বর্তমানে উদ্যানবিদগণের আপ্রাণ ও আন্তরিক গবেষণার ফলে উন্নত জাতের বহুরকমের নূতন নূতন গোলাপ আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং এইগুলি এখন আমাদের দেশের গোলাপ-প্রেমিকরা উদ্যানে চাষ করে বাগানের সৌন্দর্য ও শোভা বৃদ্ধি করছেন। প্রসঙ্গতঃ টি, নয়সেটি, বোরবো এবং ইহাদের অনেক সঙ্কর প্রজাতির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এরা আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটিতে সুন্দরভাবে জন্ম নিতে পারে ও সুন্দর বড় আকারের সুগন্ধী ফুল দিতে পারে। পৃথিবীর নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলসমূহই গোলাপের আদি জন্মস্থান। আমাদের দেশে কতদিন পূর্বে গোলাপের চাষ আরম্ভ হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব । এ দেশে বর্তমানে অসংখ্য উৎকৃষ্ট ও উন্নত জাতের সুগন্ধি গোলাপের আবাদ চলছে।
গোলাপের চারা উৎপাদন:
চাষের জন্য প্রধানতঃ কলমের চারা ব্যবহার করা হয় (১) দাবা-কলম, (২) শাখাকলম, (৩) চোক-কলম ও (৪) জোড়-কলম দ্বারা গোলাপের চারা প্রস্তুত করা যায়। কলম প্রস্তুতের কয়েকটি পদ্ধতি হলও
দাবা-কলম:
এই পদ্ধতিতে গোলাপের চারা উৎপাদন খুব সহজ। বৎসরের যে কোন সময়েই দাবা-কলম করা যায়। তবে অক্টোবর ও ফেব্রুয়ারী মাসই এই কলম প্রস্তুতের প্রকৃষ্ট সময়। এই পদ্ধতিতে ফেব্রুয়ারী মাসে একটি মাটিভর্তি টবে গোলাপ গাছের একটি ডাল মাটি চাপা দিয়ে রেখে দিতে হয় অথবা গাছের সম্মুখস্থ মাটিতে ডাল চাপিয়া রেখে দিয়ে জলসেচন করলেও চলবে। মাটি চাপা দেওয়ার পূর্বে ডালটির সামান্য স্থান ছুরি দিয়ে গোল করে চাঁচিয়া ছাল তুলে দিলে, ক্ষতস্থান হতে তাড়াতাড়ি শিকড় বাহির হয়। টবে মাঝে মাঝে জলসেচন করতে হয়, যাহাতে টবের মাটি সিক্ত থাকে। এভাবে উৎপন্ন চারা বর্ষার প্রারম্ভে রোপণের উপযোগী হয়। এছাড়া, এক বৎসর বয়সের ডালের দুটি পর্বের মাঝখানের ছাল তুলে ক্ষতস্থানে জৈব সার মিশ্রিত মাটি গোল করে ধরাইয়া ‘গুটি’ তৈরী করেও গোলাপের চারা প্রস্তুত করা যায়।
শাখা-কলম:
শাখা-কলমের দ্বারা অনায়াসে প্রায় সকল প্রকার গোলাপের চারা প্রস্তুত করা যায়। সাধারণতঃ নভেম্বর মাসে গোলাপের শাখা-কলম প্রস্তুত করা হয়। মার্চ মাস নাগাদ ইহা রোপনের উপযোগী হয়। শাখা-কলম প্রস্তুতের জন্য শক্ত ও নিখুঁত শাখা নির্বাচন করা প্রয়োজন। শাখার যে অংশ মাটিতে পোঁতা হবে, তাকে ধারাল ছুরি দিয়ে কাভাবে কেটে কলম বাড়ার মতো করতে হয় এবং উপরের অংশ সমতল বা সোজাভাবে কাটতে হয়। সমপরিমাণ বালি, পলি ও পাতা-পচা সার মিশ্রণে ১৫-২২ সেঃ মিঃ লম্বা শাখাগুলি পুঁতিয়া নিয়মিত সেচ দিতে হয়। পুঁতিবার পূর্বে কাটা শাখার গোড়ার দিক সেরাডিক্স-বি দ্রবণে ডুবাইয়া লইলে, তাড়াতাড়ি চারা গজায় । শুধু বালিতেও শাখা রোপণ করা চলে, তবে একটি অসুবিধা এই যে, শাখায় শিকড় গজাইবার পর যদি শীঘ্র স্থানান্তরিত করা না হয়, তবে খাদ্যের অভাবে চারাগুলি মরে যেতে পারে। শাখা পতিবার পর বাম্পমোচন হ্রাসের জন্য ইহা কাচের বেলজার অ্যালকাথিন চাদর দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, নতুবা শাখার মাথায় কিছু কাচা গোবর সার দিলেও চলতে পারে।
