(পার্টির নিয়মাবলির প্রথম অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে)
‘রাশিয়া এক এবং অবিভাজ্য’ যখন লোকে জোর গলায় এ কথা বলতো সেদিন চলে গেছে। আজ একটি শিশুও জানে এক এবং অবিভাজ্য রাশিয়া বলে কিছু নেই, অনেক আগেই রাশিয়া ভাগ হয়ে গেছে- বুজোয়া ও শ্রমিক এই দুটি বিরোধী শ্রেণিতে। আজ আর এ কথাটি গোপন নেই যে, এই দুটি শ্রেণির সংঘর্ষকে কেন্দ্র করেই আমাদের বর্তমান জীবন অতিবাহিত হচ্ছে।
অবশ্য কিছুদিন আমাদের এসব লক্ষ্য করা কঠিন ছিল- কারণ সেদিন পর্যন্ত শুধু আলাদা আলাদা গোষ্ঠীগুলোই সংগ্রামের ময়দানে দেখতে পেয়েছি; কেননা বিভিন্ন শহর ও দেশের বিভিন্ন অংশে শুধু আলাদা আলাদা গোষ্ঠীগুলোই সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে এবং বুর্জোয়া ও শ্রমিকরা শ্রেণি হিসাবে সহজে স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ত না। কিন্তু এখন শহর ও জেলা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন গোষ্ঠী হাতে হাত মিলিয়েছে, যুক্ত ধর্মঘট ও বিভোক্ষে ফেটে পড়েছে, আর আমাদের সামনে ভেসে উঠেছে বুর্জোয়া রাশিয়া ও শ্রমিক রাশিয়া এ দুইয়ের সংঘাতের অপরূপ দৃশ্যটি। দুইটি বিপুল সেনাবাহিনী- শ্রমিক শ্রেণির বাহিনী ও বুর্জোয়া শ্রেণির বাহিনী- আজ সংগ্রামের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে এবং দুই বাহিনীর সংগ্রাম আমাদের সমগ্র সমাজ জীবনকে ছেয়ে ফেলেছে।
একটা সেনাবাহিনী যেমন নায়কবিহীনভাবে চলতে পারে না, প্রতিটি সেনাবাহিনীর যেমন একটি অগ্রবাহিনী থাকে যারা আগে এগিয়ে পথকে আলোময় করে রাখে, তেমনি এটাও স্পষ্ট যে, এই দুইটি সেনাবাহিনীরও দরকার নিজ নিজ উপযুক্ত নেতৃগোষ্ঠী; সাধারণভাবে যাকে বলা হয় পার্টি।
তাহলে ছবিটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম: একদিকে লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে বুর্জোয়া শ্রেণির বাহিনী; অন্যদিকে সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণির বাহিনী; প্রত্যেকটি বাহিনীর তাদের পরিচালিত শ্রেণি সংগ্রামে নিজ নিজ পার্টির নেতৃত্বে চলছে।
এসবের উল্লেখ আমরা করছি শ্রমিক শ্রেণির পার্টিকে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে তুলনা করার এবং এভাবে পার্টির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে সামনে তুলে ধরার জন্যে।
উপরে এই বক্তব্য থেকে এ কথা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে উঠে যে নেতাদের সংগ্রামী গোষ্ঠী হিসাবে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি, প্রথমতঃ সভ্য সংখ্যার দিক থেকে শ্রমিক শ্রেণির তুলনায় অবশ্যই অনেক ছোট হবে। দ্বিতীয়তঃ উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি শ্রমিক শ্রেণি থেকে শ্রেয় হবেই, আর তৃতীয়তঃ পার্টি হবে একটি সুসংবদ্ধ সংগঠন।
যা বলা হল, আমাদের মতে তার প্রমাণের কোন দরকার পড়ে না। কারণ যতক্ষণ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকবে আর তার অনিবার্য অনুসঙ্গ হিসাবে জনগণের দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতা বহাল থাকবে ততদিন শ্রমিক শ্রেণি সামগ্রিকভাবে শ্রেণি চেতনার বাঞ্ছিত স্তরে উন্নীত হতে পারে না। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণির বাহিনীকে সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্দীপ্ত করে তোলার জন্যে, তাকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার সংগ্রামে নেতৃত্বদানের জন্যে তার একদল শ্রেণি সচেতন নেতা থাকবেনই। এটাও পরিষ্কার, যে পার্টি সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণিকে নেতৃত্বদানের পথ গ্রহণ করছে, তাকে আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠা কতকগুলো ব্যক্তির সমষ্টিমাত্র হলে চলবে না; তাকে হতে হবে সুসংহত এবং কেন্দ্রীভূত একটা সংগঠন যাতে একটি মাত্র পরিকল্পনা অনুসারে তার কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারে।
সংক্ষেপে গুলোই হল আমাদের পার্টির সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
এসব
কথা মনে রেখে এবার মূল প্রশ্নে আসা যাক; কাকে আমরা পার্টিসভ্য আখ্যা দেব?
বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় পার্টির নিয়মাবলির প্রথম অনুচ্ছেদে ঠিক এই
প্রশ্নটি নিয়েই আলোচনা করা হবে।
অতএব এই প্রশ্নটি বিচার করা যাক।
রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির সভ্য বলতে পারি অর্থাৎ একজন পার্টি সভ্যের কর্তব্য কি কি?
আমাদের পার্টি হল একটা সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি। তার অর্থ হল তার একটা নিজস্ব কর্মসূচি (আন্দোলনের আশু এবং চরম লক্ষ্য) রয়েছে, নিজস্ব রণকৌশল (সংগ্রামের কায়দা) রয়েছে এবং নিজস্ব সাংগঠনিক নীতি (সংগঠনের রূপ) রয়েছে। কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণার ভিত্তিতেই আমাদের পার্টি গড়ে উঠেছে। এই ধ্যানধারণার ঐক্যই আমাদের পার্টিসভ্যদের একটি কেন্দ্রীভূত পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। ধ্যানধারণার এই ঐক্য যদি চুরমার হয়ে যায়, পার্টিও চুরমান হয়ে যায়। সুতরাং যিনি পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল, সংগঠনগত রীতিকে পুরোপুরি মেনে নেবেন তাকেই পার্টিসভ্য বলা চলবে। আমাদের পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণাকে যিনি ভালভাবে অধ্যায়ন করেছেন এবং পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন তিনিই পার্টিসভ্যের একজন এবং এভাবে শ্রমিক শ্রেণির সেনাবাহিনীর নেতাদের একজন হতে পারেন।
কিন্তু শুধু পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণা গ্রহণ করাই কি একজন পার্টিসভ্যের পক্ষে যথেষ্ট? এরকম একজন লোককে কি শ্রমিক শ্রেণির সেনাবাহিনীর একজন যথার্থ নেতা বলে গণ্য করা চলে? নিশ্চয়ই না! প্রথমতঃ সকলেই জানেন যে, দুনিয়ার এমন অনেক বাক্যবাগীশ আছে যারা পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণা বিনা প্রতিবাদেই ‘মেনে নেবে’- অথচ যাদের গলাবাজি ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। এরকম একজন বাক্যবাগীশকে পার্টির সভ্য পার্টির (অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণির সেনাবাহিনীর একজন নেতা) আখ্যা দেওয়ার অর্থ পার্টিকে নষ্ট করে দেওয়া। তাছাড়া আমাদের পার্টি একটা দার্শনিক সম্প্রদায় অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীও নয়। আমাদের পার্টি কি একটা সংগ্রামী পার্টি নয়? আর সে জন্যই কি এটা স্বতঃসিদ্ধ নয় যে এর কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণার নিরাসক্ত স্বীকৃতিতেই আমাদের পার্টি সন্তুষ্ট থাকতে পারে, পার্টি সভ্যরা যা স্বীকার করে নিয়েছেন তা তারা বাস্তবে প্রয়োগও করবেন, পার্টি নিঃসন্দেহে এই দাবিও আমাদের কাছে করবে। সুতরাং যিনিই আমাদের পার্টি সভ্য হতে ইচ্ছুক তিনি শুধু পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না, সেগুলো বাস্তব প্রয়োগ, কার্যক্ষেত্রে সেগুলোকে ব্যবহারও তাকে করতেই হবে।
