মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী পরপীড়ক প্রজাতন্ত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ৫০টি রাজ্য এবং রাজধানী ওয়াশিংটনসহ কলাম্বিয়া ফেডারেল এলাকা নিয়ে গঠিত একটি সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধবাজ গণহত্যাকারী পরপীড়ক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র। এর আয়তন ৯৪ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২১ কোটি ৭০ লক্ষাধিক। কেরোলিন, মারিয়ানা ও মার্শাল দ্বীপগুলি অস্থায়ীভাবে মার্কিন অছিভুক্ত অঞ্চল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ঔপনিবেশিক শক্তিও। পোর্টো রিকো, ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, সামোয়া, গয়াম এবং ওশেনিয়ার আর কয়েকটি ক্ষুদ্র কিন্তু স্ট্রাটেজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপপুঞ্জ এই ভিন্ন দেশগুলি তার দখলভুক্ত।

সত্তরের দশকের শেষে এবং আশির দশকের গোড়ার দিকে আক্রমণাত্মক পরিকল্পনার পথে দাতাঁতের বাধা উপলব্ধিক্রমে মার্কিন শাসকচক্র দাতাঁতবিরোধী পথ অনুসরণ শুরু করে। অপ্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলাকার বাইরে নতুন সামরিক ঘাঁটি পত্তন আর বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই হলো এই রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের লক্ষ্য।[১]

টার্গেট করে একটার পর একটা দেশে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া। পছন্দের সরকার বসাতে গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো। বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে গোপন অভিযান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারাবিশ্বে এভাবেই আধিপত্য কায়েম রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আধিপত্য লড়াইয়ের এ মিশনে ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি দেশটির হাতে নিহত হয়েছে ২ থেকে ৩ কোটি বেশি নিরীহ বেসামরিক মানুষ।[২]

পেন্টাগন

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ দপ্তর হচ্ছে ভারজিনিয়ার আরলিংটন শহরে অবস্থিত পেন্টাগন। এরূপ মনে করা হয় যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এর যত না অধীন পেন্টাগন, তার অধিক পেন্টাগনের অধীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সংখ্যাগতভাবে পেন্টাগন দ্বারা পঞ্চ বা পঞ্চ বাহুও বুঝানো হয়।[৩]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র পলিসির গোপন দলিলপত্রকে পেন্টাগন পত্রাবলী বলা হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মার্কিন নীতির সূত্রসমূহ হচ্ছে এই পত্রাবলী। গোপন এই দলিলপত্র সরকারকেই একজন কর্মচারী নিজের বিবেক বোধ থেকে ফাঁস করে দেওয়াতে জনসাধারণ এই সব দলিলের বেশ পরিমাণ সম্পর্কে পরিচয় লাভ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হয় এবং মার্কিন যুদ্ধনীতির প্রকাশ এবং সামরিক আক্রমণের নীতি অধিকতর প্রকাশ্যভাবে পরিচালনার দাবী বৃদ্ধি পেতে থাকে।[৩]

১ম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনরা জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে সমান তালে আক্রমণ চালায়। বলতে গেলে তাদের এই আক্রমণ যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ১৯১৪ সালের দিকে ৯৮ হাজার নিয়মিত মার্কিন সৈন্যের প্রায় ৪৫ হাজার মােতায়েন করা হয় দেশের বাইরে। জেনারেল লিওনার্ড উডের সুপারিশক্রমে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার করতে সময় নেননি। আর ১৯১৭ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে তখন জেনারেল পার্শিংয়ের নেতৃত্বে প্রেরণ করা হয় আমেরিকান এক্সপিডিশনারি ফোর্স বা এইএফ। এরই মাঝে মার্কিন কংগ্রেস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিউজ জনসন প্রণীত সিলেক্টিভ সার্ভিস অ্যাক্ট পাস করে। এর আওতায় ২১-৩০ বছর বয়সের সব মার্কিন পুরুষ নাগরিকের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এই আইনের আওতায় মার্কিন সেনাবাহিনীর জনবল বাড়তে থাকে। 

