পুনর্নবা লতা বহুবর্ষজীবী ভেষজ গুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ

পুনর্নবা লতা বা পূনর্ণভা বা গন্ধপূর্ণ বা পুনর্ণবা বা রক্ত পুনর্ণবা (বৈজ্ঞানিক নাম: Boerhaavia diffusa) নিকটাগনিয়াসি পরিবারের বোয়েরহাভিয়া গণের বহুবর্ষজীবী লতানো বা আরোহী বীরুৎ।[১] এদের পাতা ও ডাঁটা লালচে, এমনকি ফলও লালচে হয়। ঘন শাখাযুক্ত লতানো গাছ, শিকড় মোটা, মূল শিকড় বেশ শক্ত। লতাটির প্রত্যেক শাখাসন্ধিতে জোড়া জোড়া ডিম্বাকৃতি পাতা হয়।[২] বা পুনর্ণভা বা পুনর্নবা একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ। এদের অনেক ভেষজ গুণ রয়েছে এবং নিম্নে এই লতাটির রোগ প্রতিকারে ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।

পুনর্ণবা একটি ঔষধি লতা

১. পুরাতন বাত ও কাসি: এই কাসির বৈশিষ্ট্য হলো কফ ওঠে না অথচ কাঁসি হতে থাকে, এক্ষেত্রে পুনর্নবার রস ৪ চা চামচ গরম করে সেই রস সকালে খেতে হয়, এটা বিকেলেও একবার খেলে ভালো হয়। এটাতে কয়েকদিনের মধ্যে নিরাময় হবে।

২. শুক্রতারল্য: আসন্ন যৌবনের পথে একটু হাঁটার পর স্বকৃত দোষে যদি এই অসুবিধেটা আসে, তাহলে এই পাতার রস উপরিউক্ত মাত্রায় দু বেলা একটু গরম করে খেতে হবে। তা হলে ঐ আসুবিধেটা চলে যাবে।

৩. অশ্মরী রোগ (Calculi): মূত্রথলীতে পাথুরী হলে শুকনো পুনর্নবা লতা ১০ থেকে ১২ গ্রাম, জল ৫ থেকে ৬ কাপ দিয়ে সিদ্ধ করে ২ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ ক্বাথটা সকালে ও বিকালে দু’বারে খেতে হবে।

৪. শোথে: সে হৃদরোগজনিতই হোক আর মূত্রকৃচ্ছ্রতাজনিতই হোক, সেক্ষেত্রে মূলে সমেত সাদা পুনর্নবা লতা ২৫ গ্রাম আর আদা ৩ থেকে ৪ গ্রাম একসঙ্গে ৩ থেকে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সকালে ও বিকালে দু’বারে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ ফুলা কমে যাবে।

৫. ইঁদুর বা ক্ষ্যাপা কুকুরের কামড়: পুনর্নবার মূল আন্দাজ ১০ থেকে ১২ গ্রাম ও শোধিত ধূতরার বীজ মাত্র দুটি দুধে সিদ্ধ করে, সেটা রোদে শুকিয়ে নিলেই শোধন করা হবে। তারপরে একসঙ্গে বেঁটে খাইয়ে দিতে হবে। তবে এই শোধিত বীজ কোনো বৈদ্যের কাছ থেকে সংগ্রহ করা উচিত।

৬. বেতালা নেশায়: মদের নেশা, আর তাল সামলানো যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে মূলে সমেত পুনর্নবার রস ৭ থেকে ৮ চা চামচ, একটু গরম করে তার সঙ্গে ৭ থেকে ৮ চা চামচ, দুধ ও ৩ থেকে ৪ চা চামচ গাওয়া ঘি মিশিয়ে খেতে দিলে ঐ নেশা ছুটে যাবে।

আরো পড়ুন:  পদ্ম গুলঞ্চ লতা এশিয়ায় জন্মানো এক উপকারি ঔষধি উদ্ভিদ

৭. উরঃক্ষত: বুকে ব্যথা, মাঝে মাঝে রক্তও ওঠে, সেক্ষেত্রে মূল সমেত পুনর্নবা ১২ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে প্রতিদিন খাওয়ালে বুকে ব্যথাও কমবে, রক্ত ওঠাও বন্ধ হবে।

৮. অনিদ্রায় (Insomnia):বহু কারণে অনিদ্রা হতে পারে। কিন্তু তার মূলে থাকবে কোনো না কোনো স্রোতপথে বায়ুর খরতা; সে মূত্রগ্রন্থির বিকারপ্রাপ্তি হলেও হবে, আবার রক্তস্রোতে বিকারগ্রস্থ হলেও হবে, আবার মনোবহ স্রোত বিকারগ্রস্থ হলেও হবে; সুতরাং মূল সূত্র একটিই থাকলো সেটা হলও বায়ু বিকারগ্রস্থ হওয়া।

এক্ষেত্রে মূল সমেত পুনর্নবা ১৫ থেকে ২০ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে, এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সকালে ও বিকালে দুইবারে সবটা খেতে হবে। এটাতে বায়ু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে; তার ফলে অনিদ্রাও দূর হবে।