কিন্তু একজন পার্টি সভ্যের পক্ষে পার্টির ধ্যানধারণার বাস্তব প্রয়োগ বলতে কী বোঝায়? কখন তিনি এইসব ধ্যানধারণা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবেন? শুধু তখনই যখন তিনি লড়াই করবেন, যখন তিনি সমগ্র পার্টিকে নিয়ে শ্রমিক শ্রেণির সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলবেন। সংগ্রাম কি কখনও একক, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে চালানো সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়, বরং ঠিক উল্টো- জনগণ প্রথমে ঐক্যবদ্ধ হন, সংগঠিত হন তারপর তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তা যদি না করা হয়, সমস্ত সংগ্রামই হয় নিষ্ফল। তাহলে এটা পরিষ্কার যে, পার্টি সভ্যরা যদি একটা সুসংবদ্ধ সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হন একমাত্র তখনই তারা সংগ্রাম করতে পারবেন এবং তার ফলে পার্টির ধ্যানধারণা বাস্তবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন। এটাও পরিষ্কার যে পার্টি সভ্যেরা যে সংগঠনে সংঘবদ্ধ হবেন তা যত সুসংবদ্ধ হবে, তারা তত ভাল লড়াই করতে পারবেন, পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণাকে তত বেশি পূর্ণতরভাবে তারা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবেন। আমাদের পার্টি কতকগুলো ব্যক্তিমাত্রেরই সমষ্টি, আমাদের পার্টি হল নেতাদের সংগঠন- একথা অকারণে বলা হয় না। এবং যেহেতু পার্টি হল নেতাদের সংগঠন, সেহেতু এটা স্পষ্ট যে একমাত্র তাদেরই এই পার্টির ও সংগঠনের সভ্য বলে গণ্য করা চলে। যারা এই সংগঠনে কাজ করেন এবং স্বভাবতঃই পার্টির ইচ্ছার সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে মিলিয়ে দেওয়াকে এবং পার্টির সঙ্গে একাত্বভাবে কাজ করাকে তাদের কর্তব্য বলে মনে করেন।
সুতরাং একজন পার্টিসভ্য হতে হলে পার্টির কর্মসূচি, রণকৌশল ও সংগঠনগত ধ্যানধারণার বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে; আর তা প্রয়োগ করতে গেলে তার জন্য লড়াই করতে হবে; এইসব মতামতের জন্যে লড়াই করতে হলে একটা পার্টি সংগঠনের মধ্য থেকে এবং পার্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে থাকতেই হবে। একমাত্র যখন আমরা একটানা একটা পার্টি সংগঠনে যোগ দেই এবং এইভাবে আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ পার্টিস্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দিই- শুধু তখনই আমরা পার্টিসভ্য হতে পারি আর তার ফলে শ্রমিক শ্রেণির বাহিনীর প্রকৃত নেতা হয়ে উঠতে পারি।
যদি আমাদের পার্টি জনাকয়েক বাক্যবাগীশের একটা সমষ্টিমাত্র না হয়, এটা যদি নেতাদের এমন একটি সংগঠন হয় যা কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে দক্ষতার সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে উপরে লিখিত প্রতিটি কথাই স্বতঃসিদ্ধ হবে।
নিচের কথাগুলো লক্ষ্য করতে হবে।
এযাবৎকাল
আমাদের পার্টির ধরন-ধারণ ছিল অতিথিপরায়ণ কর্তা-শাষিত একটা পরিবারের মতো-
সকল দরদীর জন্যই সেখানে ঠাঁই ছিল। কিন্তু এখন পার্টি হয়েছে একটা
কেন্দ্রীভূত সংগঠন। গোষ্ঠী কর্তার শাসনের দিকটা খসে গিয়ে সব দিক থেকে তা
হয়ে উঠেছে একটা দুর্গের মতো, যার দরজা একমাত্র যোগ্য ব্যক্তিদের জন্যই
খোলা হয়। এটা আমাদের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বৈরতন্ত্র যখন
শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি চেতনাকে ‘ট্রেড ইউনিয়নবাদ’, জাতীয়তাবাদ,
ধর্মান্ধতা প্রভৃতির মাধ্যমে কলূষিত করার চেষ্টা করছে, আবার অন্যদিক থেকে
উদারনীতিবাগীশ বুদ্ধিজীবীর দল ক্রমাগত চেষ্টা করে চলেছে শ্রমিক শ্রেণির
রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যতাকে বিনষ্ট করতে এবং নিজেদের মাতব্বরি শ্রমিক