চাকরি প্রত্যাশী মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও দলে দলে যােগ দিতে থাকে সেনাবাহিনীতে। তাদের আগমনে ১৯১৮ সাল নাগাদ মার্কিন সামরিক বাহিনীর আকার দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৯ লাখ ৮ হাজার ৫৬৬ জনে। আর তার মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ পুরুষকে সরাসরি নিয়ােগ দেয়া হয় সামরিক বাহিনীতে। এরা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে। এর মাধ্যমেই ১৯১৮ সালের দিকে এসে এক ফ্রান্সেই মার্কিন সেনাবাহিনীর সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়েছিল। মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করেই মূলত কোণঠাসা করে ফেলে অক্ষ শক্তিকে। ১৯০৩ সালের দিকে রাইট ব্রাদার্স বিমান আবিষ্কার করলে যুক্তরাষ্ট্র সেটাকে যুদ্ধে ব্যবহারের কথা চিন্তা করে। শেষ পর্যন্ত এর প্রায় ১৪ বছর পর প্রথমবারের মত যুদ্ধে বিমান বাহিনীর সম্পৃক্তি ঘটায় তারা। আর ১৯১৮ সালের দিকে প্রথমবারের মত সরাসরি ফ্রান্সের মাটিতে বিমান থেকে হামলা করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্যকে। বিমান হামলা চালিয়ে শত্রুকে পর্যুদস্ত করে ইতিহাস বিখ্যাত মার্কিন বৈমানিক হচ্ছেন এডওয়ার্ড রিকেনবেকার, ফ্রেডরিখ গিলেট ও উইলফ্রেড রিভার। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম নৌবাহিনী হিসেবে ১৯১৪ সালের দিকেই মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছিল। এসব জাহাজ আটলান্টিকের বিস্তৃত এলাকায় মার্কিন সামরিক ও বাণিজ্যিক জাহাজগুলােকে নিরাপত্তা প্রদানের কাজ করত। তবে কুশলী জার্মান নৌবাহিনীর ইউবােট থেকে চার্জ করা মাইনের আঘাতে এসব যুদ্ধ জাহাজের ব্যাপক ক্ষতি গুণতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে।[৪]

মার্কিন পুঁজিবাদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জীবন পুঁজিবাদের তীব্রতর সাধারণ সংকট এবং শ্রমিক শ্রেণী ও সমস্ত মেহনতি মানুষের জীবনশতের উপর একচেটিয়াদের আক্রমণের প্রভাবাধীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতিবৃহৎ একচেটিয়াদের দেশ। সেই দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক গাস হলের ভাষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচেটিয়া একত্রীকরণের এক দৃষ্টান্তহীন উন্মাদ ধসের চূড়ায় দাঁড়িয়ে। বড় বড় কর্পরেশনগুলি ছোটদের অন্তস্থ করার ফলে তথাকথিত সংস্থা-পিণ্ড গড়ে ওঠে। এগুলি আসলে বিশাল একচেটিয়া সংস্থা এবং তারা উৎপাদনের বহু শাখা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের অভিলাষী।[১]

একচেটিয়াদের হাতে অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্রীভবন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে তাদের একাঙ্গীভবন রাষ্ট্রীয়-একচেটিয়া পুঁজিবাদের ভূমিকা সম্প্রসারিত করেছে এবং তা জাতীয় জীবনের সর্বত্র এবং বিশেষভাবে শিল্পক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকাসীন হয়েছে। অতিবৃহৎ ২৫০টির মতো মার্কিনী কর্পরেশন দেশের ৭০ শতাংশ শিল্পোৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কিন অর্থনীতি সামরিকীকরণের ফলে তথাকথিত সামরিক-শিল্পগত সমাহারের উদ্ভব ঘটেছে। তার প্রভাবে অস্ত্র-প্রতিযোগিতা ত্বরিত হচ্ছে, এখানকার বাৎসরিক সামরিক ব্যয় ২০,০০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে।

অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের শ্রেণীর তুলনায় মার্কিনী একচেটিয়ারা অনেক বেশি শক্তিশালী। পুঁজিবাদী  দুনিয়ার অন্যত্রের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক বৈপরিত্যও প্রকটতর। সেই দেশের জনসংখ্যার নগণ্য ১ শতাংশের চেয়ে কম কোটিপতি, লক্ষপতি ও অন্যান্য পুঁজিপতিরাই দেশের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক। বিলাসী বুর্জোয়াদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাচুর্যের দেশ। কিন্তু সরকারী তথ্যানুযায়ী পুঁজিবাদী পৃথিবীর এই সমৃদ্ধতম দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। মার্কিন অর্থবিদদের হিসাবমতো দেশের ৪০ শতাংশ মানুষই অভাবগ্রস্ত।

