বাঙলার নদীরা কেন মরে যায়?

আমাদের নদীগুলোর নাম খুব সুন্দর। জনগণের সৃজনশীলতা ও তাদের শক্তি বুঝতে গেলে এই নদীগুলোর নাম স্মরণ করা যেতে পারে। একটু অপরিচিত কয়েকটি নদীর নামগুলোর দিকে চোখ ফেরালে পাই সন্ধ্যা, সুগন্ধা, জয়ন্তী, দড়াটানা, ফটকি, দুধকুমার, শুক, পায়রা, চন্দনা, কমলা, পারুল, পাগলী, ময়ূরাক্ষী, জলাঙ্গী, কালিন্দীর ন্যায় কয়েকশত কাব্যিক নাম। এমন সুন্দর নামগুলো হারাতে বসেছে সেই এলাকার মানুষেরা। কারণ নদীগুলোই যে মরতে বসেছে বা মারা গেছে। যেমন, স্বরমঙ্গলা নদীটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে রাজশাহী অঞ্চল থেকে। বড়চকপাড়ায় এসে স্বরমঙ্গলা নদীটি একটি গভীর খাতের সৃষ্টি করেছিল, যেটি যুগ যুগ ধরে একটি বড় পুকুরের রূপে টিকে ছিল। নদীটি মরে গেলেও পুকুরটি টিকে থাকাতে এলাকার লোকজন পুকুরটিকেই স্বরমঙ্গলা নামে এতোকাল অভিহিত করে এসেছেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে শহরের পুকুর ভরাটকারী এক ব্যবসায়ী শতশত ট্রাক বালু ফেলে ঐ ঐতিহাসিক জলাশয়টি ভরাট করে ফেলেছেন।[১] এইরকম আরো নানা কারণে বাঙলার নদীরা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতির আর বাস্তবের মানচিত্র থেকে।

সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা এক নদী, আলোকচিত্র: বিজন সম্মানিত

উত্তরবঙ্গে বড় বড় শালবন ছিল, বিশেষ করে রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলে, ব্রিটিশরা সেগুলো কেটে সেখানে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করেছিল। দেশভাগের পর ব্রিটিশ সরকার ততকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকারকে একটি দলিলে বলে যে, উত্তরাঞ্চল যেহেতু মরুপ্রবণ, এই গাছগুলো যদি সেখানে আবার লাগানো না হয় তাহলে, উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হয়ে যাবে।

১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান বা পাকিস্তান পরবর্তী কোনো সরকার সেখানে আবার শালগাছগুলো লাগাতে বা জনগণকে সরাতে চায়নি। আর ভারতে সেদেশের উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, প্রতিক্রিয়াশীল গান্ধীপন্থি সেই রাজনীতিক হিমালয়ের পাদদেশে বিস্তৃত তরাই অঞ্চল আবাদ করার জন্য ভূমিহীনদের বিনামূল্যে জমি বিতরণ করে। প্রকৃতির স্বাভাবিকতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য বনটি এভাবেই ধ্বংস হয়ে যায়।

বন ধ্বংসের পরে কিছুদিন সেখানে ফসল ভালোই হয়েছিল তারপর নদীগুলো সব শুকিয়ে যায়, জলসেচের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা আজ এই ধ্বংসযজ্ঞের ভুক্তভোগী। হিমালয় ও তরাই অঞ্চলের গাছপালা কাটার ফলে বনের বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ক্ষমতা ৪০ থেকে ২০ শতাংশে নেমে আসে, ত্বরিৎ বন্যা দেখা দেয়, শীতে নদী শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং নদী ও জলাশয় অধিক পলিতে ভরাট হতে থাকে।[২]

উত্তরবঙ্গের যে শালবন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ধ্বংস করেছিল সেই সাম্রাজ্যবাদের উত্তরসূরি ও তল্পিবাহক আজকের আওয়ামী লীগ গত ৩০ এপ্রিল, ২০১৪ তারিখে প্রায় ১৮০০ একর বনভূমি ধ্বংস করার অনুমতি দিল কক্সবাজারের রামুতে। সেখানকার “এই ভূমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হবে। এছাড়াও ঐ অঞ্চলে দুটি নতুন সেনানিবাসসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনার জন্য মোট ৪৮ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে প্রথম আলো।[৩] তবে পাহাড়ি বনভূমিতে সেনা ক্যান্টনমেন্ট চালুর প্রক্রিয়া ১৯৪৭ পরবর্তী কোনো সরকারই থামায়নি, সে যত বড় মহামানব(?) মুজিব-জিয়া-এরশাদ হোক না কেন?