৯. ঘুসঘুসে বা চাতুর্থক জ্বর: যে জ্বর তিন সপ্তাহের মধ্যে আসছে, যাচ্ছে বা থাকছে এ সংজ্ঞায় সে পড়ে না, কিন্তু জ্বর যদি মাঝে মাঝে হতে থাকে বা চাতুর্থক জ্বর বা পালাজ্বরে দাঁড়ায়; এই জ্বর তিন দিন বাদে আসে, সেখানে বুঝতে হবে বায়ু রসবহ স্রোতে বিকারগ্রস্থ হয়েছে, সুতরাং এই বায়ুকে স্বাভাবিক করে দিলেই এই জ্বর সেরে যাবে, তারই জন্য মূল সমেত গাছ কুচিয়ে থেঁতো করে, কাঁচা হলে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম, আর শুকনো হলে ১০ থেকে ১২ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকালে ও বিকালে দুইবারে খেতে হবে। এর দ্বারা বিকৃত বায়ু আবার স্বাভাবিক হয়ে ঐ জ্বর নিরাময় করবে।

১০. শীতপিত্ত (Urticaria): হঠাৎ সমস্ত গায়ে ছোট বড় চাকা চাকা হয়ে ফুলে ওঠে, চুলকোতে থাকে এবং দেখা যায় গরম কোনো কিছু গায়ে চাপা দিলে আরাম হয়, চুলকানো ও ফুলা দুই কমে যাবে। এই এক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ গ্রাম মূল সমেত পুনর্নবা ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে কিছুদিন খেলে ঐ এলার্জি হওয়ার প্রবণতাটা চলে যাবে।

আরো পড়ুন:  চিচিঙ্গা লতার ছয়টি ভেষজ গুণাগুণের বিবরণ

১১. সর্বাঙ্গ শোথে: কিডনী ভালো কাজ না করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শোথটার কারণ হয়; এর মূলে থাকে অগ্নিমান্দ্য; তারই পরিণতিতে শরীরে আমরস অর্থাৎ অপক্করসের সৃষ্টি, যার ফলে বায়ুর সঞ্চরণশীলতা ব্যাহত হয়, তাই দেখা দেয় ফুলো, সেটা শরীরের যেকোনো স্থানেই হতে পারে। এক্ষেত্রে পুনর্নবা পাতার গুঁড়ো, অথবা এর ক্বাথ আর কাঁচা পেলে তার রস আটায় মিশিয়ে রুটি করে খেতে হবে। পাতার গুঁড়ো নিলে অন্তত ৭ থেকে ৮ গ্রাম আর ক্বাথ করে নিলে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে আধ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে নিয়ে সেই ক্বাথ দিয়ে আটা মাখতে হবে অথবা যদি কাঁচা গাছের রস পাওয়া যায় তো ৭ থেকে ৮ চা চামচ নিতে হবে। এই সময় ভাত না খাওয়াই ভালো; আর লবণটা বর্জন করলে আর কথাই নেই।

১২. বাতকন্টক রোগ (Sprain of the ankle joint):এইটা মাংসবহ স্রোতপথে বায়ুর বিকারে সৃষ্টি হয়। প্রকুপিত বায়ু গুলফ দেশে আশ্রয় নিলে এবং অসতর্কভাবে চলাফেরা বা অধিক পথ একসঙ্গে হাঁটলে গোঁড়ালিতে খুব বেদনা হয়, চলাফেরায় খুব কষ্ট হয়, মাঝে মাঝে মোচড় দেয়; এক্ষেত্রে মূল সমেত শ্বেত পুনর্নবা কাঁচা হলে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম আর শুকনো হলে ৫ থেকে ৭ গ্রাম, ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ ক্বাথটা সকলে ও বিকালে দু’বারে খেতে হবে, আর সম্ভব হলে ঐ ক্বাথ দিয়ে তেল তৈরি করে ঐ সব পেশীতে আস্তে আস্তে মালিশ করলে ওটা সেরে যাবে।

১৩. সুতো ক্রিমিতে (Thread worms):এ কোনো বয়সের অপেক্ষা করে না, সব বয়সেই এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি বিব্রত করে;  না বের করে দেওয়া যায়, না তাকে মারা যায়। তাই উচিত হলো দাস্ত যাতে পরিষ্কার থাকে তার ব্যবস্থা করা; মিষ্টি বেশি না খাওয়া আর পুনর্নবা গাছের মূল ৫ থেকে ৭ গ্রাম ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ৭ থেকে ৮ দিন খেতে হয়, তবে কাঁচা হলে দ্বিগুণ মাত্রা আর বালকের মাত্রা বয়সানুপাতে।

আরো পড়ুন:  শতমূলী লতার মূল ও পাতার দশটি ভেষজ গুণ

১৪. হুলের জ্বালায়: বিছে বা ভীমরুল অথবা বোলতা এমন কি বিষাক্ত কীটের হুল ফুটিয়েছে এই হুলের জ্বালার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকের আছে, যাঁর এ অভিজ্ঞতা হয়নি, তিনি যদি কখনও বিপাকে পড়েন, তাহলে পুনর্নবার রস করে ওখানে লাগিয়ে দিয়ে দেখবেন জ্বালার তীব্রতাটা কমে যাবে।

১৫. ফুলোয়: প্রস্বাব পরিষ্কর করানোটা দরকার সেটা ঠিকই, এর সঙ্গে এই পুনর্নবা বেঁটে, একটু গরম করে ঐ ফুলোয় লাগিয়ে দিলে। ফুলোর আড়ষ্ট ভাবটা চলে যাবে। তবে বেলা ৯টার পর তিনটের মধ্যে প্রলেপ ব্যবহার করার বিধি।[২]

রাসায়নিক গঠন:

(a) Alkaloid, viz., punarnavine, other unidentified bases. (b) Fatty alcohol. (c) Sterols, 8-sitosterol, -sitosterol.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ      

১. এম আহসান হাবীব, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস”  আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৯ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩১৭। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

২. আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা,২১১-২১৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!