দেশে আজ পুঁজিবাদী শোষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৬ কোটি শ্রমিকের শোষণ থেকে মার্কিন পুঁজিবাদ বার্ষিক কোটি কোটি ডলার মনাফা অর্জন করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে ২ কোটি ৫০ লক্ষাধিক নিগ্রো-বংশোদ্ভূত আফ্রো-আমেরিকান, ৫০ লক্ষাধিক মেক্সিকান, ২০ লক্ষের মতো পোর্টোরিকান ও সাড়ে ৭ লক্ষাধিক রেড ইণ্ডিয়ান। এসব জাতিসত্তার লোক জাতি ও বর্ণ বৈষম্য এবং কঠোর পুঁজিবাদী শোষণের শিকারস্বরুপ।

আমেরিকার স্থানীয় অধিবাসী রেড ইণ্ডিয়ানরা দেশের পশ্চিম মরুভূমির সংরক্ষিত এলাকায় চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে, অধিকারবঞ্চিত ভবিষ্যৎহীন অবস্থায় বসবাস করে।

মার্কিন দেশের সামাজিক কাঠামোর একেবারে নিম্নতম স্তরের বাসিন্দা হলো পর্টোরিকান ও মেক্সিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকানরা। এরা প্রধানত যাযাবর খেতমজুর।

নিগ্রোরা দেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। এদের অর্ধেকই বস্তিবাসী শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় নিগ্রোদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় নিগ্রোদের মজুরিও কম। সমাজের সর্বত্রই নিগ্রোদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য বিদ্যমান।

মার্কিন প্রাকৃতিক সম্পদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। তার চিহ্নিত কয়লা সম্পদ ১২,৫০০ কোটি টনের বেশি এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে তৈলের পরিমাণও প্রায় ৫০০ কোটি টন। গ্রেট লেক অঞ্চলে, আপ্পালাচি পর্বতে এবং অন্যত্র তার ৫০০ কোটির টনের মতো লৌহ-আকরিক আছে। তদুপরি পর্বতসঙ্কুল রাজ্যগুলি তামা, যৌগিক আকরিক, ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য পারমাণবিক কাঁচামাল, টাংস্টেন, মলিবডেনাম ও নিকেলের বৃহৎ খনিতে সমৃদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসঙ্গে আমদানি করে ক্রমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কোবাল্ট ও অন্যান্য ধাতু। তৈল, ইউরেনিয়াম এবং বিদেশস্থ সামরিক গুরত্বপূর্ণ অন্যান্য কাঁচামালের উৎসগুলি মার্কিন একচেটিয়াদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। এই দেশ বিশাল অত্যুর্বর কৃষিভূমির মালিক।

মার্কিন অর্থনীতি

ইউরোপের অর্থনীতিনাশী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধকে মার্কিন পুঁজিবাদ মুনাফা লুণ্ঠন ও বিশ্বে নিজস্ব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার এক উপায়ে পর্যবসিত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত ইউরোপের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলে বিদেশের সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগানদার মার্কিন শিল্পগুলি তাদের উৎপাদন দ্বিগণিত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন একচেটিয়াদের মুনাফা চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায়।

প্রসঙ্গত মার্কিনী ও বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উইলিয়ম ফস্টারের ‘আউটলাইন পলিটিকাল হিস্ট্রি অব দ্য আমেরিকানস’ গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য। তিনি লিখেছেন যে, যুদ্ধের ফলে মার্কিন পুঁজিপতিদের সমৃদ্ধি ও অন্যান্য দেশের সংখ্যাগুরদের দারিদ্র্যই মার্কিনীদের অর্থনৈতিক, ফিনান্সিয়াল ও সামরিক শক্তিবৃদ্ধির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারণী হেতু ছিল।

যুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশী বিজ্ঞানীদের ভিড় দেশের বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশল সামর্থ্য বৃদ্ধি করছে।