শ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিতে- তখন আমাদের খুব সতর্ক হতে হবে এবং আমাদের ভুলবে
চলবে না যে আমাদের পার্টি হল একটি দুর্গ; এই দুর্গের দরজা খোলা হবে কেবল
তাদেরই জন্য যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছেন।
পার্টির সভ্যদের দুটি আবশ্যিক শর্ত আমরা নির্ধারণ করেছি (পার্টির কর্মসূচি গ্রহণ এবং পার্টির একটি সংগঠনে থেকে কাজ করা)। এর সঙ্গে যদি তৃতীয় একটি শর্ত আমরা যুক্ত করি যে- একজন পার্টিসভ্যকে পাটিকে অর্থসাহায্য করতেই হবে- তাহলে পার্টিসভ্য আখ্যা লাভের প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্তই আমরা পেয়ে যাব।
সুতরাং রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির সভ্য তিনিই হবেন যিনি এই পার্টির কর্মসূচি গ্রহণ করেন, পার্টিকে আর্থিক সাহায্য দেন এবং পার্টির কোন একটা সংগঠনে কাজ করেন।
এইভাবেই কমরেড লেনিন তাঁর রচিত পার্টির নিয়মাবলির খসড়ার প্রথম অনুচ্ছেদটি প্রস্তুত করেছিলেন।
আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন পার্টি একটি কেন্দ্রীভূত সংগঠন এবং বিভিন্ন ব্যক্তির একটি সমষ্টিমাত্র নয়- এই ধারণা থেকেই এই সূত্রটির সম্পূর্ণ উদ্ভব ঘটেছে।
এখানেই আছে সূত্রটির সর্বময় শ্রেষ্ঠত্ব।
কিন্তু দেখা গেছে, কিছু কিছু কমরেড লেনিনের এই সূত্রকে ‘সঙ্কীর্ণ’ এবং
‘অসুবিধাজনক’ বলে বাতিল করে দেন এবং তাদের নিজস্ব একটি সূত্র এনে হাজির
করেন যা নাকি ‘সঙ্কীর্ণ’ ও ‘অসুবিধাজনক’ নয়। আমরা মার্তভের সূত্রের কথাই
বলছি এবং তা-ই এখন আমরা বিশ্লেষণ করব।
মার্তভের সূত্র হল- ‘রাশিয়ান
সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির সভ্য হলেন তিনি যিনি তার কর্মসূচিটি
গ্রহণ করেন, পার্টিকে আর্থিক সাহায্য দেন এবং তার কোন সংগঠনের নির্দেশ তাকে
নিয়মিত ব্যক্তিগত সাহায্য করেন।’ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এই সূত্রটি
পার্টি সভ্যপদের তৃতীয় আবশ্যিক শর্ত- পার্টি সংগঠনগুলির কোন একটিতে পার্টি
সভ্যদের কাজ করার কর্তব্যের কথাটি বাদ দিয়েছেন। মনে হয় মার্তভ সুস্পষ্ট ও
আবশ্যিক শর্তটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন এবং তার সূত্রে তিনি একটিও
জায়গায় অস্পষ্ট, ভাসাভাসা ‘কোন সংগঠনের নির্দেশ অনুসারে ব্যক্তিগত
সাহায্য’ কথাটি এনে উপস্থিত করেছেন। এ থেকে দেখা যাচ্ছে কোনও পার্টি
সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও (নিশ্চয়ই বলা যায় একটা চমৎকার পার্টিই
বটে!) এবং পার্টির ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করার বাধ্য বাধকতা না রেখেও
(নিশ্চয়ই বলা যায় চমৎকার পার্টি শৃঙ্খলা বটে!)- যে কেউ পার্টির সভ্য হতে
পারবেন। বেশ তো, পার্টিইবা কি করে নিয়মিত নির্দেশ দেবে সেইসব লোকদের যারা
পার্টির কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নেই এবং ফলে পার্টি শৃঙ্খলার কাছে আদৌ কোন
বাধ্যবধকতাও যাদের নেই।
এই প্রশ্নে মার্তভ রচিত পার্টির নিয়মাবলির খসড়া প্রথম অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত সূত্রটি ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু সূত্রটিতে এই প্রশ্নটির সুদক্ষ জবাব দেওয়া হয়েছে। কারণ তাতে পার্টিসভ্য পদের তৃতীয় ও আবশ্যিক শর্ত হিসাবে পার্টি সংগঠনের মধ্যে থেকে কাজ করার কথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে।
