মেহেদি বা মেহেন্দি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Lawsonia inermis Linn. এবং এই গাছের পরিবারের নাম লিথ্রাসি (ইংরেজি: Lythraceae)। সর্বজন পরিচিত এই মেহেন্দি গাছটিকে সাধারণত বেড়ার ধারে লাগানো হয়। ঔষধার্থে ব্যবহার করা হয় এদের ফুল, ফল, পাতা ও মূল।
মেহেদি পাতার ভেষজ গুণাগুণ এবং উপকারিতা
জণ্ডিস বা কামলা রোগ- আঙ্গুলের মতো মোটা মেহেদি গাছের মূল (কচি হলে ভাল হয়) অর্ধকুটিত (আধকুটা) আতপচাল-ধোয়া জল দিয়ে ঘষে (চন্দন পাটায় ঘষলে ভাল হয়) ২ চা-চামচ আন্দাজ নিয়ে ৮ থেকে ১০ চামচ ওই চাল-ধোয়া জলে মিশিয়ে সকালে ও বিকালে দুইবার খেতে হয়। এইভাবে ৪ থেকে ৫ দিন খেলে আরোগ্য হয়। এই টোটকা ঔষধটি খাওয়ার কালে ডাবের জল বা আখের রস (ইক্ষু রস) খেলে ভাল কাজ হয়। এটি উড়িষ্যার একটি সিদ্ধফল টোটকা ঔষধ। এটি কিন্তু পুর্ণবয়স্কের মাত্রা দেওয়া হলো।
১.শুক্র মেহ রোগে: মেহেদি পাতার রস এক চামচ দিনে দুইবার জল বা দুধ এবং তার সঙ্গে একটু, চিনি মিশিয়ে খেলে ১ সপ্তাহের মধ্যে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
২. শ্বেত প্রদর: উপরিউক্ত নিয়মে ব্যবহার করলেও উপশম হয়। এর দ্বারা যদি কোষ্ঠকাঠিন্য আসে তবে কোষ্ঠ পরিষ্কারক যেমন ঈসবগুলের ভূষি খাওয়া ভাল।
৩. নখরঞ্জিকায়: এই গাছের পাতার রস নখে লাগালে চোখ ও চুল ভাল থাকে। এ কথাটা আবহমান কাল প্রচলিত। দ্বিতীয় কথা—এটা তো সেই আমলের ‘নেল পালিশ’।
৪.হিমোগ্লোবিন: শরীরে রক্তকণিকা কমে গিয়েছে না ঠিকই আছে, এটা বিচার করেন মেহেদি পাতার রস হাতের তালুতে লাগিয়ে রাখলে; হিমোগ্লোবিন যদি ভালই থাকে তা হলে রঙটা লালচে আভা দিকে থাকে; নইলে নয়। এটি এখনও রাজস্থানের প্রাচীনপন্থি বৈদ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত।
৫. কাধের ব্যথা: মেহেদি পাতার রস ও সরষের তেল মিশিয়ে ঘাড়ে মালিশ করলে ব্যথা কমে যায়। এমনকি গরুর ঘাড়ে ব্যথা হলে এই গাছের পাতা বেটে গরম করে লাগিয়ে থাকেন দেশগাঁয়ের লোক।
৬. নখেকুনি ও হাত-পা হাজায়: এই পাতার ক্বাথ একটু, ঘন করে দিন দু’বার লাগাতে হয়।
৭. চুল উঠে যাওয়া ও পাকায়: হরীতকী ১টি ও মেহেদিপাতা ১ তোলা মতো একটু থেতো করে আধ পোয়া জলে সিদ্ধ করে আধ ছটাক মতো থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে ঠাণ্ডা হলে সপ্তাহে ২ দিন মাথায় লাগাতে দিয়ে থাকেন ইউনানি চিকিৎসক সম্প্রদায়। আমি মনে করি এর সঙ্গে কেশতের পাতা (যার চলতি নাম কৈশত) (Eclipta alba) ২।১ তোলা ক্বাথ করার সময় ওর সঙ্গে দিলে আরও ভাল হয়।
৮. শ্বেতপ্রদরে (Leucorrhoea): দুই তোলার মতো (২৫ গ্রাম) মেদিপাতা সিদ্ধ করে সেই জলে উত্তরবস্তি দিলে (ডুস দেওয়া) সাদাস্রাব ও অভ্যন্তরের চুলকানি (Itching) প্রশমিত হয়। তার সঙ্গে অনেকে ঐ পাতার রস দিয়ে তৈরী তেলে গজ বা তুলো ভিজিয়ে পিচু ধারণ (Plugging procedure) করতে দিয়ে থাকেন; এর দ্বারা (এই পদ্ধতিতে ব্যবহারে) স্রাব বন্ধ হয় এবং অভ্যন্তরভাগের রোগও আরোগ্য হয়; অধিকন্তু যোনির শিথিলতাও অপেক্ষাকৃত কমে যায়।