চোক-কলম:
চোক-কলম দ্বারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য চারা উৎপন্ন করা যায়। বর্তমানে এই পদ্ধতিটিই গোলাপের চারা প্রস্তুত করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারী মাস চোক-কলম প্রস্তুতের প্রকৃষ্ট সময় । চোক-কলম প্রস্তুত করতে হলে দুইটি গাছের আবশ্যক একটি মূলসহ গাছ, ইহাকে এলা বা রুট-স্কট বলে। রোজ এডওয়ার্ড, গ্র্যান্ট রোজ, জংলী গোলাপ, কাট-গোলাপ প্রভৃতি অরণ্যজাত ও কষ্টসহিষ্ণু গোলাপের গাছ রুট স্টক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ, ইহাদের ফুল হয় না, আর হলেও তাহা নিকৃষ্ট ও ছোট হয়। আবার, আর এক ধরনের গাছ হচ্ছে—যে গাছ হতে মুকুল সংগ্রহ করে রুট-স্টকে বসানো হয়, ইহাকে শাকা বা সায়ন বলে। উন্নত জাতের গোলাপ গাছ হতে মুকুল লইয়া চারা প্রস্তুত করতে হয়; কারণ, ঐ মুকুল হতে উৎপন্ন চারাই বড় হইয়া পুষ্পিত হবে । এদেশে রুট-স্টকের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপরোক্ত জাতের গোলাপ গাছ পাওয়া যায় ।
বলিয়া, এখানে চোক-কলম দ্বারা চারা প্রস্তুত করা কষ্টকর। তবে, আজকাল যে-কোন গোলাপ গাছকে রুট-স্টক হিসাবে ব্যবহার করে চোক-কলম করা হচ্ছে। অবশ্য, নিম্নোক্ত উপায়ে রুট-স্টক উৎপন্ন করা যেতে পারে। যেমন—বর্ষাকালে একখণ্ড সমতল ও উর্বর জমিতে এডওয়ার্ড, জংলী কিংবা কাট-গোলাপের কতকগুলি শাখা-কলম রোপণ করতে হবে। শাখা-কলমের দৈর্ঘ্য এক ফুট বা ৩০ সেঃ মিঃ-র মতো হবে। শাখা-কলমের নিচের দিকে একটি কুঁড়ি ও উপরের দিকে দুইটি কুঁড়ি রেখে অবশিষ্টগুলি তুলে ফেলতে হবে। তারপর, কলমগুলি কাত করে এমনভাবে পুঁতিতে হবে, যেন উহাদের দুই তৃতীয়াংশ মাটির মধ্যে থাকে এবং মাত্র একটি কুঁড়ি উপরে থাকে। এভাবে যে গাছ উৎপন্ন হইল, তাহা পরবর্তী ফেব্রুয়ারী মাসে রুট-স্টক হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
তারপর, উক্ত রুট-স্কটের গোড়ার মাটি সরিয়ে নিচের দিকের কোন স্থান হতে ছুরি দিয়ে উহার ছাল সরিয়ে, কোন উন্নত জাতের গোলাপের পুষ্ট কুঁড়ি প্রবিষ্ট করতে হবে। রুট-স্টকের নিম্নাংশ মাটির মধ্যে থাকে বলিয়া, ঐ স্থানের ছাল সহজেই অপসারণ করা যায়। অপরপক্ষে, বড় রুট-স্কটের মাটির উপরের যে কোনো শাখায় উন্নত জাতের গাছের কুঁড়ি সংগ্রহ করে প্রবিষ্ট করা যেতে পারে। এভাবে একটি রুট-স্টকে অনেকগুলি কুঁড়ি প্রবিষ্ট করা যায়। ঐ কুঁড়িগুলি থেকে যে সকল গাছ উৎপন্ন হয়, তাতে ফুল ফোটে। যদি বিভিন্ন গাছ হতে কুঁড়ি সংগ্রহ করা হয়, তবে একটি গাছেই বিভিন্ন রকমের লাল, সাদা, গোলাপী ইত্যাদি নানারকমের ফুল ফোটে।
