বাংলাদেশে পুষ্পশিল্পের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ক্রমে শিল্পপণ্য উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে যাকে এখন পুষ্পশিল্প (floriculture industry) বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এ শিল্পের সর্বাধিক বিকাশ ঘটেছে নেদারল্যান্ড বা  হল্যাণ্ডে। হল্যাণ্ড প্রতি বছর ফুল ও সংশ্লিষ্ট দ্রব্য রপ্তানী করে বাংলাদেশী টাকায় পনের হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে যা বিশ্বের মোট রপ্তানীর এক পঞ্চমাংশ। হল্যাণ্ড নিজেদের উৎপাদিত এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানীকৃত আলংকারিক উদ্ভিদ অন্যান্য দেশে রপ্তানী করে। ফুলের মত দ্রুত পচনশীল দ্রব্যের এমন বৃহৎ একটি আন্তর্জাতিক বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে হল্যাণ্ডের আয়োজকরা অসাধারণ উদ্যোগ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে।

মাত্র ৪১ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন এবং দেড় কোটি লোকের ক্ষুদ্র এ দেশ ফুল রপ্তানী করে প্রতি বছর চমক লাগানো বিশাল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। হল্যাণ্ড একটি শীতপ্রধান দেশ যেখানে বছরের প্রায় পাঁচ মাস (নভেম্বর-মার্চ) আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে এবং শীতকালে তাপমাত্রা ৫ সেলসিয়াসের নিচে অবস্থান করে। প্রায় সারা বছরই সেখানে বৃষ্টিপাত হয়। এমন জলবায়ু সত্ত্বেও আলংকারিক উদ্ভিদ উৎপাদনে দেশটির এতো উন্নতি অবিশ্বাস্য মনে হয়। হল্যাণ্ডের বার্ষিক মোট রপ্তানীর পরিমাণ কমবেশি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটির এ সাফল্য বহু বছরের কঠোর পরিশ্রম ও বাস্তব পরিকল্পনার ফসল। হল্যাণ্ডে আলংকারিক উদ্ভিদের প্রায় সবটাই উৎপাদিত হয় কাঁচঘরের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। তাদের রপ্তানীকৃত পণ্য নিম্নোক্ত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত।

১. কাঁটা ফুল: গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, কার্নেশন, টিউলিপ, লিলি, ফ্রিসিয়া, জার্বেরা, সিম্বিডিয়াম, জিপসোফিলা, এ্যালস্ট্রোমেরিয়া এবং অন্যান্য।

২. টবের উদ্ভিদ (pot plants): ফাইকাস, Dracaena, Kalanchoe, Begonia, Rhododendron (Azalea), Chrysanthemum, Yucca, Saintpaulia, Poinsettia, Hedera ইত্যাদি।

৩. ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও কলম: নানাবিধ উদ্ভিদের চারা, শিকড়বিহীন ও শিকড়যুক্ত কলম, অঙ্গ ও কুড়ি সংযোজিত চারা এবং ডেকোরেশনের জন্য ব্যবহৃত উদ্ভিদ অঙ্গ এ শ্রেণিতে পড়ে।

আরো পড়ুন:  বেলী ফুল এশিয়া ও ইউরোপের জনপ্রিয় ভেষজ গুণ সম্পন্ন আলংকারিক উদ্ভিদ

উপরোক্ত পণ্যের এক বড় অংশ বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ থেকে আমদানী করে অন্যান্য দেশে রপ্তানী করা হয় (reexport). যেসব দেশ হল্যাণ্ডে আলংকারিক উদ্ভিদ রপ্তানী করে তার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, ইথিওপিয়া, থাইল্যাণ্ড, স্পেন, ইংল্যাণ্ড, জার্মানী, দক্ষিণ আফ্রিকা, কোস্টারিকা, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, ইকুয়েডর, মেক্সিকো, পেরু, মরক্কো, জাম্বিয়া, তানজানিয়া, আইভরিকোস্ট, ভারত, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি।

উপরোক্ত তথ্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশের পক্ষেও আলংকারিক উদ্ভিদ রপ্তানীকারক হওয়ার ভাল সুযোগ রয়েছে। রপ্তানীযোগ্য উদ্ভিদের অধিকাংশই আমাদের জলবায়ুতে স্বাভাবিক পরিবেশে ও অল্প খরচে জন্মানো সম্ভব। শ্রমিক মজুরী কম হওয়ায় আমাদের পক্ষে অন্যান্য রপ্তানীকারক দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব। রপ্তানীমুখী পুষ্পশিল্প গড়ে তুলতে হলে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন নিচে তা উল্লেখ করা হলো।

১. বিভিন্ন দেশ যেসব ফুল ও আলংকারিক উদ্ভিদ আমদানী করে তার পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন এবং আমদানীকৃত পণ্যের বৈশিষ্ট্য (জাত, বর্ণ, আকার ইত্যাদি) লিপিবদ্ধ করণ।

২. যেসব দেশ উপরোক্ত পণ্য রপ্তানী করে সেগুলোর উৎপাদন পদ্ধতি, গুণগত মান, প্যাকিং ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ।

৩. আলংকারিক উদ্ভিদ সম্বন্ধে গবেষণার জন্য দক্ষ জনশক্তি ও সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি।

৪. কোন কোন ফুল ও উদ্ভিদ রপ্তানীযোগ্য মান বজায় রেখে এবং অন্যান্য রপ্তানীকারক দেশের তুলনায় কম খরচে বাংলাদেশে উৎপাদন করা সম্ভব তা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে গবেষণা কর্মসূচী গ্রহণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুষ্পশিল্প সম্বন্ধে সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর সংগ্রহ এবং বিভিন্ন উদ্ভিদের নতুন ও জনপ্রিয় জাত এনে বাংলাদেশে প্রবর্তন।

৫. আলংকারিক উদ্ভিদ রপ্তানীর ব্যাপারে কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

৭. বাংলাদেশের সকল ফুল নার্সারীর একজন বা দুজন মালীকে রপ্তানীযোগ্য আলংকারিক উদ্ভিদের নাম, উৎপাদন পদ্ধতি, গুণাগুণ ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ প্রদান

৮. পুষ্পশিল্পের উন্নয়নের জন্য যা যা করণীয় তা নির্ণয় করে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন।

আরো পড়ুন:  কালা ডাঁটি ঢেকিয়া গ্রীষ্মমন্ডলী দেশের ভেষজ প্রজাতি

আলংকারিক উদ্ভিদ রপ্তানীর যোগ্যতা অর্জন করতে হলে প্রচুর অভিজ্ঞতা ও সময়ের প্রয়োজন। দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলে এক সময় সে যোগ্যতা অর্জন করা যাবে। এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করার কোনো সুযোগ নেই। এসব পণ্যের চাহিদা চিরকালই থাকবে।

তথ্যসূত্র:

১. ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ, ফুলের চাষ, দিব্যপ্রকাশ ঢাকা, দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ বইমেলা ২০০৩, পৃষ্ঠা ১২-১৩।

2 thoughts on “বাংলাদেশে পুষ্পশিল্পের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে”

  1. অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। আশা করি বাংলাদেশের জন্য এটি ভালো হবে।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!