শিয়ালমুত্রা বা ডানকোনী বা কুকসিমা (বৈজ্ঞানিক নাম vernonia cinerea. ইংরেজি: little ironweed and poovamkurunnila) হচ্ছে Asteraceae পরিবারের Cyanthillium গণের একটি সপুষ্পক বীরুৎ। এই গাছটি বিদেশি। এটি গুল্মজাতীয় খুবই ছোট ধরনের উদ্ভিদ। লম্বায় ফুট দুয়েকের মতো হয়। পাতার কিনারার উভয় দিক কাটা। এর কয়েকটি জাত হয়। একে চিনার সহজ উপায় হলো, পাতার আকৃতি একটু ভিন্ন ধরনের হয়। ঐ সব জাতের ক্ষেত্রে পাতা অবিভক্ত এবং কিনারায় করাতের মতো দাঁত থাকে। এ গাছের ফুলের রং পীত এবং উভয়লিঙ্গ বিশিষ্ট। ফুল কোমল ও লোমযুক্ত। পাপড়ি সাদা রঙের হয়। কুকসিমা গাছে শীতের শেষ দিকে ফুলে ফোটে এবং ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গাছে ফল হয়। ঔষধ হিসাবে এই গাছ ব্যবহার করা হয়। সচরাচর এই গাছ দেখা যায় অনেকে এই গাছকে ডানকোণী বলে থাকে।
ব্যবহার:
১. অর্শজনিত অধিক রক্তস্রাব হতে থাকলে সেটা হঠাৎ বন্ধ করা অসমীচীন, তাদ্বারা আসতে পারে অন্য নানা প্রকার উপসর্গ। তাই আয়ুর্বেদের চিকিৎসা পদ্ধতি একটু পৃথক। এছাড়াও এই রোগের আনুষঙ্গিক উপসর্গও অনেক সময় থাকে; সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে এগুলিকে নিরসনের প্রয়োজন হয়।
২. আর একটি বিশেষ প্রয়োগ ক্ষেত্র ফাইলেরিয়া বা শ্লীপদ রোগে কেবল এই রোগ কেন, বহুরোগ সম্পর্কেই দুটি চিকিৎসাশাস্ত্রের রোগ-বিজ্ঞানের চিন্তাধারা বিপরীতমুখী। এক সম্প্রদায় ক্ষেত্রতত্ত্বের প্রাধান্যে বিশ্বাসী, আর এক সম্পদায় জীবাণুতত্ত্বে বিশ্বাসী; সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার ধারা পৃথক হওয়া খুব স্বাভাবিক। একজন বলছেন ক্ষেত্রটিকে এমনভাবে অনুপযোগী করো, যেখানে জীবাণুর সৃষ্টিই না হয়। আর একজনের মতে, যেখানে জীবাণুর প্রাধান্য স্বীকৃত সেখানে তারই বিনাশ করা মুখ্য চিকিৎসা; সুতরাং নীতিগত পার্থক্য থাকবেই।
কি ভাবে প্রয়োগ করতে হবে: সমগ্র গাছ (মূলে সমেত) ১২ থেকে ১৩ গ্রাম, ৫টি গোল মরিচ ও ৫টি বড় এলাচ একসঙ্গে জল দিয়ে শিলে পিষে নিয়ে পাতলা কাপড়ে ছে’কে ঐ জলীয়াংশ একটু গরম করে সকালে একবার খেতে হবে। এইভাবে ২ থেকে ১ দিন খেলে রোগের উপশম হয়। এই সময়টায় ক্ষীর ও দই খাওয়া নিষেধ। এটি ভাগলপুর অঞ্চলের বৈদ্যসম্প্রদায় এই ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন।
৩. ক্রমশ শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে (বৃদ্ধ বয়সে) সে ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ গ্রাম (শুকনো হলে ৫ গ্রাম) গাছে মূলে নিয়ে জল আধ সের ও দুধ আধপোয়া একসঙ্গে সিদ্ধ করে দুধাবশেষ অর্থাৎ আন্দাজ আধপোয়া থাকতে নামিয়ে, ছেকে ঐ দুধটি খেতে হবে। এটি ব্যবহারকালে অন্ততঃ আধ সের আন্দাজ দুধ প্রত্যহ খেতে পারলে ভাল হয়।