এইরূপ বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছ বাগানে থাকলে বাগানের শোভা বৃদ্ধি পায়। উন্নত জাতের গাছ হতে ছুরি দিয়ে কুঁড়ি সংগ্রহ করতে হবে এবং কুঁড়ি তুলে একটি পাত্রের জলে রাখতে হবে, যাহাতে সেগুলি শুকাইয়া না যায় । কুঁড়ি প্রবিষ্ট করাইবার পর, যদি ইহা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সতেজ ও সবুজ থাকে তবে বুঝিতে হবে ইহা হতে নূতন চারা গজাইবে। চারা গজাবার পর রুট-স্কটের শাখার ডগাগুলি এমনভাবে ছাটিয়া দিতে হবে, যেন সেগুলি হতে নূতন গাছ না গজায়।
জোড়-কলম: আমাদের দেশে জোড়-কলম দ্বারাও উন্নত জাতের গোলাপ গাছের চারা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। সাধারণতঃ নভেম্বর মাসে গোলাপের জোড়-কলম প্রস্তুত করা হয়। জোড়-কলমের জন্য জংলী গোলাপ এবং চায়না রোজ রুট-স্টক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
গোলাপ চাষের স্থান নির্বাচন
স্যাঁতস্যাঁতে ও জল নিষ্কাশনের অনুপযোগী স্থানের গোলাপ গাছ ভালো হয় না এবং চাষের জন্য শুষ্ক এবং একটু উঁচু সমতল স্থানের আবশ্যক। যেখান হতে বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল উত্তররূপে নিষ্কাশন করা যেতে পারে। নতুবা গোড়ায় জল জমিয়া গাছের শিকড় পচিয়া যায়। গ্রীষ্মকালে উঁচু জমিতে গোলাপ গাছে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। প্রায় সকল রকম মাটিতে গোলাপের চাষ করা গেলেও বেলে, দো-আঁশ ও পলিমাটি সবচেয়ে বেশী উপযোগী। এঁটেল মাটি এবং বালি মাটিতেও গোলাপের চাষ করা যায়। পোড়ামাটি ও পুরাতন দেওয়ালের মাটিও গোলাপ চাষের পক্ষে বিশেষ উপযোগী।
গোলাপ গাছ দুই-এক বৎসর অন্তর নুতন নুতন মাটি বেশি পছন্দ করে। সেই জন্য দুই-এক বৎসর অন্তর নূতন জায়গায় গোলাপের উদ্যান করলে ভালো হয়। ইহা যদি সম্ভব না হয়, তবে প্রতি বৎসর বর্ষার শেষে, অক্টোবর মাসে গোলাপ গাছের গোড়ার মাটি সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে লইয়া ইহার শিকড়গুলি ২/৩ সপ্তাহ রোদে উন্মুক্ত করে রাখতে হয়, তারপর নূতন মাটির সহিত উত্তম পচা গোবর সার কিংবা নাইট সয়েল বা স্লাজ সার, ছাগল বা মুরগীর বিষ্ঠা ইত্যাদি মিশিয়ে গোড়ায় দিয়ে ভরাট করে দিতে হয়।
জমি প্রস্তুত