মার্কিন শিল্প কারখানা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অর্থনীতির একটি শিল্পগত কাঠামো রয়েছে। এবং এটি অত্যুন্নত বহশাখী মানুফ্যাকচারিং ও নির্মাণ শিল্পগুলি দ্বারাই মূলত গঠিত। এটি থেকেই জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশের বেশি অর্জিত হয়। অর্থনীতিতে সার্ভিস শিল্পের বর্ধমান গুরত্বপূর্ণ ভূমিকাও এখন সহজলক্ষ্য।

নিষ্কাশনলগ্ন শিল্প অপেক্ষা দ্রুত বিকাশমান মানুফ্যাকচারিং শাখাগুলিই মার্কিন শিল্পোৎপাদনে মুখ্য ভূমিকার অধিকারী। মানুফ্যাকচারিং শাখাগুলির প্রায় ৬০ শতাংশ পণ্যই ভারী শিল্প উৎপাদন করে। প্রধান শিল্পগুলির উৎপন্ন সামগ্রীর ২৫-৩৩ শতাংশই যুদ্ধাস্ত্র। এদেশে মানুফ্যাকচারিং শিল্পের প্রতি দশজন শ্রমিকের মধ্যে একজন, ইলেকট্রনিক শিল্পে প্রতি তিনজনে একজন এবং বিমানশিল্পে প্রতি দ্বিতীয় ব্যক্তিই যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন করে।

মোট শিল্পশ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশ নিয়োগকারী এদেশের ইঞ্জিনিয়রিং শিল্প পুঁজিবাদী দুনিয়ার ধাতুশিল্পের প্রায় অর্ধেক সাজসরঞ্জাম তৈরি করে। যুদ্ধোত্তরকালে ইলেকট্রনিক ও বিদ্যুৎ-ইঞ্জিনিয়রিং শিল্প অত্যুন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছে। পারমাণবিক স্টেশন নির্মাণের সাজসরঞ্জাম উৎপাদনও বাড়ছে।

পুঁজিবাদী দুনিয়ার ৩৩ শতাংশ মোটরগাড়ি (বার্ষিক ১ কোটি ২০ লক্ষাধিক) নির্মাতা মোটর-শিল্প রেলওয়ে সাজসরঞ্জাম নির্মাণশিল্পের পাশাপাশি মার্কিন পরিবহণ যন্ত্রনির্মাণ শিল্পের বিভিন্ন শাখার মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। জাহাজনির্মাণ, বিশেষত যুদ্ধজাহাজ নির্মাণও উৎপাদনের একটি অত্যুন্নত শাখা।

ব্রিটিশ ও পশ্চিম জার্মানির বিমান কারখানাগুলির মিলিত সামর্থ্যের চেয়েও মার্কিন বিমানশিল্পের সামর্থ্য অনেক বেশি। অবশ্য, মিসাইল ও মহাশূন্যের সাজসরঞ্জাম তৈরিতেই এখানে অধিক লোক নিযুক্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই মার্কিন রাসায়নিক শিল্প পুঁজিবাদী দুনিয়ায় অদ্বিতীয় ছিল। যুদ্ধের পর এই শিল্প উন্নততর হয়েছে।

ধাতুশিল্প মার্কিনী শিল্পের একটি পুরনো প্রতিষ্ঠিত শাখা। লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের কেবল ৬০ শতাংশই দেশজ এবং প্রায় পুরো ম্যাঙ্গানিজ, ক্রমিয়াম ও উন্নত শ্রেণীর ইস্পাত তৈরির পক্ষে জরুরি অন্যান্য সংকর ধাতু আমদানিকৃত।

মার্কিন দেশের জালানির প্রায় ৮০ শতাংশ তৈল ও গ্যাস পূরণ করে থাকে। দেশের বিদ্যুৎশক্তির ৮০ শতাংশেরও বেশি তাপশক্তি স্টেশন থেকে উৎপন্ন হয় এবং জলবিদ্যুৎ স্টেশনের ভূমিকা এক্ষেত্রে নগণ্য। জ্বািং শাখাগুলিই মার্কিন শিল্পলানি সংকটগ্রস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক স্টেশন নির্মাণে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।