নদীর বিলুপ্তিতে উজানের দেশের অপকর্ম থাকলেও সেটিই একমাত্র কারণ নয়। আমাদের নিজেদের ভুলত্রুটিও রয়েছে। যে নদী শত শত বছর ধরে নাব্য থেকে আমাদের যাতায়াতের পথ সুগম করেছে তার উৎসমুখে যখন বালিয়াড়ি পড়ে প্রবাহ রুদ্ধ হতে থাকে তখন আমরা থাকি উদাসীন। অনেক নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে নদী মেরে ফেললে প্রচুর জমি দখলের বন্দোবস্ত হয়। উৎসমুখে বালি জমে মারা গেছে বা মৃত্যুর প্রহর গুনছে নারদ, বড়াল, ইছামতি, গড়াই, কপোতাক্ষ, ভৈরব।[৪] ২০০৪ সালে লালনের আখড়ার পাশ দিয়ে এককালে বয়ে যাওয়া কালিগাঙ বা কালীগঙ্গার উৎসমুখ খুঁজে পেতে অনেক ঘুরতে হয়েছিল। ২০১৪ সালে কালীগঙ্গার উৎসমুখ কী আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে। যেই কালীগঙ্গায় ভেসে লালন ছেউড়িয়ায় পৌঁছেছিলেন, সেই কালীগঙ্গা আজ আর নেই। কেননা গোয়ালন্দ-কলকাতা রেললাইন স্থাপনকালে মাত্র তিন কিলোমিটারের ব্যবধানে দুটো ব্রিজ স্থাপনের ব্যয় ও শ্রম বাঁচানোর জন্য একটি নদী ভরাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। কালীগঙ্গা ভাঙনবিহীন ও প্রশস্ততা কম বিবেচনায় সেটিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৪টি কালীগঙ্গা নামের নদী থাকলেই গড়াইয়ের শাখা এবং পদ্মার একটি প্রশাখা কুষ্টিয়ার কালীগঙ্গা নদী হত্যার কথা এখানে বলা হচ্ছে।[৫]

আরো পড়ুন:  নেহারা নদী বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সদর এবং রাণীসংকৈল উপজেলার নদী

বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ হয়েছে নদীগুলোকে মেরে ফেলা। পাউবোর প্রকৌশলী আর নদী বিশেষজ্ঞরা বাঁধ নির্মাণ, বাঁধ ভাঙন রোধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ ছাড়া আর কিছু জানে না; আর এই কাজগুলোর সাথে জড়িয়ে গেছে ঠিকাদারি লুটপাট ও টাকা লোপাট। পুরো উত্তরবঙ্গে অপ্রয়োজনীয় স্লুইস গেট দিয়ে সব নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। স্লুইস গেট তৈরির কারণে মাছসহ সমস্ত জলজ প্রাণের জীবনচক্রে প্রভাব পড়ে আজ বাংলাদেশ মাছহীন এবং নদীহীন। পৃথিবীর বড় বড় মিঠাপানির ক্ষেত্রগুলিতে নেই কোনো প্রাকৃতিক মাছ। তিস্তা নদীতে দোয়ানি ব্যারেজ দিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পানি ব্যবসা চলে। ভূগর্ভস্থ এবং সঞ্চিত, যেরকমই পানি হোক, সেচের পানি পেতে হলে কৃষককে নগদ টাকা গুনতে হয়।

বাঁধ দিয়ে নদী মেরে ফেলার একটি অনন্য দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হচ্ছে ছাতক-সুনামগঞ্জ উপজেলা সড়ক পথে সুরমার একটি ছোট শাখা, যা পানগাঁও ও কুমারগাঁয়ের মাঝে অবস্থিত ছিল। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে পাকিস্তান আমলে তা বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হয়।

কাপ্তাই বাঁধের কথা কী কহিব আর। এই বাঁধ তৈরি করে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত তৈরির জন্য সেনাবাহিনীকে রাখতে হয়েছে পাহাড়ে। অন্য জাতিগুলোকে শোষণের ও নির্যাতনের এক অমর প্রতীক হয়ে আছে এই বাঁধটি যার জলের পরিমাণ চোখের জলের চেয়ে অনেক কম।

