শর্তহীন বিধান হচ্ছে বিশেষ করে দার্শনিক কান্টের নীতি-শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি কথা

শর্তহীন বিধান দর্শন (ইংরেজি: categorical imperative), বিশেষ করে দার্শনিক কাণ্টের নীতি-শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি কথা। কাণ্টের মতে নৈতিক জীবনে যে সমস্ত বিধান কার্যকরী সেগুলিকে শর্তসাপেক্ষ এবং শর্তহীন বলে বিভক্ত করা চলে। শর্তসাপেক্ষ বিধানের নিয়ামত হচ্ছে কোনো বিশেষ আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আমার সন্তানকে যদি আমি এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভালবাসি যে, সেও একদিন আমার বৈষয়িক জীবনে সাহায্যকারী হবে তা হলে সন্তানের প্রতি এই ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ ভালবাসা। ভবিষ্যতের প্রতিফলের আকাঙ্ক্ষাই আমার বর্তমানের ভালবাসার নিয়ামক। এখানে সন্তানের প্রতি ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ বিধানেরই একটি দৃষ্টান্ত। শর্তসাপেক্ষ বিধান একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র।

কাণ্টের মত অনুযায়ী মানুষের নৈতিক জীবনের নিয়ামক হবে শর্তহীন বিধান। শর্তহীন বিধান দ্বারা কাণ্ট এমন একটি বিধানকে বুঝাতে চেয়েছেন যে বিধান অপর কোনো লক্ষ্য অর্জনের উপায়মাত্র নয়, যে-বিধান নিজেই লক্ষ্য। পিতা যদি সুখশান্তি-সম্পদ অর্থাৎ কোনো প্রকার প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না করে তার সন্তানকে শুধু ভালবাসার জন্য ভালবাসতে পারে তবেই সে ভালবাসা অপর কোনো লক্ষ্যের উপায়মাত্র না হয়ে নিজেই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। আর এরূপ ভালবাসাই হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতার আদর্শ ভালবাসা। অনুরূপভাবে ব্যক্তি তার সমাজ জীবনে কেবল শর্তহীন বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে, শর্তসাপেক্ষ বিধান দ্বারা নয়।

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের যে-কোন কাজের পেছনেই একটি নীতি বা লক্ষ্য থাকে। সমাজে যে বিরোধ, বৈপরিত্য বা সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় তার কারণ ব্যক্তি নিজের স্বার্থসাধনের লক্ষ্যকেই চরম মনে করে। সমাজে যে অধকার সে নিজে ভোগ করতে চায় সে অধিকার অপরের প্রাপ্য একথা সে স্মরণ করে না। কিন্তু যে অধিকার ব্যক্তি নিজে ভোগ করবে সে অধিকার অপরকেও ভোগ করতে না দেওয়ার নীতি অযৌক্তিক।

মানুষ জীবন যুক্তিবাদী। তার পক্ষে অযৌক্তিক কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি তার যে-কোন সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে এমন নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে, যে নীতি শুধু তার নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; যে নীতি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে নীতি সার্বিক। যে ব্যক্তি চুরি করতে যাচ্ছে তাকে বিবেচনা করতে হবে, যে চুরির অধিকার সে ভোগ করতে যাচ্ছে সে চুরির অধিকার অপর সকলেরই আছে; সে মনে করবে যে মুহুর্তে অপরের দ্রব্য সে আত্মসাৎ করছে, সেই মুহূর্তে অপর সকলেও তার নিজের দ্রব্য কিংবা সকলেই সকলের দ্রব্য আত্মসাৎ করছে। এরূপ চিন্তায় ব্যক্তি তার আচরণের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যে নীতিকে সে সার্বিক নীতি হতে দিতে চায় না সে নীতিকে নিজেও পরিত্যাগ করবে। এমনিভাবে আদর্শ সঙ্গতিপূর্ণ সমাজ সৃষ্টি হবে।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে

কাণ্ট তাঁর শর্তহীন বিধান দ্বারা এক কল্পলোক বা ইউটোপিয়া তৈরীর চেষ্টা করেছেন। শর্তহীন বিধান দ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তি পরিচালিত হলে একটি আদর্শ সমাজের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তি কেন স্বার্থপর হয়, কেন সে নিজে যে অধিকার ভোগ করে অপরকে সে অধিকার দিতে চায় না এর কারণের কোনো বিশ্লেষণ কাণ্টের নীতিশাস্ত্রে নেই। ফলে, শর্তহীন বিধান একটি অবাস্তব ইচ্ছায় মাত্র পর্যবসিত হয়েছে।

নীতিশাস্ত্র মানুষের সামাজিক আচরণের আলোচনা। বাস্তব অর্থনীতিক ও সামাজিক অবস্থাই ব্যক্তির আচরণের নিয়ামক। কোনো বিশেষ সমাজের বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে ব্যক্তির আচরণের সঙ্গতি-অসঙ্গতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো চরম আদর্শ ব্যক্তির সামনে পেশ করা নিরর্থক। কাণ্ট তাঁর নীতিশাস্ত্রে এই সত্যকে অস্বীকার করেছেন।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!