৯. স্থানভ্রষ্ট জরায়ু (Displacement of the uterus): উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রয়োগ করলে ওটির অসুবিধাও কমে যায়।
১০. হাত-পায়ের জ্বালায়: টাটকা পাতার রস হাতে-পায়ে লাগালে জ্বালা কমে যায়; এর সঙ্গে পিত্তবিকৃতিও যাতে দূর হয় সেইমত ঔষধও ব্যবহার করা উচিত।
১১. বসন্ত রোগে: পায়ের তলায় পাতা বাটার প্রলেপ দিলে চোখে গুটি বেরোয় না। দেশগাঁয়ের বসন্ত চিকিৎসকদের একটি প্রক্রিয়া।
১২. মরামাস ও খুসকি: সে যেখানেই হোক না কেন, এই পাতার কাথ লাগালে কমে যায়।
১৩. পায়োরিয়ায়: পাতার ক্বাথে অল্প খয়ের মিশিয়ে দাঁতের গোড়ায় লাগাতেন বৃদ্ধ বৈদ্যরা; তবে দাঁতে দাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। সেটা অবশ্য কিছুদিন বাদে উঠে যায়।।
১৪. মুখে ও গলায় ক্ষত: পাতাসিদ্ধ জল মুখে খানিকক্ষণ রাখতে হয়, যাকে বলে কবল ধারণ করা; এর দ্বারা এই দুটো সেরে যায়।
১৫. শরীরের দুর্গন্ধে: গ্রীষ্মকালে যাঁদের ঘাম বেশি হয়ে গায়ে দুর্গন্ধ হয় তাঁরা বেণামূল (Vetiveria zizanioides) ও মেহেদি পাতা সিদ্ধ জলে স্নান করলে উপকার পাবেন।
১৬. নাড়ীব্রণে (sinus): মেহেদি পাতা ও নিসিন্দার (vitex nigundo) পাতা বেটে তিলের তেলের সঙ্গে পাক করে ছেঁকে নিয়ে, সেই তেল লাগালে অনেক ক্ষেত্রে সেরেও যায়।
১৭. কানের পুজ: পাতার রস গরম করে ২ ফোঁটা করে কানে দিলে ৪। ৫ দিনে পুঁজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়; আবার অনেকে এই পাতার রস দিয়ে তৈরী তেলও ব্যবহার করতে দিয়ে থাকেন।
১৮. চোখ ওঠায় (নেত্রাভিষ্যঙ্গে): অল্প কয়েকটা পাতা থেঁতো করে, গরমজলে ফেলে রেখে সেটা ছেকে সেই জল চোখে ফোঁটা দিলে সেরে যায়। এমন কি যাঁদের চোখের কোণ থেকে পুজের মত পড়তে থাকে, এর দ্বারা সেটাও সেরে যাবে।
১৯ লোলচর্মে: যাঁদের গায়ের বা মুখের চামড়া কুচকে ঢিলে হয়ে গিয়েছে বা ঝুলে গিয়েছে, তাঁরা এই পাতার রস দিয়ে তৈরী তেল মাখলে (মুখের ক্ষেত্রে ঘৃতও মাখা যায়। অনেকটা স্বাভাবিক হবে।
২০. অনিদ্রায়: মেহেদি ফুলের বালিশ করে নবাব বাদশাদের ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করতেন ইউনানি চিকিৎসকগণ। এর ফুলে আছে লাইলাকের (আধুনিক এক প্রকার প্রসিদ্ধ গন্ধ) গন্ধ।
রাসায়নিক গঠন:
(a) Essential oil.
(b) Glycoside.
(c) Colouring matter viz. 2-hydroxyalphna
phthoquinone.
(d) Other constituents viz. hennotannic acid and fatty alcohols.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা,১৮৪-১৮৬।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।
এই গাছ আমার পছন্দের। বিবরণ দিয়ে ভাল করেছেন।
ধন্যবাদ, খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছেন। পড়ে ভাল লাগল।