দুধসর বা সেন্দ মনসা গাছের ঐতিহ্যবাহী দশটি ঔষধি গুণাগুণ এবং উপকারিতা

দুধসর বা সেন্দ বা মনসা বা সেন্দ মনসা বা সেহুন্দ মনসা (বৈজ্ঞানিক নাম: Euphorbia neriifolia) হচ্ছে ইউফরবিয়া গণের একটি উদ্ভিদ প্রজাতি। ঐতিহ্যবাহী চিকিতসায় মনসা গাছের ঔষধি গুণাগুণ, ব্যবহার এবং উপকারিতা আছে। বিভিন্ন রোগ প্রতিকারে এই গাছের ভূমিকা সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত প্রক্রিয়া উল্লেখ করা হলো।

আরো পড়ুন দুধসর একটি আলংকারিক ভেষজ উদ্ভিদ

প্রথমেই এটা জানা দরকার যে, মনসার ব্যবহার্য অংশগুলি কাজ করে আহারের দোষে বিকৃত পিত্ত যেখানে রসবহ স্রোতকে দূষিত করে যকৃৎ বা লিভারকে পীড়িত করে রক্তবহ স্রোতকেও দূষিত করায়; যার পরিণতিতে সমগ্র কলাংশ (Interior Smooth covering of the organs) রোগাক্রান্ত হয়।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে

দুধসর বা সেন্দ মনসা গাছের পাতায় করোনা সারছে বলে দাবি করেছেন কৃষিবিজ্ঞানী ড. এনায়েত আলী। বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসীরা সর্দি-কাশি ও জ্বরে এর ব্যবহার দীর্ঘকাল থেকেই করে আসছেন। ঔষুধী গুনসমৃদ্ধ এই গাছের পাতা কোভিড-১৯ জনিত করোনা ভাইরাসের নিউমোনিয়া সারাতে অধিক কার্যকরী। শুধু তাই নয়, যে কোন ধরণের ছত্রাকনাশক হিসেবেও কাজ করে।

নিয়মিত সাধারণ চিকিৎসার সাথে দুধসর গাছের পাতার রস খেতে হয়। এই রস খেয়ে দ্রুত কাশি কমতে থাকে। চার পাঁচ দিনের মধ্যেই রোগীরা সুস্থ হয়ে ওঠে।[১]

অন্যান্য চিকিৎসায় দুধসর

১. রসবাত: এই বাতগুলির লক্ষণ হলো গাটি ফুলে যায়, কনকন করে, শিরাগুলি মোটা হতে থাকে, তার জন্য যন্ত্রণা ও ব্যথা হয়; এক্ষেত্রে মনসার পাতাকে ঝলসে নিয়ে তার রস ২ থেকে ৩ ফোঁটা অল্প দুধে মিশিয়ে দু’বেলাই খেতে হবে, আর ঐ পাতা তেলে ভেজে, ঐ তেল লাগাতে হবে।

তেল তৈরির নিয়ম: মোটামুটি হিসেব হলো যদি তেল ১oo গ্রাম হয়, পাতা ১০০ বা ১৫০ গ্রাম নিতে হবে এবং ঐ পাতা টুকরো টুকরো করে ঐ তেলে ভেজে ও ছেঁকে নিলেই চলবে ; তবে তেল চড়িয়ে নিষ্ফেন হলে পাতা দিতে হবে। এর দ্বারা ঐ রস বাতটার উপশম হবে।

আরো পড়ুন:  ব্যবহার অনুসারে ঔষধি উদ্ভিদের বৈচিত্র্য

২. প্রমেহ রোগে: এই প্রমেহের প্রধান লক্ষণ প্রস্রাব করার পূর্বে অল্প কিছু ক্ষরণ হয় আর তার প্রধান উপসর্গ থাকে কোষ্ঠকাঠিন্য; এক্ষেত্রে মনসার ক্ষীর বা আঠা ৩ থেকে ৪ ফোঁটা নিয়ে বাতাসার মধ্যে পুরে খেতে হবে, এর দ্বারা ১৫ দ্বারা ২০ দিনের মধ্যে ঐ দোষটা চলে যাবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর হবে।

৩. সাপের কামড়: সাপে কামড়েছে কিনা জানা নেই। অথচ সেখানে জ্বালা করছে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের আওতায় আসার পূর্বে মনসা আঠা ১৫ থেকে ২০ ফোঁটা অল্প দুধে মিশিয়ে খাওয়ালে জ্বালাটা কমে যাবে। তবে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে।

৪. হুপিং কাসিতে: এমন কি ফেরিনজাইটিস হলে আগুনে সেঁকা মনসার পাতা হাতে চেপে রস করে সেই রসে একটু চিনি বা লবণ মিশিয়ে খেলে দুই বা তিন দিনেই উপশম হবে এবং ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে এই কাসির ধমকটা চলে যাবে; এর মাত্রা হলো পূর্ণ বয়স্কের এক বা দেড় চা চামচ ১০ থেকে ১১ বৎসর বয়স পর্যন্ত ৪০ থেকে ৪৫ ফোঁটা ৬ থেকে ৭ বৎসর বয়সের হলে ১০ থেকে ১৫ ফোঁটা আর তার কম বয়সের ৫ থেকে ৭ ফোঁটা অল্প দুধের সঙ্গে খেতে দিতে হবে।

