পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত লোকসমাজের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোই লোকসমাজের সংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলো (ইংরেজি: Elements of the Folk Culture of West Bengal) হচ্ছে লোকশিল্প, লোকসঙ্গীত, লোকচিকিৎসা, লোক খেলাধূলা, লোকনাট্য, লোকনিমন্ত্রণ ইত্যাদি। এসব উপাদানগুলো পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত লোকসমাজের সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে নির্ধারণ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক কৃষিকেন্দ্রিক রাজ্য। তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, মহানন্দা, গঙ্গা (ভাগীরথী), অজয়, দামোদর ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, সুবর্ণরেখা, রূপনারায়ণ, মাতলা প্রভৃতি নদ-নদী বিধৌত পলিমাটি কৃষিকাজের পক্ষে ভীষণ উপযোগী। তাই প্রকৃতিগত কারণেই পশ্চিমবঙ্গবাসী মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। আর নদীমাতৃক কৃষিকেন্দ্রিক ভূখণ্ড হলো লোকসাংস্কৃতিক উপাদানের আকরভূমি, পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। লোকসাহিত্য থেকে শুরু করে লোকশিল্প, লোকসঙ্গীত, লোকচিকিৎসা, লোক খেলাধূলা, লোকনাট্য, লোক নিমন্ত্রণ ইত্যাদি নানান লোকসংস্কৃতির উপাদানে পরিপূর্ণ ভারতের এই অঙ্গরাজ্যটি। বর্তমান লেখায় পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত লোকসংস্কৃতির উপাদানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।

লোকসাহিত্য:

লোকসমাজের দ্বারা মুখে মুখে রচিত এবং বংশ পরম্পরায় মৌখিকভাবে প্রচলিত সাহিত্যকেই লোকসাহিত্য বলে। লোকসাহিত্য লোকসমাজের সহজ সরল মানসিকতার প্রকাশ। অলৌকিক – অতিলৌকিক চেতনাও অবাধে লোকসাহিত্যের সামগ্রী হতে পারে। স্থূলতা ও গ্রাম্যতা তার পরিবেশকে দূষিত করে না, তার অঙ্গসৌষ্ঠব অনেকটা ঢিলেঢালা এবং তার বিষয়বস্তু ও অবয়বগত কাঠামোতে ঐতিহ্যের ছাপ থাকে সুস্পষ্ট। লোকসমাজে প্রচলিত ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, কথা, গীতিকা কিংবদন্তী ইত্যাদি হলো এর উদাহরণ।

ছড়া:

পশ্চিমবঙ্গের লোকসমাজে প্রচলিত এমন অনেক ছড়া পাওয়া যায়, যার স্রষ্টা হিসাবে কোন ব্যক্তির নাম নেই। অথচ বছরের পর বছর ধরে লোকপরম্পরায় মৌখিক ঐতিহ্যে তা চর্চিত হচ্ছে, লালিত পালিত হচ্ছে। এই ছড়াগুলি কে বা কারা কখন লিখেছিল, তা কেউ বলতে পারে না। এর ভিতরের গঠন বা বাঁধুনি কিছুটা ছন্নছাড়া হলেও এর মধ্য দিয়ে সমাজ ইতিহাস জানা সম্ভবপর হয়, কাজ করার প্রেরণা লাভ করা যায়। লোকসমাজে প্রচলিত এরকম একটি ছড়া নিয়ে তুলে ধরা হলো:

ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।

ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে ছড়া শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত ‘ছট’ শব্দ থেকে। ছট > ছটা > ছড়া, অবশ্য কেউ কেউ ‘ছদ’ অপভ্রংশেই ছড়া শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন। সে যাই হোক ছড়া হলো ছন্দোবদ্ধ সহজ সরল ক্ষুদ্র কবিতা, যার অবয়ব গঠিত হয় ধ্বনিময় ও তালপ্রধান শব্দগুচ্ছ নিয়ে। যার ভঙ্গি-চটুল এবং গতি হয় চঞ্চলতা যুক্ত সাবলীল। ছড়ার ভঙ্গিতে ও ঢঙে যে রীতি আছে, তা শব্দকে যতটা প্রধান্য দেয়, ভাবকে ততটা নয়। ছড়ার মধ্যে বুদ্ধি বৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির প্রাধান্যই বেশি লক্ষ্য করা যায়।