শরৎকাল বা শীতের প্রারম্ভ অর্থাৎ, নভেম্বর মসে বাগানে চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। এই সময় লাগালে চারাগাছ মরে কম এবং চারাগাছের পরিচর্যার ঝামেলাও কম। চারা রোপণের ২/৩ সপ্তাহ আগে থেকেই জমি তৈরীর কাজ শুরু করতে হয়। বর্ষা আরম্ভ হবার পূর্বে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে জমিতে ২/১ বার গভীরভাবে লাঙ্গল দিয়ে মাটিকে রৌদ্র খাওয়াইয়া লইতে হবে। তারপর, চারা রোপণের পূর্বে জমিকে গভীরভাবে কর্ষণ করে মাটিকে নরম, ঝুরঝুরে ও সমতল করতে হবে। কর্ষণের সময় প্রতি ১০০০ বর্গমিটার জায়গায় ২ মেট্রিক টন হিসাবে পচানো খাবারের সার প্রয়োগ করতে হবে। এটেল মাটি, লাল মাটি ইত্যাদি অম্লযুক্ত মাটিতে প্রতি ১০০০ বর্গমিটার জমিতে ১২৫ কেজি হিসাবে চুন বা কাঠের ছাই প্রয়োগ করা দরকার । চারা রোপণের দেড়মাস আগে চুন প্রয়োগ করা দরকার । অতঃপর, জমিকে ৬ মিঃ × ১.২ মিঃ (২০ × ৪) আকারের ছোট ছোট প্লটে ভাগ করে নিতে হবে। প্রতি দুই সারির প্লটের মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা, জলসেচ ও জলনিষ্কাশনের নালী তৈরী করতে হবে।
গোলাপের চারা রোপণ
শাখা-কলম, জোড়-কলম, চোক-কলম ইত্যাদি পদ্ধতিতে তৈরী চারাগুলিকে এক বৎসর কাল নার্শারীতে লালন-পালন করার পর বাগানের প্লটে রোপণ করতে হবে। সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময় এবং এই সময় চারা রোপণ করলে পরবর্তী শীতে গাছে ফুল আসে। কিন্তু, বর্ষাকালে শেষ বর্ষায় চারা লাগালে শীতের সময় অল্প হলেও গাছে ফুল ফোটে। বর্ষাকালে লাগানো চারার বাঁচার হার অপেক্ষাকৃত কম, তবে তাড়াতাড়ি ফুল পেতে হলে বর্ষাকালে চারা লাগানো উচিত। খর্বাকৃতি জারে চারা ৪৫ সেঃ মিঃ অন্তর অন্তর ‘টি’ বা হাইব্রিড টি’ জাতের চারা ৭৫ সেঃ মিঃ অন্তর অন্তর ‘ফ্লোরিব্লান্ডা’ বা অন্যান্য উন্নত মানের চারা এক মিটার অন্তর অন্তর বর্গাকার পদ্ধতিতে রোপণ করতে হবে।
রোপণের পূর্বে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে প্রতি গর্ত পিছু ২৫০ গ্রাম হিসাবে হাড়গুড়া প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। তারপর, ভরাট গর্তে সোজাভাবে চারা বসাইয়া গোড়ার মাটি ভালোভাবে চাপিয়া দিতে হবে। জোড়-কলম বা চোক-কলমের চারা হলে, ইহাদের রুট-স্টকটি বা এলাটি সম্পূর্ণরূপে মাটির ভিতরে পুঁতিয়া দিতে হবে এবং কলম রোপণের সময় যেন গোড়ার মাটির পিন্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়; ভেঙ্গে দিলে গাছটি মরে যেতে পারে। চারা-রোপণের পরই, প্রতি গাছেই কয়েকদিন যাবৎ হালকা সেচ দিতে হবে। উই এবং গোড়াপচা রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি গাছের গোড়া বি. এইচ. সি.-৫০ এবং ব্রাসিকল-৭৫-এর ০.৪% স্পে-মিশ্রণ দ্বারা ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।।
রোপণের পরিবর্তী পরিচর্যা
গোলাপ গাছ থেকে ভালো ফুল পেতে হলে নিয়মিত জলসেচ, সার প্রয়োগ, গাছ ছাঁটাই, রোগ ও পোকা দমন ইত্যাদির বিশেষ প্রয়োজন হয়।
জলসেচন
