সুগন্ধি কেয়াকাঁটা-র আটটি ভেষজ গুণাগুণ ও প্রয়োগ

সুগন্ধি কেয়াকাঁটা গাছগলি সাধারণতঃ ১০। ১৫ ফুট লম্বা হয়, কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বেরোয়, পাতা লম্বায় ৫। ৭ ফুট হলেও কোথাও কোথাও ১০।১২ ফুট লম্বা হয়; চওড়া ২। ৩ ইঞ্চি হয়। পাতার কিনারা করাতের মত কাটা কাটা, দেখতে অনেকটা আনারস পাতার মত; তবে পাতার মাঝখানের মধ্য শিরাতেও করাতের মত কাঁটা থাকে।

গাছ পুরাতন হলে কাণ্ড থেকে নিচের দিকে বটের ন্যায় শিকড়ের ঝারি বেরোয়। কাণ্ড খুব শক্ত ও গোলাকার। একলিঙ্গ বিশিষ্ট ফলগুলি সাদা রঙের ও সুগন্ধযুক্ত। ফল ৭। ৮ ইঞ্চি লম্বা হয়, ফলের রঙ কমলা, পীত বা ধুসর বর্ণের হয়ে থাকে। একসঙ্গে ১৫। ২০টি ফল হয়, এগুলি খুব শক্ত এবং গোলাকার। সাধারণতঃ জ্যৈঠ-আষাঢ় মাসে ফল হয়, ফলে সুগন্ধযুক্ত ও সাদা রঙের; আনারসের মত লাল রঙের ফল হয় আশ্বিন-কার্তিক মাসে। স্ত্রী ফুল পুরুষ ফুলের চেয়ে আকারে ছোট হলেও অধিক সুগন্ধযুক্ত হয়।

বাংলায় এটিকে কেয়া, কেতুকী; হিন্দীতে কেওড়া, সংস্কৃতে কেতক, কেতকী বলে। এর বোটানিক্যাল নাম Pandanus Tectorius Soland. ex parkinson, পরিবার Pandanaceae. পূর্বে এর নাম ছিলো Pandanus Odoratissimus Roxb. ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ কাণ্ড, পুংপুষ্প দণ্ড ও বীজ।

সুগন্ধি কেয়াকাঁটা-র উপকারিতা

১. রেতঃ স্খলনে: মৈথুনকালে যাঁদের শীঘ্র স্খলন হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে কেতকীফলের পরাগ দুই বা তিন রতি মাত্রায় প্রত্যহ একবার (সে সকালে বা বৈকালে যখনই হোক) দুধসহ খেলে প্রত্যক্ষ ফল পাওয়া যায়।

২. লোলচর্মে: যাঁদের আমের ধাত তাঁদের চেহারাটা বেশ চকচকে এবং থলথলে হয়। তাঁরা কেতকী মূলের রস ১ চা-চামচ আধ কাপ জলসহ এবেলা ওবেলা খেলে ঐ থলথলে অবস্থাটা চলে যাবে। মূল ব’লতে যে অবরোহগুলি থাকে, আমরা তাকে কেয়ার ঝুরি বলে থাকি। অবশ্য এ রসটা বেশ কিছুদিন খেতে হবে।

৩. মেহ রোগে (স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই): যাঁদের পিপাসা লাগে আর ঘন ঘন জলও যেমন খেতে হয়, আবার বারে বারে প্রস্রাবও হয়। এদিকে জল না খেলেও শরীরে অস্বস্তি লাগে, মনে হয় যেন মাথাটা হালকা হয়ে গিয়েছে, হাত-পা ঝিমঝিম করার অনুভূতি হতে থাকে, জল খেলে সেটা আর থাকে না। এরা রাগান্বিত হলে অথবা অপ শ্রম করলে ঘাম হয় বিশেষতঃ মুখমণ্ডলে। এক্ষেত্রে কেতকী ফলের পাতা ২। ৩টি (ফলের বহিরাবরণ সাদা পাতা) থেতো করে ১০। ১২ ঘণ্টা এক কাপ বা এক গ্লাস গরম জলে ভিজিয়ে রেখে জলটা ছে’কে সেই জলটা খেতে হবে। এটার ব্যবহারে এই ধরনের মেহ নিরাময় হয়।