৫. একজিমায়: এমন কি খোস পাঁচড়া এবং চুলকানি হলেও দুধসর গাছকে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হতো। গ্রামাঞ্চলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের পক্ষে করা সুবিধ হবে মনসা গাছের একটা বা দুটা ডালের পাতাগুলি যে পর্যন্ত আছে তার নিচে থেকে কেটে অর্থাৎ ডালের অগ্রভাগটা বাদ দিয়ে ঐ ডালের মাঝখানটায় গত করে ওর মধ্যে ৩ থেকে ৪ চা চামচ বাটা সরষে পুরে রেখে আসতে হবে। ১ দিন বাদে বা ২৪ ঘণ্টা পুনরায় ঐ ডালের খানিকটা অর্থাৎ যতটুকুর মধ্যে বাটা সরষে ভরা ছিল, সেই পর্যন্ত পুনরায় ঐ গাছ থেকে কেটে নিয়ে একটা হাঁড়ির মধ্যে মুখ বন্ধ করে পোড়া দিতে হবে। তার পরের দিন। ঐটাকে অর্থাৎ কালো কয়লাটাকে মিহি গুঁড়ো করে নিলেই তৈরী হলো ঔষধটা। সেই গুঁড়ো একটু নারকেল তেলে মিশিয়ে দিনে একবার করে লাগাতে হবে। ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই উপশম হয়। এছাড়া স্মুহীর কাণ্ডটার ক্বাথ দিয়ে সরষে তেল পাক করে লাগালেও কাজ হবে। তেলের ৪ গুণ কাণ্ড নিয়ে তাকে ৪ গুণ জলে সিদ্ধ করে একভাগ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে তেল পাক করতে হবে।

আরো পড়ুন:  অশ্বগন্ধা বাংলাদেশসহ এশিয়ার উষ্ণাঞ্চলের ঔষধি জাতীয় গুল্ম

৬. অর্শ: মলদ্বারে চোপসানো ছোট ছোট মটরের মতো দানা, রক্ত পড়ে না, এক্ষেত্রে শিকড় বাদে মনসা গাছের মূল গোড়ার অংশটা টুকরো টুকরো করে কেটে কাঁচা অবস্থায় লোহার কড়ায় রেখে পোড়াতে হবে; তবে এর সঙ্গে কিছুটা মনসার আঠা বা ক্ষীর মিশিয়ে দিতে হবে। ওটা জ্বলে কয়লা হয়ে গেলে সেইটাকে গুঁড়ো করে পোড়া ঘিয়ে মিশিয়ে মালমের মতো করে লাগাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে গাওয়া ঘি হলে ভালো হয়।

৭. আঁচিলে: উপরিউক্ত মলমটি লাগালে অচিলাটা মিলিয়ে যাবে।

৮. বিক্ষিপ্ত টাক (এলোপেসিয়া এরিয়েট): মাথায় এই টাক বিক্ষিপ্ত ভাবে হয়, এমন কি ভ্রুতে, গোঁফেও হতে দেখা যায়, এতে মনসার আঠা দিয়ে তৈরি তেল লাগালে সেরে যাবে।

তেল তৈরির নিয়ম: ২০ থেকে ২৫ গ্রাম তিল বা নারকেল তেল একটা লোহার হাতায় করে আগুনে চড়িয়ে, গরম হলে তার সঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম মনসার আঠা অল্প অল্প করে মিশিয়ে নাড়তে নাড়তে যখন ওটা চটচটে হয়ে যাবে, তখন ওটা নামিয়ে শিশিতে বা কোটাতে পুরে রাখতে হবে। যেখানে টাক হয়েছে কেবল সেখানেই লাগাতে হবে, তবে ১ দিন অন্তর; কিছুদিনের মধ্যেই ওখানে নতুন চুল বেরোবে।

৯. বেতো চুলে: মেয়েদের বেতো চুল এই চুলগুলি সাধারণত বেকে যায়, বাড়তে চায় না এবং একটা মোটা হয় সেই চুল তুলে ফেলার কুঅভ্যাসের ফলে মাথার তালু বা সিথি ফাঁকা হয়, এর জন্যে বিশেষ বয়েস অপেক্ষা করে না, সেক্ষেত্রে অল্প দিনেই আবার নতুন চুল বেরোবে মাথার ঐখানটায় মনসার আঠা দিয়ে তৈরী তেলটা ১ দিন অন্তর লাগতে হবে।

১০. শিশুদের চোখে পিচুটি পড়া: মনসার পাতায় কাজল তৈরি করে চোখে লাগালে ওটা যে সেরে যায় এটা সব মায়েদের জানা আছে।

সবশেষে একটা কথা দরকার, দুধসর গাছের পাতা ছাগলের প্রিয় খাদ্য এবং এটি খেয়ে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়। আরো শোনা যায় ভারতের রাজস্থানের কোনো কোনো সম্প্রদায় এর কচি পাতা সিদ্ধ করে জল ফেলে দিয়ে তার সঙ্গে লবণ, মরিচ, হিং প্রভৃতি মিশিয়ে মুখরোচক করে খেয়ে থাকেন।[২]

আরো পড়ুন:  সোনালু বা বান্দর লাঠি গাছের বারোটি ভেষজ ব্যবহার

মনসা গাছের রাসায়নিক গঠন:

(a) Euphorbin, euphorbon, euphorbia, (b) Resin. (c) Essential oil.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ  

১. সৌরভ হাবিব, ২৫ মে, ২০২১, “‘দুধসর’ পাতার রসে মিলছে করোনামুক্তি, দাবি কৃষিবিজ্ঞানী ড. এনায়েতের“, দৈনিক সমকাল, সারাদেশ পাতা, ঢাকা।
২. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ২০০-২০১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!