চারা রোপণের পর প্রথম বৎসর শীতকাল হতে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত নিয়মিত সেচ প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। এমনভাবে সেচ দিতে হবে যেন ১০-১২ সেঃ মিঃ গভীরতা পর্যন্ত মাটি সিক্ত হয় অথচ মাটি জলবসা না হয়। শীতকালে ১০-১২ দিন অন্তর এবং গ্রীষ্মকালে ৫-৬ দিন অন্তর সেচ দেওয়া দরকার।
সার প্রয়োগ
উত্তম ফুল উৎপাদনের জন্য গোলাপ গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। চারা রোপণের পূর্বে গর্ত পিছু প্রাথমিক সার প্রয়োগ ছাড়াও, গাছের বৃদ্ধিকালে প্রতি মাসে একবার সার প্রয়োগ করা উচিত। গর্তের জন্য সার মাটির ভাগ হবে ৭ ভাগ মাটি, ৫ ভাগ গুঁড়া গোবর সার এবং ৩ ভাগ গুঁড়া আধপোড়া বা পুরানো দেওয়ালের মাটি। ইহা ছাড়া, গর্ত পিছু এক আঁজলা হাড়ের গুঁড়া ও দুইমুঠা সরিষার খইল প্রয়োগ করতে হবে।
গাছের বৃদ্ধির সময় প্রতি মাসে একবার করে রাসায়নিক মিশ্র সুষম সার জৈব সারের সহিত মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ভালো হয়। নভেম্বর মাসে গাছ ছাঁটিয়া দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে গাছের গোড়ার চারিধারে ১৫-২০ সেঃ মিঃ গভীরভাবে খনন করে মাটি তুলে দুই একটি মূল উন্মুক্ত করে দিতে হবে। গাছের গোড়া ভোলা অবস্থায় দিন দশেক রাখতে হবে। শিকড়ে রৌদ্র ও হিম লাগিলে গাছের উপকার হয়। সেই কারণে প্রতি বৎসর গোড়া খোড়া প্রয়োজন হয়। ইহাকে গাছের শৈত্যকরণ বলে । গোড়া খোড়ার দুই সপ্তাহ পূর্ব হতে জলসেচন বন্ধ রাখতে হবে। গোড়া খোড়ার ১০-১২ দিন পরে গাছের গোড়াতে ৪৫ কেজি, হিসাবে গুড়া গোবর সার পাতা-পচা সার, ১০০-১৫০ গ্রাম হাড়ের গুঁড়া, চামচ সুপার ফসফেট, চামচ পটাসিয়াম সালফেট এবং যোগাড় করা সম্ভব হলে ‘সিকুয়েস্ট্রিন প্লাস’ প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে গোড়া বন্ধ করে দিতে হবে। গোড়া খোলা অবস্থায় গাছে জল দেওয়া চলবে না এবং গোড়া ভিজিয়েও জল দেওয়া চলবে না।
গাছে যখন নূতন ডাল গজাতে আরম্ভ করিবে, তখন সেচ দিতে হবে। গাছে কুঁড়ি দেখা দিলে গোড়াতে দু’মুঠো কাঁচা গোবর সার ছড়াইয়া দিতে হবে। বর্ষার প্রারম্ভে গাছের গোড়ার মাটি সরিয়ে ১০০-২০০ গ্রাম হিসাবে ‘স্টেরামিল’ প্রয়োগ করলেও ভাল হয়। যদি রাসায়নিক সুষম সার প্রয়োগ করা হয়, তবে অ্যামোনিয়াম সালফেট ৩ ভাগ, পটাসিয়াম নাইট্রেট ৬ ভাগ, পটাসিয়াম সালফেট ৮ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ২ ভাগ, সিঙ্গল সুপার ফসফেট ১৬ ভাগ এবং ফেরাস সালফেট ০.৫ ভাগ একত্রে মিশিয়ে গাছ পিছু ২৫-৩০ গ্রাম হিসেবে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয় । এই সার ৬০-৬৫ ভাগ ঝুরো মাটি মিশ্রিত করে অথবা নিম বা রেড়ীর খইলের জলীয় দ্রবণে মিশিয়ে তরল সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে।। গোলাপের ভালো ফুল পেতে হলে, নিয়মিত তরল সার দেওয়া প্রয়োজন। গাছে কুঁড়ি আসিতে আরম্ভ করলেই শুধু সরিষার খইল বা সরিষার খইল ও গোবরের তরল সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই সঙ্গে সুষম সারের মিশ্রণ মিশিয়েও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
