ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের (ইংরেজি: Indian classical music) উৎপত্তি বলতে সাধারণত বেদ-পরবর্তীকালের ধ্রুপদী সংগীতকে বোঝানো হয়। তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক সংগীতের সৃষ্টিকাল বলতে বৈদিক যুগকেই মনে করে থাকেন। চার বেদের মধ্যে ‘সামবেদ’-কেই ভারতীয় সংগীতের উৎসরূপে ধরা হয়। কিন্তু বৈদিক যুগের শুরু ‘ঋকবেদ’ থেকে সাম’ শব্দের অর্থ সুর বা সুমিষ্ট স্বর। ঋকছন্দের ওপর সুর সংযোজন করে সামগানের বিকাশ। তাই স্বরযুক্ত ঝক বা সামের সমষ্টিই হলো ‘সামবেদ’।
‘সামবেদ’ বা সাম-সংহিতা মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ও ছোটো ভাগটির নাম ‘আর্চিক’। দ্বিতীয় ভাগটির নাম ‘স্তোভিক। স্তোভ অর্থে প্রশংসা করা, অর্থাৎ দেবতা বা ঋষিদের উদ্দেশে প্রশংসাসূচক গানই স্তোভ। গ্রামগেয়, অরণ্যগেয়, উহ্য এবং উহ (রহস্যগান) এই চারটি গানভাগকে নিয়ে সামগানের গাথা গান বা সংগীতাংশ রচিত। গ্রামগেয় বা গ্রামেগেয় গানই আদি বা মূল গান। মনে করা হয় এই গ্রামগেয় গান থেকেই বৈদিকোত্তর গান্ধর্ব গান বা মার্গ ও মার্গ থেকে ক্রমশ ক্ল্যাসিকাল—অভিজাত দেশীগানের সৃষ্টি হয়েছে। উহ্য বা উহ গান এই গ্রামগেহ গান থেকেই সৃষ্টি হত। অরণ্যগেয় গান অরণ্যবাসী ঋতিক ও সামগদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। আর গ্রামগেয় বা গ্রামেগেয় গান নির্দিষ্ট ছিল গৃহবাসী গোষ্ঠী বা সাধারণ শ্রেয়কামীদের জন্য।
বিভিন্ন বেদের অনেকগুলি করে শাখা। পৃথক পৃথক শাখার সামগরা পৃথক পৃথক স্বরে সামগান করত। তাদের গানের প্রকৃতি ও শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ হত স্বরসংখ্যার প্রয়োগে । কেননা কেউ পাঁচ স্বরে, কেউ বা ছয় আবার কেউবা সাত স্বরে সামগান গাইত। আদিম ও অনুর্বর যুগে এক, দুই বা তিন স্বরযুক্ত গানের প্রচলন ছিল। সামিকযুগের গান ছিল মাত্র তিনটি স্বর যোগে। আর্চিকযুগে ছিল একটি মাত্র স্বরের ব্যবহার। এইভাবে ক্রমশ বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এক, দুই বা তিন স্বর থেকে বৈদিক যুগে সাত স্বরের সৃষ্টি হয়েছিল। এই সাতটি স্বর হল—প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ্র, ক্রষ্ট, ও অতিস্বার। তবে এই সাত স্বরের বিকাশের সময় সম্বন্ধে অনেক মতবাদ আছে। সামগানে প্রকৃতি ও বিকৃতি স্বরের ব্যবহার ছিল। প্রকৃতি বলতে প্রধান ও বিকৃতি বলতে অনুষঙ্গী। বিকৃতি স্বর ছিল অনেকটা খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর শ্রুতিস্বরের মতো। কিন্তু কোমল নয়। সামিকযুগে ব্যবহৃত তিনটি স্বরকে—উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত—এই নামে চিহ্নিত করা হত। উদাত্ত ছিল সর্বোচ্চস্বর এবং অনুদাত্ত নিচু। কিন্তু স্বরিত স্বরটির স্থান নিয়ে মতান্তর দেখা যায়। সংগীতজ্ঞানীরা বলেন এই উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিতের মধ্যেই সাতটি স্বরের সময় পাওয়া যায়। যেমন—উদাত্ত স্বরের অন্তর্গত ছিল গান্ধার ও নিষাদ (গা’ ও ‘নি’), অনুদাত্ত স্বরের অন্তর্গত ছিল ঋষভ ও ধৈবত (রে’ ও ‘ধা’) এবং স্বরিত স্বরের অন্তর্গত ছিল ষড়জ, মধ্যম ও পঞ্চম (সা’, ‘মা’ ও ‘পা’)।
এই সাতস্বরের সন্ধান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারার ক্রমবিকাশ আমরা লক্ষ করতে পারি । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হিন্দুস্তানী ও কর্ণাটি দুই ধারাতেই রয়েছে দুটি মৌলিক উপাদান যা তাল ও রাগ হিসেবে পরিচিত। স্বর (ক্ষুদ্রটোনসহ নোট) এর উপর ভিত্তি করে রাগটি একটি সুরেলা কাঠামোর বুনন গঠন করে, যখন তাল সময় চক্রকে পরিমাপ করে। রাগ একজন শিল্পীকে শব্দগুলি থেকে সুর তৈরি করার জন্য একটি প্লেট দেয়, যখন তাল তাদের সময় ব্যবহার করে ছন্দবদ্ধ সংস্কারের জন্য একটি সৃজনশীল কাঠামো সরবরাহ করে। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতে নোটগুলির মধ্যে স্থানটি নোটগুলির চেয়ে প্রায়শই বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মধ্যে পশ্চিমা ধ্রুপদী ধারণা যেমন সাদৃশ্য, পাল্টা বিন্দু, ঐকতান বা সুরের নানা বিস্তার নেই।[১]
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে বাংলা লোকসংগীতের সম্পর্ক নেই। বাংলা লোকগান ঐতিহাসিককাল থেকেই স্বাধীন ধারা। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলির থেকে বাংলা পাঁচালীর উদ্ভব ধরলেও সেটা কেবল ধারাক্রম বর্ণনার জন্যই। মহাভারত, রামায়ণ, ভাগবতের বাংলায় অনূদিত গান লোকায়ত ধারায় মিশে পাঁচালীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এই পাঁচালীই বাংলা লোকসংগীতের আদি উৎস।[২]
তথ্যসূত্র:
১. তপন রায়, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬০০-৬০৩।
২. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ১১৬
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।