সহজাত প্রবৃত্তি একটি বিশেষ জটিল আচরণের প্রতি জীবন্ত জীবের প্রবণতা

সহজাত প্রবৃত্তি, সহজাত প্রতিক্রিয়া বা অচেতন প্রতিক্রিয়া বা জন্মগত আচরণ (ইংরেজি: Instinct বা innate behavior) হচ্ছে একটি বিশেষ জটিল আচরণের প্রতি একটি জীবন্ত জীবের অন্তর্নিহিত প্রবণতা। উত্তেজনা অর্থাৎ পরিবেশের সংস্পর্শে প্রাণীমাত্রেরই একটা প্রতিক্রিয়া ঘটে। উত্তেজকের প্রভাবে প্রাণী তার দেহে সাড়া দেয়। উন্নত বা জটিল প্রাণী, বিশেষ ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া প্রধানত দুরকমের অচেতন এবং সচেতন। নিম্নতর প্রাণীর মধ্যে অচেতন প্রতিক্রিয়ার পরিমাণই অধিক।

কীট-পতঙ্গ অতি নিম্নমানের প্রাণী। জীবন রক্ষার জন্য পরিবেশের সঙ্গে তাদের খাপ খাইয়ে চলতে হয়। এজন্য তাদের বিভিন্ন প্রকার প্রতিক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হয়; কিন্তু এ সমস্ত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিবেচনা সম্মত চিন্তা আছে বলে আমরা মনে করি না। এ জন্যই এরূপ প্রতিক্রিয়াকে প্রাণীর অচেতন, প্রাথমিক কিংবা সহজাত প্রতিক্রিয়া বলা হয়।

মানুষের ব্যবহারের প্রধান ভাগ সচেতন। কিন্তু ব্যবহার বা প্রতিক্রিয়ার একটা ভাগ অচেতন বা সহজাত সাড়া দিয়ে গঠিত। আঙুলের ডগায় সুঁচ ফুটলে বা প্রজ্জ্বলিত দীপকাঠি স্পর্শ করলে শিশু হতে বৃদ্ধ সকলেই অবিলম্বে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। চোখে তীব্র আলোর প্রক্ষেপ ঘটলে আমাদের সবার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। কোনো উত্তেজকের জবাবে দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এরূপ প্রতিক্রিয়াকে সহজাত প্রতিক্রিয়া বলা হয়। রুশ মনোবিজ্ঞানী পাভলভের মতে মানুষ বা মনুষ্যত্বের প্রাণীর সহজাত প্রতিক্রিয়াগুলি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত অণুক্রিয়া বা আনকন্ডিশান্ড রিফ্লেক্স অ্যাকশন। তাঁর মতে অণুক্রিয়া বলতে উত্তেজকের জবাবে দেহের অঙ্গাদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে সেই আচরণকে বুঝায়। অণুক্রিয়াকে যে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রিত করে ‘নিয়ন্ত্রিত অনুক্রিয়া’ বা কনডিশন্ড রিফ্লেক্সের সৃষ্টি করা যায় তা তাঁর কুকুরের বিখ্যাত পরীক্ষায় প্রমাণ করেন।

সহজাত প্রতিক্রিয়া অভিজ্ঞতাপূর্ব। কোনো প্রাণীর পক্ষে একে শিক্ষা করার আবশ্যক হয় না। বাবুই পাখির বাচ্চা ভিন্নতর পরিবেশে লালিত হলেও সে তার জাতির অন্যান্য পাখির মতোই বাসা বানাতে পারবে। এই মত অনুযায়ী সহজাত এবং সচেতন ব্যবহার পরস্পর বিরোধী। কিন্তু অনেকে সহজাত এবং সচেতন প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগহীন বিরোধিতার কথা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে যা আজ সহজাত বলে মনে হচ্ছে সে আচরণ যুগ যুগ ব্যাপী সচেতন পূর্বশিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি হতে পারে। মানুষের হাঁটার ছন্দটি পরিণত বয়সে সহজাত বলে বোধ হতে পারে। কিন্তু শিশুকালে তাকে হাঁটতে শিখতে হয়েছে। সেই দীর্ঘ পরিচর্যার ফলে হাঁটার ছন্দ পরবর্তীকালে সহজাত বলে বোধ হয়।

আরো পড়ুন:  ঈথার কাকে বলে?

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২৯-২৩০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!