আরো পড়ুন:  জিকা, জিগা বা জিওল গাছের আটটি উপকারিতার বর্ণনা

৪. মূত্র সংবরণ গ্রন্থির ক্ষরণে: কোন কারণে যৌন সম্পর্কীয় মানসিক উত্তেজনা এলে অনেকের লালার মত ক্ষরণ হ’য়ে থাকে, এটা কারও কারও বা অল্প উত্তেজনাতেও হয় এবং সুপ্ত থাকলেও হয়। এক্ষেত্রে ওই কেতকীফুলের বহিরাবরণের সাদা পাতা একটি বা দুটি নিয়ে তাকে থেতো করে এক গ্লাস গরম জলে ১০।১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে সেটাকে ছেকে ওই জলটা সকালে ও বৈকালে দ’বারে খেতে হবে। এর দ্বারা অল্প উত্তেজনাজনিত ক্ষরণ আর হবে না।

সুগন্ধি কেয়াকাঁটা-র বাহ্য ব্যবহার

৫. নিদ্রাহীনতায়: আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে কেতকীমূলের ক্বাথ ও ওই মূলের কল্ক করে তিল তেলের সঙ্গে পাক করে সেই তেল মাথায় মাখলে গাঢ় নিদ্রা হয়; অবশ্য কোন বৈদ্য ভিন্ন এই তেল পাক করা সম্ভব নয়, সুতরাং এই যোগটি কাজে লাগাতে গেলে বৈদ্যেরই শরণাপন্ন হতে হবে।

৬. চোখ ঝাপসায়: কেতকীফুলের বহিরাবরণের একটি পাতার অর্ধেকটা নিয়ে থেতো ক’রে ১ গ্লাস গরম জলে রাত্রে ভিজিয়ে রেখে, পরদিন সকালবেলা ওই জলটা ‘ছে’কে নিয়ে চোখে ঝাপটা দিতে হবে। এটা কয়েকদিন দিলে ওটার উপশম হবে।

এখন সব ঝাপসার ক্ষেত্রটা তো এক নয়, যেমন ৪০ বৎসর বয়সের পর মানুষ চোখে ঝাপসা দ্যাখে; সেক্ষেত্রে তার বার্ধ্যকজনিত কারণ; কিন্তু যেখানে ঊধ্ব জগত শ্লেষ্মার বিকারে চোখে ঝাপসা দেখতে থাকে, মাথায় যন্ত্রণা হয়, সেখানেই এই কেতকী ফুলের যোগটি ফলপ্রদ। এদের চশমা নিলেও কিন্তু এই অসুবিধেটা যায় না। সর্বদা মনে হতে থাকে যে চশমা খুলে চোখটা মুছলেই বোধ হয় এই অসুবিধেটা চলে যাবে। সুতরাং কফবিকার নষ্ট করাটাই এখানকার চিকিৎসা। মোদ্দাকথা বলতে গেলে কেতকীপাতার কাজই হচ্ছে লেখনধর্মিতা।

৭. বিষাক্ত কীট দংশনে: কোন বিষাক্ত পোকা গায়ে বসলে আর তার লালা লাগলে, হুল ফোটালে শরীর বিষিয়ে ফুলে যায়, যন্ত্রণা হয়, এমন-কি ঘা পর্যন্ত হয়, তেমন বিষাক্ত কিছু লাগলে লাল হয়ে, ফুলে গিয়ে জ্বর পর্যন্তও ঘটায়। এক্ষেত্রে কেতকীমূল বেটে অল্প গরম করে লাগিয়ে দিলে ওই বিষনিটা কেটে যায়, সেটা আর ছড়িয়ে পড়ে না।

আরো পড়ুন:  ক্ষুদিজাম বাংলাদেশের বনাঞ্চলে জন্মানো ভেষজ বৃক্ষ

৮. খুস্কিতে: যাঁদের মাথায় মরামাস, মামড়ি ওঠে, উকুন, মাথার চুলে দগন্ধ হয়ে যায়, সেই সময় কেতকী ফুলের পাতা বেটে মাথায় মেখে ঘণ্টাখানেক বাদে স্নান করে ফেলতে হবে। এর দ্বারা উপরিউক্ত অসুবিধেগলি চলে যাবে।

CHEMICAL COMPOSITION

Pandanus tectorius

1. Essential oil containing 70% methyl ether of B-phenylethyl alcohol. 2. Blossoms yield essential oil (0.1-0.3%) containing . (a) benzyl benzoate, (b) benzyl salicylate, (c) benzyl acetate, (d) benzyl alcohol, (e) geraniol, (f) linalool, (g) linalyl acetate, (h) bromostyrene, (i) guaiacol, (j) phenylethyl alcohol, (k) phenyl ethyl aldehyde.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৩, পৃষ্ঠা, ৪০-৪২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!