মাগুরা জেলা শহর নবগঙ্গার পাড়ে অবস্থিত। নবগঙ্গা শহরে বাঁক নিয়েই এটি কুমার নাম ধারণ করেছে। শহরের দশ কিলোমিটার দূর দিয়ে বয়ে গেছে ফটকি নদী। মূলত বাঁধের কারণেই এই নদীগুলো মরে গেছে। বর্ষায় পানি জমে, নদীর প্রবাহ-জোয়ার-ভাটা, এসব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

২০০২-৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলের মাঝ দিয়ে বনপাড়া-হটিকুমরুল নামের জাতীয় মহাসড়ক তৈরি করে এই বিল এবং তার ভেতরের নদীগুলোকে মারা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে স্লুইস গেট নির্মাণের পর থেকে বড়াল নদী দিয়ে চলন বিলের পথে মিঠা পানির মাছের সহজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। আত্রাইয়ের পরেই চলন বিলের প্রধান নদী হচ্ছে বড়াল। বর্ষার শুরুতে পদ্মা, যমুনা, তিস্তার শত শত প্রজাতির স্বাদু পানির মা মাছ যাদেরকে ব্রুডফিস (Broodfish) বলা হয়, এগুলো আত্রাই, বড়াল, নন্দকুজা, নাগর, চিকনাই ইত্যাদি নদী দিয়ে চলন বিলে প্রবেশ করতো। নদীগুলো দিয়ে আসা পোনা মাছ বা ডিম থেকে সৃষ্ট পোনা চলন বিলে থাকা পর্যাপ্ত খাবার পেয়ে আস্তে আস্তে বাড়ে। বর্ষা শেষে পোনা মাছগুলো একটু বড় হয়ে বড় নদীগুলোতে ফিরে যায়। এভাবেই শত শত বছর ধরে চলন বিলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় বড় নদ নদীর পার্শ্বে থাকা বিল, হাওর, বাওড় ও অন্যান্য জলাভূমিতে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটেছে।[৬] উনিশ শতকের শেষ দিকে চলনবিলের আয়তন ছিল ১০০০ বর্গকিমির উপরে। কিন্তু ১৯০৯ সালের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে বিলের আয়তন ক্রমে ক্রমে কমে ৩৭০ বর্গ কিমিতে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে আবার সারা বছর পানি থাকে মাত্র ৮৫ বর্গকিমি এলাকায়। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে এর আয়তন দাড়ায় মাত্র ২৫.৯ বর্গ কিমি। প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫) চলন বিলের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, অনুমেয় ৪০০ বছর পূর্বে চলন বিলটি রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা জেলার অধিকাংশ এলাকায় বিরাজ করত। তার মতে, ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা নদীর সঙ্গম স্থানের পশ্চিম-উত্তর অংশজুড়ে ছিল চলন বিল। তিনি এই বিলকে উত্তর বাংলার নাভিকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[৭] কিন্তু আজ এই নাভিকেন্দ্রটি মৃতপ্রায় এক জলাধার।

আরো পড়ুন:  নদীবিধৌত নেত্রকোনা জেলায় অবস্থিত ৮৫টি নদনদীর নামের তালিকা

স্লুইস গেট, বাঁধ, কালভার্ট, ব্রিজের কারণে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক যাতায়াতের পথ, জনগণের হাজার বছরের সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ নৌপথ ধ্বংস ও রুদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের নদীপথকে বিলুপ্ত করে জাপান-ভারত ও বিশ্বব্যাংকের প্ররোচনায় গাড়ি চালানোর জন্যে যত্রতত্র সড়ক নির্মাণ করে মাছের বিলুপ্তি ত্বরান্বিত করে যে ক্ষতি করা হয়েছে তা পূরণ হবার নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অপরিকল্পিত স্লুইস গেট, ক্রস ড্যাম, রাবার ড্যাম, শহর রক্ষা বা নদী রক্ষা বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ আমাদের নদীগুলোকে জীববৈচিত্র্যসহ মেরে ফেলেছে।