আরো পড়ুন:  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎপত্তি হয়েছে বেদ-পরবর্তীকালের ধ্রুপদী সংগীত থেকে

ধাঁধা:

মানুষের মনে বস্তু, প্রাণি বা ব্যক্তি সম্পর্কিত পরস্পরের সংযোগ, তুলনা এবং সাদৃশবোধ থেকেই ধাঁধার জন্ম। ধাঁধা একটি মাত্র বাক্যে সম্পন্ন হতে পারে, আবার একাধিক বাক্যেও হতে পারে। তবে তার আকৃতি খুব বেশি বড় হয়। না। ধাঁধার মধ্যে রূপক, যমক, অনুপ্রাস, বক্রোক্তি প্রভৃতি অলংকারের সুচিন্তিত প্রয়োগ ঘটেছে। ধাঁধা আমাদের সমাজে অনেক প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। বৈদিক সংস্কৃতিতেও ধাঁধার প্রয়ােগ ছিল। ধাঁধা মাত্রই প্রশ্ন করে – অর্থাৎ বর্ণনার পরই প্রশ্ন থাকে, এর অর্থ কি? এভাবেই যে প্রশ্ন করে এবং যে উত্তর দেয় উভয়েই একটি রস উপভোগ করে, আর এখানেই থাকে ধাঁধার সাহিত্য মূল্য। নিম্নে একটি উদাহরণ তুলে ধরা হল:

এখান থেকে দিলাম সাড়া

সাড়া গেল বামুন পাড়া।

ধাঁধাটির উত্তর শঙ্খ। শঙ্খের নিনাদ বহুদূর পর্যন্ত যায় এটা বোঝাতেই ঐ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এরকমভাবেই চারদিকের প্রকৃতির প্রতি, জীবনের সহজ সরল অভিব্যক্তির প্রতি এবং সাধারণ আচার অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির প্রতি মানুষের অনুরাগ থেকে বিভিন্ন ধাঁধাগুলি সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক, নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, প্রাণি, উদ্ভিদ ও তাদের নানান অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, সংসার জীবনের খুঁটি নাটি বস্তু নিয়ে মানুষ ধাঁধা সৃষ্টি করেছে।

প্রবাদ-প্রবচন:

দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রণালী থেকে সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচার-আচরণ যে কোন নৈসর্গিক প্রভাব থেকে, বস্তু ও ব্যক্তির সম্পর্ক থেকে রোগের কারণ ও ঔষধে বা নিয়মাচরণের ফলে আরোগ্য লাভ থেকে, পশুপাখির জীবনধারা থেকে যদি কোন ব্যক্তি অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা সঞ্চয় করে তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আকোক বিশেষ কোন বিষয়ে ছন্দের মাধ্যমে একটি বাক্য বা একজোড়া বাক্য মুখে মুখেই গড়ে তোলে এবং তার সেই রচনা বা সৃষ্টি যদি সমাজের অথবা সেই ভাষার জনগণের দ্বারা ধীরে ধীরে সত্য ও আপন বলে গৃহীত হয়, তবে সেই বাক্য বা জোড়াবাক্যকে প্রবাদ বলা যায়। এককথায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সারগর্ভ বাক্যই হল প্রবাদ-প্রবচন। নিম্নে একটি উদাহরণ তুলে ধরা হল:

আরো পড়ুন:  বাংলা লোকসংগীত গ্রামীণ জনগণের সংগীত ইতিহাসে রচিত গীত ও সংরক্ষিত ভাণ্ডার

‘কাঙালি মেরে কাছাড়ি গরম’

জীবনে যা ঘটে, সমাজে যা প্রতিদিন ঘটছে প্রবাদের ভাষায় তারই বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনে চিকিৎসা, ঋতু, কৃষিকার্য, খেলাধূলা, উৎসব-পার্বণ, দৈনন্দিন জীবন যাত্রার প্রণালী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে প্রচুর প্রবাদের প্রচলন বর্তমান।