দেশে অত্যন্ত অসমভাবে বিন্যস্ত শিল্প মুলত আটলান্টিক উপকূল ও গ্রেট লেক অঞ্চলেই কেন্দ্রিত। আটলান্টিক উপকূলের বোস্টন থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি শিল্পপ্রধান ও শহরাকীর্ণ এলাকা নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া ও বাল্টিমোর প্রভৃতি গুরত্বপর্ণ শিল্পকেন্দ্র সহ বার্মিংহাম অবধি বিস্তত। নিউ ইয়র্কের পশ্চিম দিকের গ্রেট লেক অঞ্চলেই শিকাগো ডেট্রয়েট, ক্লিভল্যাণ্ড ও বাফেলো প্রভৃতি প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলি অবস্থিত সম্প্রতি টেকসাস ও ওকলাহোমা (তৈল), লস এঞ্জেলস (বিমাননির্মাণ) ও সান ফ্রান্সিসকো (জাহাজনির্মাণ) রাজ্যগুলির শিল্পগত গুরত্ব যথেষ্ট বুদ্ধি পেয়েছে।

জাতীয় আয়ে কৃষির অংশভাগ শিল্প ও নির্মাণের এক-দশমাংশ। আত্যন্তিক যন্ত্রকৃত পুঁজিবাদী খামারগুলিতেই দেশের কৃষি-উৎপাদনের সিংহভাগ কেন্দ্রিত। এখানে ৫ শতাংশেরও কম অতিবৃহৎ খামার ৫০ শতাংশ চষাজমির মালিক এবং ফসলের মূল অংশের উৎপাদক। মার্কিন দেশে ক্ষুদ্র খামারমালিকরা ক্রমেই দেউলিয়া হয়ে পড়ছে এবং কৃষি-উৎপাদন আরও অধিক পরিমাণে বড় বড় পুঁজিবাদী খামারে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

আঞ্চলিক ও শাখাভিত্তিক আত্যন্তিক বিশেষীকরণ মার্কিন কৃষির বৈশিষ্ট্য। এতে অত্যুৎপাদনশীল পশুপালনই প্রধান স্থানের অধিকারী। গ্রেট লেক এবং পূর্বাঞ্চলীয় কতকগুলি রাজ্যে দুগ্ধশালার জন্য পশুপ্রজন উন্নত হচ্ছে। দেশে গরুর সংখ্যা এখন ১২ কোটির বেশি। পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলে মেষপ্রজন প্রচলিত। শহরের উপকণ্ঠেই শুকরপ্রজন কেন্দ্রিত। কানাডা-লগ্ন রাজ্যগুলিতেই গম উৎপন্ন হয়। গমের গড়পড়তা বার্ষিক উৎপাদন ৫ কোটি ৫ লক্ষ টন। তার ভুট্টাচাষের এলাকাও বিরাট (বার্ষিক উৎপাদন ১৬ কোটি টন)। দেশের দক্ষিণ তুলা, তামাক ও লেবুজাতীয় ফল চাষের এলাকা।

পরিবহণ দেশের পক্ষে চূড়ান্ত গুরত্বপর্ণ। রেলপথেই (চাল, রেলপথের দৈর্ঘ্য ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কিলোমিটার) মুলত অভ্যন্তরীণ মালপত্র পরিবাহিত হয়। দেশে হাইওয়ের জালও বিস্তৃত (প্রায় ৬০ লক্ষ কিলোমিটার)। দেশের জলপথ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গ্রেট লেক ও মিসিসিপি অববাহিকায় জাহাজ চলাচল অত্যধিক। মার্কিন বৃহৎ সামুদ্রিক নৌবহর প্রধানত বহির্বাণিজ্যিক সংযোগে নিয়োজিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমানপথে পৃথিবীর বহু দেশের সঙ্গে যুক্ত।

তথ্যসূত্র

১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১৬৯-১৭৪।
২. যুগান্তর ডেস্ক, ৭৩ বছরে ৩ কোটি মানুষ হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, দৈনিক যুগান্তর, দশ দিগন্ত, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ইউআরএল: https://www.jugantor.com/todays-paper/ten-horizon/118622/
৩. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০৫-৩০৬।
৪. মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, [Pdf]. বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জানুয়ারি ২০১৯. সানজিদা মুস্তাফিজ ও সুমা কর্মকার. সম্পা. পৃষ্ঠা ৮০-৮৪; Retrieved from http://www.ebookbou.edu.bd/wp/OS/hsc4_2.php#hsc2855

আরো পড়ুন:  গেটিসবার্গ ভাষণ হচ্ছে ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম ও গুরুত্বপুর্ণ রাজনৈতিক ভাষণ

Leave a Comment

error: Content is protected !!