স্লুইস গেট ও পাকা ক্রস ড্যাম নির্মাণ করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সাক্ষী রাজশাহীর পুঠিয়ার নদী মুসা খান। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আলাদাভবে এ-নদীটিকে গিনিপিগ বানিয়ে তাদের খামখেয়ালি পরীক্ষার কাজ এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। এই দুই গণবিরোধী আমলাতান্ত্রিক দুটি সংস্থা মুসা খান নদীর উৎস হতে ৩০০ মিটার উত্তরে একটি স্লুইস গেট এবং এই নদীর ভাটিতে বাকসর নামক স্থানে গদাই নদীর উপর আরেকটি স্লুইস গেট বানিয়ে পানির প্রবাহপথ বন্ধ করে দিয়েছেন। অপরদিকে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই নদীর বিভিন্ন স্থানে পাকা ক্রস ড্যাম বানিয়েছে পাঁচটি। এই দুই সংস্থার অপকর্মে ধুঁকে ধুঁকে মরছে মুসা খান নদী। এলাকার সব কৃষকের দাবি চারঘাট স্লুইস গেটসহ নদীর উপর বাধা সৃষ্টিকারী সকল বাঁধ সরিয়ে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে।[৮] মুসা খানের মতোই উত্তরবঙ্গের প্রায় সকল নদীর অভিজ্ঞতা।

১৯৭২ সালে মেঘালয় পাহাড়ের উপর দিয়ে শিলং হতে টেকেরঘাট রাস্তাটির নির্মাণ করা হয়। এতে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে মেঘালয়ের পাহাড়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে কয়লা ও উন্মুক্তভাবে চুনাপাথর খননের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। গত ছয় দশকে মেঘালয়ের পাহাড়ের উপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে সড়ক, পাহাড় কেটে চালানো হয়েছে নানা তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। পাহাড়ের গাছ কাটাও বেড়ে গেছে, ফলে পাহাড়ের পানিধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এসব কারণে পাহাড়ি বালি, পাথর ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ নেমে হাওরাঞ্চলের নদীর পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ধর্মাসীমান্ত পর্যন্ত বৃহত্তর ভারতের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য ভৈরবে রেলসেতু নির্মিত হলে বর্ষার পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক পথগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ে।[৯] ১৯৯০’র বছরগুলোর প্রথমার্ধে মেঘনা-গোমতীর উপর দুটি সেতু নির্মাণ হলে নদীগুলোর সংকোচনের ষোলোকলা পূর্ণ হয়। ফলে এখন হাওরাঞ্চলে বন্যা হলে এক-দুই মাস এই পানি নামতে লেগে যায়।

শতশত বছর ধরে ঋতুভিত্তিক বন্যার সাথে কৃষকের এক ধরনের অভিজ্ঞতার সম্পর্ক ছিল। কখন কোন নদী দিয়ে কোন হাওরে কী মাসে পাহাড়ি ঢলের পানি নামবে তার একটা নিয়মরীতি তাদের জানাশোনা ছিল। কিন্তু ১৯৭০ পরবর্তীকালে এ নিয়মরীতি একেবারেই ভেঙে গেছে। এখন যখন তখন যেকোনো জায়গা দিয়েই নামে পাহাড়ি ঢল; আবার প্রয়োজনের সময় সেই ঢলের দেখা পাওয়া যায় না।

বাঙলার নদীগুলোর কতটুকু ভূমি দখল হয়ে গেছে তার হিসেব কেউ রাখেনি। ঢাকা শহর ও তার পাশের জেলাগুলোর নদীগুলোকে দখল করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। দূষণও হয়েছে সবচেয়ে বেশি এই অঞ্চলে। এরপরেই দূষণ ও দখল হয়েছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী। এই তিন শহরে জমির দামও বেড়েছে পাগলা ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে। বাংলাদেশ হবার পরে যে নির্বিকার মধ্যবিত্ত বেড়েছে তারাই লোভাতুর-চিত্তে ধ্বংস করেছে এই নদীগুলোকে। ব্যবসা আর মুনাফার বলি হয়েছে বাঙলার নদীগুলো। নগরায়নের প্রথম ফল হিসবে নগর দিয়ে বয়ে যাওয়া টলটলে জলের নদীগুলো নর্দমা হয়েছে। সারা দেশের জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এখনকার নদী নামধারী নর্দমাগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ফলে ২০১৪ সালে এসে চেনা কঠিন কোনটি নদী আর কোনটি নর্দমা?