আমাদের যেটা করতে হবে তা হল মার্তভের
সূত্র থেকে অস্পষ্ট ও অর্থহীন ‘একটি পার্টি সংগঠনের নির্দেশ অনুসারে
নিয়মিত ব্যক্তিদের সাহায্যের’ কথাগুলি বাতিল করে দেওয়া। এই শর্তটি বাদ
দিয়ে মার্তভের সূত্রে দু’টি মাত্র শর্তই অবশিষ্ট থাকে (কর্মসূচিকে গ্রহণ
করা এবং আর্থিক সাহায্য করা) যা নিছক শর্ত হিসাবে নিতান্তই মূল্যহীন; কারণ
যে কোন বাক্যবাগীশ লোকই পার্টির কর্মসূচি গ্রহণ করে নিতে পারে এবং পার্টিকে
আর্থিক সাহায্য দিতে পারে; কিন্তু এসবের দ্বারা পার্টি সভ্যপদের সামান্যতম
যোগ্যতাও তার অর্জিত হয় না।
বলতেই হয় সূত্রটা খুবই সুবিধাজনক!
আমরা বলি সাচ্চা পার্টিসভ্যর পার্টির কর্মসূচিকে শুধু মেনে নিয়েই নিশ্চিত হতে পারে না, যে কর্মসূচি তাঁরা গ্রহণ করলেন সেটা বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা নিশ্চয়ই তাঁরা করবেন। মার্তভ জবাবে বলছেন: তোমরা ভীষণ কড়া; পার্টিকে আর্থিক সাহায্য করতে রাজি হলে পার্টির গৃহীত কর্মসূচির বাস্তব প্রয়োগ করাটা জরুরি কিছু নয়- ইত্যাদি। দেখে-শুনে মনে হয় মার্তভের কিছু বাক্যবাগীশ ‘সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের’ জন্য দুঃখের অন্ত নেই। আর তাই তিনি পার্টির দ্বার তাদের জন্য বন্ধ করে দিতে চান না।
আমরা আরও বলছি- কর্মসূচিকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হলে লড়াই করতে হবে এবং সংহতি ছাড়া লড়াই করা যেহেতু অসম্ভব তাই একজন সম্ভাব্য পার্টিসভ্যকে পার্টির কোন একটা সংগঠনে যোগ দিতেই হবে, পার্টির ইচ্ছার সঙ্গে নিজের ইচ্ছাকে মিলিয়ে দিতে হবে, শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামী বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে হবে অর্থাৎ তাকে একটা কেন্দ্রীভূত পার্টির সুসংগঠিত বাহিনীর মধ্যে স্থান করে নিতে হবে। মার্তব এর উত্তরে বলছেন, সভ্যদের সুসংহত বাহিনীতে সংগঠিত হবার খুব একটা কিছু প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই সংগঠনে সংঘবদ্ধ হবার; একক লড়াই-ই যথেষ্ট।
আমাদের প্রশ্ন হল আমাদের পার্টিটা তাহলে কি? কতকগুলো ব্যক্তির একটা আকস্মিক জনতা, না নেতাদের সুসংহত সংগঠন? আর যদি এটা নেতাদেরই সংগঠন হয় তাহলে যে এর অন্তর্ভুক্ত নয়, এবং যার ফলে এর শৃঙ্খলা মেনে চলার কোন বাধ্যবাধকতাও যার নেই এমন লোককে এর সভ্য বলা চলে? মার্তভ জবাবে বলছেন, পার্টি কোন সংগঠন নয়, বরং পার্টি হল একটা অসংগঠিত সংগঠন (চমৎকার কেন্দ্রানুগত্য সন্দেহ নেই!)। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মার্তভের মতে পার্টি কোন কেন্দ্রীভূত সংগঠন নয়, পার্টির কর্মসূচি ইত্যাদি মেনে নিয়েছেন এমন ‘সোশ্যাল ডেমোক্রাট ব্যক্তিবিশেষদের এবং আঞ্চলিক সংগঠনসমূহের তা একটা সমষ্টিমাত্র। কিন্তু আমাদের পার্টি একটা কেন্দ্রীভূত সংগঠন না হলে- তা একটা দুর্গ হতে পারবে না- যে দুর্গের দুয়ার শুধু পরীক্ষিতদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বাস্তবিকপক্ষে মার্তভের সূত্র থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তাঁর কাছে পার্টি একটা দুর্গ নয়- বরং একটা ভোজসভা বিশেষ- যাতে প্রতিটি সমর্থকেরই প্রবেশাধিকার রয়েছে। খানিকটা জ্ঞান, খানিকটা