৪. বয়সের স্বাভাবিক ক্ষয় ক্ষতিজনিত দুর্বলতায়, অল্প পরিশ্রমে কাতর, সে ক্ষেত্রে এই গাছের পঞ্চাঙ্গ (মূল সমেত সমগ্র গাছ) কাঁচা ১০ গ্রাম আর শুকনো হলে ৫ গ্রাম নিয়ে একপোয়া জলে সিদ্ধ করে অবশিষ্ট এক ছটাক আন্দাজ থাকতে নামিয়ে ছেকে একটু ঘিয়ে সাঁতলে প্রত্যহ খেতে হয়, এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যায়।
৫. সহদেবী বা শিয়ালমুত্রা সমগ্র গাছ ছেচে রস করে ৪ চামচ আন্দাজ একটু গরম করে অথবা আন্দাজ আধ পোয়া (১০০ মিলি লিটার) গরম দুধে মিশিয়ে, তার সঙ্গে একটু চিনি বা মিছরি দিয়ে খেলে, মাথাঘোরা ও ভুল হয়ে যাওয়া অবশ্যই কমে যায়; তবে প্রথম দুই দিন অর্ধেক মাত্রায় আরম্ভ করাই ভাল।
৬. যাদের কোষ্ঠে সর্বদা ক্রিমি জমে, যার জন্যে বমি বমি ভাব, থুথু ওঠা, চোখে কালি পড়া এসব পরানো আমাশয়ের লক্ষণ, এসব ক্ষেত্রে সহদেবীর রস সকালে ১ থেকে ২ চামচ একটু গরম করে খেতে হয়, অবশ্য পাটনা অঞ্চলে ক্রিমির উপদ্রব কমানোর জন্য এই গাছের বীজ ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে এই গাছটির বীজ ব্যবহারের একটা যুক্তি আছে এই হেতু যে এটি vernonia গণের গাছ। আমাদের সোমরাজীও সেই vernonia গণের।
৭. অনিয়মিত মাসিকে: ৩ থেকে ৪ মাস অন্তর হচ্ছে, তলপেট ও নিতম্ব ভেরে যাচ্ছে, তাঁরা এই গাছের রস ২ চামচ একটু গরম করে প্রত্যহ কিছুদিন একবার করে খেলে ঐ দোষটা চলে যাবে।।
৮. অগ্নিমান্দ্য: যখন তখন ক্ষিধে লাগে আবার না খেলেও অস্বস্তি, আর খেয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না, অর্থাৎ বায়ু প্রধান অগ্নিমান্দ্য এই রকম ক্ষেত্রে এই গাছের রস ২ চামচ একটু গরম করে খেতে হয়।
৯.পেট ব্যথায় (বায়র জন্য): আমাশয়ের জন্য নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ২ চামচ রস গরম জলে মিশিয়ে খেলে উপশম হয়।
১০. খিল ধরা: শুধু, হাটু দুটোতেই ধরে, ব্যথাও হয়; সেক্ষেত্রে এই সহদেবীর পাতার রস ২ চামচ জল মিশিয়ে খেতে হয়। আর বেটে অল্প গরম করে ওখানে লাগাতে হয়।
১১. আধি রোগে (মেলানকোলিয়ায়): যে উন্মাদ বিদ্রোহ করে না, বসে মনে মনে বকে, এসব ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের প্রাচীন বৈদ্যগণ সর্পগন্ধার মূলের (Rauwolfa Serpentina) চূর্ণ খেতে দিতেন, কারণ তাঁদের মতে এটি নাকি শঙ্খপুপী; ও অঞ্চলে এই গাছ ডানকুনী নামে পরিচিত; কিন্তু এ সব অঞ্চলে Canscora decussata গাছকেই ডানকুনী বলা হয়।[১]