আরো পড়ুন:  গঙ্গা-পদ্মা নদী প্রণালী পৃথিবীর বৃহৎ নদীপ্রণালীগুলোর মধ্যে অন্যতম

সবশেষে ভারত প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভারতে পানির প্রাপ্যতা পানির প্রয়োজনের চেয়ে ৭ গুণ বেশি। ভারত তাদের দেশে প্রাপ্য পানির মাত্র ১৫ শতাংশ ব্যবহার করলে নদীতে বাঁধ বা ব্যারাজ দিয়ে উজানে বাংলাদেশের পানি সরানোর কোনো প্রয়োজন হয় না। কাজেই ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা নদীগুলোতে বাঁধ এবং ব্যারাজ দিয়ে উজানে বাংলাদেশের পানি সরানোর কোনো যুক্তি নেই। অভিন্ন নদীর উজানে ভারত যেসব বাঁধ দিয়েছে এবং দিচ্ছে, সবই রাজনৈতিক বাঁধ। এর মাধ্যমে উজানের একটি বৃহৎ দেশ ভাটির একটি ছোট দেশকে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করতে যেমন চায়[১০], তেমনি আরো চায় ভারতের কৃষকদেরকে পঙ্গু ও সাম্রাজ্যবাদনির্ভর, সেচনির্ভর, কর্পোরেটের হাইব্রিড বীজনির্ভর করতে।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের অভিন্ন নদী ৫৭টি। এই সাতান্নটি নদীর উজানে ভারত মোট কতটি বাঁধ দিয়েছে তা আমাদের জানা নেই, যেমন আমাদের জানা নেই বাংলাদেশের ভেতরে মোট কতটি বাঁধ দেয়া হয়েছে নদীগুলোর উপরে। শুধু ফারাক্কার কথা বলা এখন অর্থহীন। কেননা ব্রহ্মপুত্র ছাড়া সব নদীতেই নানা ধরনের বাঁধ দেয়া হয়েছে। এই বাঁধ দেয়ার উদ্দেশ্য শুধু কৃষি জমিতে সেচ দেয়া বা বন্যা নিয়ন্ত্রণই নয়, এসব বাঁধ দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য পানিকেন্দ্রিক ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধি করা, কৃষকদেরকে কর্পোরেট কোম্পানিনির্ভর করা এবং তাঁদেরকে ভূমি থেকে উৎখাত করা। ভূমি থেকে উৎখাত হলে কৃষকগণ শহরে ভিড় করবেন, আর আম্বানি-টাটা-বিড়লা-জিন্দাল-মিত্তালরা সস্তায় এঁদেরকে কারখানায় কাজে লাগাতে পারবে। পুঁজিবাদসাম্রাজ্যবাদের গত চারশ বছরের এই একই নিয়ম চলছে গোটা দুনিয়ায়; কৃষি থেকে উৎখাত করো, শহরে সস্তায় শ্রমিকের জোগান বাড়াও। এর সমাধান একটি পথেই—পুঁজির উৎখাত। পরিবেশবাদী আন্দোলন দিয়ে নদীকে বাচানো যাবে না। যতদিন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আছে ততদিন নদী মরবেই; যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত যে নীতি আমরা দেখেছি তা মোটেই সুবিধাজনক ছিল না।

তথ্যসূত্র:  

১. মাহবুব সিদ্দিকী, ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ; দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা-৯০।

২. দ্বিজেন শর্মা, “এ এক অশনিসংকেত”, ৩০ এপ্রিল, ২০১৪, বাংলানিউজ, ইউআরএল: <http://www.banglanews24.com/opinion/news/bd/286341.details>।

৩. নিজস্ব প্রতিবেদক, “সেনানিবাসের জন্য ১৮০০ একর বনভূমি বরাদ্দ” এপ্রিল ২৯, ২০১৪, প্রথম আলো; ইউআরএল: http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/204508/

৪. মাহবুব সিদ্দিকী, ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ; দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা-৯৫।

৫. ড. অশোক বিশ্বাস; বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা-১৬১-১৬২।

৬. মাহবুব সিদ্দিকী, ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ; দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা-৬২-৬৩।

৭. ড. অশোক বিশ্বাস; বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা-১২১।

৮. মাহবুব সিদ্দিকী, ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ; দিব্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা-১৭২।

৯. এ.এস.এম. ইউনুছ, হাওরবাসীর জীবনকথা; চারুলিপি, ঢাকা; মে, ২০১০, পৃষ্ঠা-১৬৭-১৭০।

১০. ড. এস আই খান, অভিন্ন নদী অববাহিকাভিত্তিক পানির সুষম বণ্টন চাই, দৈনিক সমকাল, সম্পাদক : গোলাম সারওয়ার প্রকাশক : এ কে আজাদ; ২৭ এপ্রিল, ২০১৪ উপসম্পাদকীয়, পৃষ্ঠা ৪।

রচনাকালঃ মে ২০১৪

Leave a Comment

error: Content is protected !!