লোককথা:

পশ্চিমবঙ্গের শিশু কিশোররা অবসর পেলেই বিশেষত সন্ধ্যাবেলা বা ঝুম করে বৃষ্টি পড়ার সময় তাদের দাদু ঠাকুরমার কাছে আব্দার করে বলে – একটা গল্প বলো না। তারপর দাদু বা ঠাকুমা আরম্ভ করেন, রাক্ষস-খোক্কস, ব্যাঙ্গমা, ব্যাঙ্গমী, এক যে ছিল রাজা কিংবা লালকমল নীলকমল প্রভৃতি গল্প। এই গল্পগুলি বাংলার সমাজজীবনে কবে থেকে প্রচলিত কিংবা এর সৃষ্টিকর্তা কে? তা নির্ণয় করা খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু এইসব গাল-গল্প বা লোককথাগুলি বংশপরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে আজও চর্চিত হচ্ছে। বাংলা লোকসাহিত্যের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এই লোককথা। এই লোককথার আবার বেশ কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। যথা: লোকপুরাণ পশু-পাখির কাহিনি বা উপকথা মূলক গল্প, ঐতিহাসিক ঘটনা সমৃদ্ধ কাহিনি বা কিংবদন্তী, ক্রমপুঞ্জিত কাহিনি, ব্রতকথা, পরী কাহিনি প্রভৃতি।

গীতিকা:

সঙ্গীতাকারে বর্ণিত কাহিনিকেই এক কথায় লোকগীতিকা বলে। তবে এই কাহিনি সংক্ষিপ্ত, সুসংহত, সুবিন্যস্ত এবং নাটকীয় মহিমায় সমৃদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কাহিনি সত্য ঘটনার সঙ্গে জনশ্রুতি মিশিয়ে গড়ে ওঠে। আর সেই সব ঘটনা হল মূলত প্রেমমূলক। অর্থাৎ বেশিরভাগ গীতিকার বিষয়বস্তু হলো প্রেম। অসম প্রেমের অভিব্যক্তি, নারীর প্রাধান্য, ট্রাজেডি মূলক কাহিনিই গাথা বা গীতিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় সংহত আঙ্গিকে এবং নাটকীয় পরিবেশের মাধ্যমে ছন্দে গানে বিবৃত কাহিনিই আসলে লোকগীতিকা। গীতিকার ক্ষেত্রে কাহিনি বড় কথা নয়, কাহিনিটি কিভাবে বিবৃত হল, সেটাই বড় কথা। আর এই বর্ণনার মধ্যে যে অ্যাকশ্ন ফুটে ওঠে, লোকগীতিকার ক্ষেত্রে সেটাই হল প্রাণ। মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রবতী, দস্যু কেনারামের পালা প্রভৃতি হল গীতিকার উদাহরণ।

লোকসংগীত

পশ্চিমবাংলা বা পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত (ইংরেজি: Folk music of West Bengal) হচ্ছে প্রধান তিনটি ধারার প্রায় কুড়ির অধিক ধরনের লোকসংগীত। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে মুখে মুখে প্রচলিত ও সমাজে নিজস্ব ধারার স্বীকৃত গানগুলিই পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীতের রূপ ও বিষয়গত বৈচিত্র্য এই সংগীতকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ডান করেছে। প্রধানত দেশের প্রত্যক্ষ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে এই পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা লোকসঙ্গীতের সুর-বৈচিত্র্য।

আরো পড়ুন:  প্রলেতারিয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

মূল নিবন্ধ: পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত হচ্ছে প্রধান তিনটি ধারার প্রায় কুড়ি ধরনের লোকসংগীত

ভাটিয়ালি, বাউল ও ঝুমুর গানের বিভিন্ন উপধারা নিয়ে গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত। এদের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের লোকসংগীতের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হলো ঝুমুর। তাছাড়াও পশ্চিমাঞ্চলের সব ধারার গানের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই ঝুমুর সুরের একটা নিজস্বতা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!