সহানুভূতি, খানিকটা আর্থিক সাহায্য- তাহলেই হল আপনি পার্টিসভ্য বলে গণ্য হবার সম্পূর্ণ অধিকার পেয়ে গেলেন। আতঙ্কিত ‘পার্টিসভ্যদের’ উৎসাহ যোগানোর জন্য মার্তভ চেঁচিয়ে বললেন- শুনবেন না, কানে নেবেন না, সেই লোকেদের কথা যারা বলে, পার্টিসভ্যকে একটা পার্টি সংগঠনে থাকতেই হবে এবং পার্টির ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছাকে বিলিয়ে দিতে হবে। তিনি বললেন, প্রথমত: এমন শর্ত একজন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়াই কঠিন, পার্টির ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছা বিলিয়ে দেওয়া তামাশা নয়! আর দ্বিতীয়ত: আমার ব্যাখ্যায় আমি এর আগেই দেখিয়ে দিয়েছি- ঐ লোকগুলোর মতামত নিতান্তই ভ্রান্ত। কাজেই ভদ্রমহোদয়গণ- এই ভোজসভায়….. আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি।
দেখে মনে হচ্ছে মার্তভ পার্টির ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছাকে বিলিয়ে দিতে ঘৃণা বোধ করেন এমন কিছু অধ্যাপক এবং হাই স্কুলের ছাত্রদের জন্য উদ্বেগে আকুল হয়ে উঠেছেন, আর তারই জন্য আমাদের পার্টির দুর্গপ্রকারে ফাটল সৃষ্টি করে এইসব সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদের চোরাগোপ্তা পথে পার্টিতে ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন। সুবিধাবাদকে দরজা খুলে দিচ্ছেন তিনি- আর সেটা করছেন এমন একটা সময়ে যখন শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণিসচেতনতার হাজার হাজার শত্রু আক্রমণ হেনে চলেছে!
কিন্তু এইটেই আসল কথা নয়। আসল কথা হল, মার্তভের এই সন্দেহজনক সূত্রটি পার্টির অভ্যন্তরেই অন্য দিকে থেকে সুবিধাবাদের উদ্ভব ঘটাতে সাহায্য করে।
আমরা জানি মার্তভের সূত্রে শুধু কর্মসূচি গ্রহণের কথাই আছে; রণকৌশল ও সংগঠনের ব্যাপারে একটি কথাও নেই। কিন্তু পার্টির পক্ষে সাংগঠনিক ও রণকৌশলগত ধ্যানধারণার দিক থেকে ঐক্য কর্মসূচিগত মতামতের ঐক্যের চেয়ে মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের তিনি বলতে পারেন যে কমরেড লেনিনের সূত্রেও তো এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। ঠিকই! কিন্তু কমরেড লেনিনের সূত্রে এ সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এটা কি স্বতঃসিদ্ধ নয় যে, পার্টি সংগঠনে যে কাজ করে এবং স্বভাবতঃই পার্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যে লড়াই করে, পার্টি শৃঙ্খলাকে যে মাথা পেতে নেয়- সে পার্টির সাংগঠনিক নীতি এবং রণকৌশল ছাড়া অন্য কোন সাংগঠিক নীতি এবং রণকৌশল অনুসরণ করতেই পারে না? কিন্তু পার্টি কর্মসূচি মেনে নিয়েছেন, অথচ কোন পার্টি সংগঠনের যিনি অন্তর্ভুক্ত নন- এমন একজন পার্টিসভ্য সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? কী নিশ্চয়তা আছে যে এই ধরণের একজন সভ্যের রণকৌশলগত এবং সাংগঠনিক মতামত পার্টির মতামতই হবে, অন্য কিছু হবে না? মার্তভের সূত্র ঠিক একথাটিই ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। মার্তভের সূত্রের ফলে আমরা পাব একটি ‘অদ্ভূত পার্টি’ যার ‘সভ্যরা’ একই কর্মসূচি মানে (এবং সে বিষয়ে কোন প্রশ্ন নেই!), অথচ সাংগঠনিক ও রণকৌশলগত ব্যাপারে একমত নয়। কী আশ্চর্য বৈচিত্র্য! একটি ভোজসভার সঙ্গে আমাদের পার্টির পার্থক্য রইল কোথায়?
