারতের নদী সংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে বন্যা কমবে না বরং উল্টো হবে। বর্ষার সময় জলাধারে পানি আটকে দিলে বন্যার আশংকা কমবে না বাড়বে তা নির্ভর করবে সে বছরের বৃষ্টিপাতের উপর। বৃষ্টি বেশি হলে জলাধার চাপ সামলাতে পারবে না। তখন জলাধার বাচাতে বিপুল পরিমাণ পানি এক সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হলে মুহুর্তের মধ্যে ব্যাপক এলাকা তলিয়ে যাবে। 

এছাড়া ভূতত্ত্ববিদগনের মতে টিপাইমুখ বাধ এলাকা অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। এখানে বাধ দিয়ে তাই নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করা সমীচিন নয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এই এলাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানবে এবং ধ্বংসলীলা চলবে যার অনুমাণ ভবিষ্যতই।

আন্তর্জাতিক ইস্যুর সমাধান: উপরোক্ত সমস্যাগুলো শুধুমাত্র মেঘনা নদী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই নয় বরং তিস্তা, পদ্মা-যমুনার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। নদী ও দেশকে বাঁচানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেঃ 

• স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সরকারী ও বিরোধী দলের মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সম্পর্কে কল্যাণমুখী একমত পোষণ করা। 

• দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে পানি সম্পদ উন্নয়ন ও নদী ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

• নির্দিষ্ট সময় পর পর সারা দেশের নদী ব্যবস্থা পর্যবেক্ষন করতে হবে।

• স্থানীয় চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে নদী ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান। 

• নদীতে ধ্বংসাত্বক অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করার জন্য জনমত গড়ে তুলতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে এর স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। 

• আমাদের দেশের নদীগুলি প্রতিনিয়ত গতিপথ পরিবর্তন করে এবং নতুন পলল গঠন করে। এই অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার দ্বারা পলল ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!