১২. কলেরায়: কুকসিমা পাতার আধা কাপ রসে ৮টি গোলমরিচ গুঁড়া করে মিশিয়ে লে একদিকে যেমন রোগীর প্রস্রাব হয় তেমনি অন্যদিকে পায়খানা বন্ধ হয়। কলেরা ছাড়াও একই ওষুধ এবং একই পরিমাণ প্রয়োগ করলে রক্ত অর্শ এবং মূত্ররোগ দূর হয়।
১৩. ফিতা ক্রিমি: ছোট ও বড়দের পেটে ফিতা ক্রিমির উৎপাত বাড়লে কুকসিমা পাতার টাটকা রস সকালে খালিপেটে একবার খেলে ক্রিমি জীবন্ত অথবা মৃত অবস্থায় মলের সাথে চলে আসে। ছোটদের ক্ষেত্রে রস ১০ মিলিলিটার এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে ১০ মিলিলিটার মাত্রায় একদিন খাওয়া প্রয়োজন হয়।
১৪. রক্ত আমাশয়ে: কুকসিমা গাছের শিকড় ৫ গ্রাম এবং টক দই ৫ চামচ শিলে ভালোভাবে বেটে রোজ সকাল এবং বিকালে খেলে উপকার হয়।
১৫. প্রস্রাব সম্পূর্ণ বন্ধ হলে: গরমের সময় শরীরে পানির পরিমাণ কম হলে প্রস্রাব কমে যায় এবং অনেক সময় মোটেই হয় না। এছাড়াও মূত্রযন্ত্রের কাজে কোথাও বিঘ্ন ঘটলে প্রস্রাব আটকে যায়। এ রকম অবস্থায় কুকসিমা পাতার রস ১৫ থেকে ২০ মি.লি. রোগীকে খাওয়ালে প্রস্রাব স্বাভাবিক হবে।
১৬. মুখের শোথে: কুকসিমা গাছের কাঁচা মূল কেটে ৫ গ্রাম পরিমাণ ছোট টুকরা মুখে রাখলে মুখের শোথ সেরে যায়। মাঝে মাঝে কষের দাঁত দিয়ে মূলকে সামান্য চাপ দিতে হবে। মুখে বেশি লালা এবং থুতুতে ভরে গেলে সেটা অবশ্যই ফেলে দেয়া দরকার। অতএব রাতে শুতে যাবার সময় অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থায় কুকসিমার মূল কানমতেই মুখে রাখা উচিত নয়। তাছাড়া বেশি রস পেটে গেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
১৭. মুখর শুষ্কতায়: কুকসিমা পাতার টাটকা রস মুখে রাখলে মুখের শুষ্কতা দূর হয়।
১৮. অবিরাম জ্বরে: ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বসন্ত ইত্যাদি রোগের জন্যে শরীরে যদি উত্তাপ বেড়ে যায় তবে সেটা আলাদা ব্যাপার। অন্য কোনো কারণে জ্বর হলে কুকসিমা। গাছের পাতার রস ৩০ মি.লি. প্রয়োগ করলে জ্বরে বিশেষ উপকার হয়। [২]
রাসায়নিক গঠন:
(a) Acid viz. threo 12, 13-dihydroxyoleic acid.
(b) Terpenoids viz. betaamyrin, betaamyrin acetate, lupeol, lupeol acetate, betaamyrin benzoate.
(c) Sterols viz. alpha sitosterol, beta sitosterol, stigmasterol.
(d) Carbohydrates.
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা,২২১-২২৩।
২. আঃ খালেক মোল্লা সম্পাদিত;লোকমান হেকিমের কবিরাজী চিকিৎসা; মণিহার বুক ডিপো, ঢাকা, অক্টোবর ২০০৯; পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।