আর একটি প্রশ্ন আমরা করতে চাই: দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস আমাদের পার্টির হাতে ভাবাদর্শ ও কর্মগত কেন্দ্রিকতা তুলে দিয়েছিল আর মার্তভের সূত্রে যার পুরোপুরি বিরোধিতা রয়েছে- তারই বা আমরা কী করব? বেমালুম ছুড়ে ফেলে দেব? যদি বেছে নেওয়ার প্রশ্নই আসে তবে নিঃসন্দেহে মার্তভের সূত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া অনেক বেশি সঠিক হবে।
কমরেড লেনিনের সূত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই উদ্ভট সূত্রটিই মার্তভ আমাদের উপহার দিয়েছেন।
আমার মত হচ্ছে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে মার্তভের সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- সেটি প্রচন্ড ভুল; এবং আমরা আশা করি যে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে এই ভুল শুধরে নেবে এবং কমরেড লেনিনের সূত্রটি গ্রহণ করবে।
সংক্ষেপে পুনরুল্লেখ করা যাক: শ্রমিক শ্রেণির বাহিনী রণক্ষেত্রে
অবতীর্ণ হয়েছে। সব সৈন্যবাহিনীরই যেমন একটি অগ্রবাহিনী থাকা আবশ্যক, এই
বাহিনীও চাই একটি অগ্রবাহিনী। সুতরাং সর্বহারার নেতাদের একটা দল- রাশিয়ার
সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির আবির্ভাব ঘটেছে। একটি সেনাবাহিনীর
সুনির্দিষ্ট অগ্রবাহিনী বলেই এই পার্টিকে প্রথমত: নিজস্ব কর্মসূচি, রণকৌশল
আর সাংগঠনিক নীতিতে সুসজ্জিত হতে হবে। দ্বিতীয়ত: একে হতে হবে একটি সুসংহত
সংগঠন। রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির সভ্যপদ কাকে দেয়া যেতে
পারে?- এই প্রশ্নের একটিমাত্র উত্তরই পার্টি দেবে : যিনি পার্টির কর্মসূচি
মেনে নেবেন, পার্টিকে আর্থিক সাহায্য দেবেন আর পার্টির কোন একটি সংগঠনে
কাজ করবেন- তাঁকেই।
এই সুস্পষ্ট সূত্রটি কমরেড লেনিন তাঁর চমৎকার সূত্রটিতে ব্যক্ত করেছেন।
সূত্র: সাপ্তাহিক সেবা অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী ২০১৮
জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন বা যোসেফ স্তালিন বা জোসেফ স্ট্যালিন (১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৯- ৫ মার্চ ১৯৫৩) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মানে এবং একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দীর্ঘতম সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ তথা বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম যোসেফ ভিসারিওনোভিচ সোসো, স্তালিন নামটি তিনি ১৯১০ সালে ‘লৌহমানব’ অর্থে ধারণ করেন। তাঁকে মানবেতিহাসের মহত্তম নেতা ও জনগণের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়।
After I read a few sentences above I got useful information for me.