গোলাপের ভালো ফুল উৎপাদনের জন্য পাতার সার কয়েকটি রাসায়নিক সার, মিশিয়ে প্রস্তুত করতে হয়। দুই প্রকারের পাতার সার ব্যবহার করা হয়—একটি গাছের স্বাস্থ্য ও ফুল ভালো করার জন্য এবং অপরটি ট্রেস এলিমিন্টের যোগান দেওয়ার জন্য। ইউরিয়া, ডাই-অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ডাই-পটাসিয়াম ফসফেট প্রতিটি ১০ গ্রাম করে ১০ লিটার জলে গুলিয়া স্পে-দ্রবণ তৈরী করতে হবে। প্রথম পাতার সারটি প্রতি ১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। দ্বিতীয় পাতার সার ব্যবহার করলে এক মাস বা দুই মাস অন্তর স্প্রে করতে হবে। ট্রেস এলিমেন্টের জন্য ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ২০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানীজ সালফেট ১৫ গ্রাম, ফেরাস সালফেট ১০ গ্রাম ও বোরাক্স ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে প্রতি লিটার জলে মিশ্রণের দুই গ্রাম করে গুলিয়া স্প্রে করতে হবে। প্রথম পাতার সারটি ‘জলদি গ্রো এবং দ্বিতীয় পাতার সারটি ‘সিকুয়েস্ট্রিন প্লাস’ নামে বাজারে পাওয়া যায় ।
গোলাপ গাছ ছাঁটাই
মৃত ও রোগগ্রস্থ ডাল অপসারণের জন্য, গাছের উপযুক্ত আকৃতি প্রদানের জন্য, প্রতিটি ডালে ফুল আসার জন্য এবং প্রয়োজনীয় রৌদ্র পাওয়ার জন্য নিয়মিত গাছ ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয়। গোলাপ প্রচুর শাখা-বিস্তারকারী গুল্মজাতীয় গাছ। বিগত বৎসরের উৎপাদনকারী শাখা থেকে প্রশাখা বাহির হয়ে ছোট ফুল উৎপন্ন করে। তাই, প্রতি বৎসর ছাঁটাই করে বলিষ্ঠ পার্শ্বশাখা উৎপাদনে উদ্দীপিত করা প্রয়োজন। সাধারণতঃ জুন মাসে বা অক্টোবর মাসে অথবা উভয় মাসে গাছ ছাঁটাই করা হয়।
ছাঁটাই করা ডালে যেন ৩ বা ৪টির বেশী পত্রমুকুল না থাকে। ঐ সব মুকুল হতে নূতন নূতন ডাল গজায় এবং পুষ্পিত হয়। প্রয়োজন হলে নূতন শাখা উৎপাদনে উদ্দীপিত করাইবার জন্য একাধিক বার গাছ ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হয়। যে সকল শাখাতে কুঁড়ি আসে না এবং এলা বা রুট-স্টক হতে জংলী গাছের ডাল উৎপন্ন হলেই অবশ্যই ভাঙিয়া দিতে হবে। ছাঁটিবার পরই ক্ষতস্থানে ব্লাইটক্স-৫০ গুঁড়া ভ্যাসলিনের সঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপ দিতে হবে ।
চারাগাছ লাগাবার ৩ বা ৪ মাসের মধ্যে পুষ্পমুকুল দেখা দিলে সেগুলি ভাঙিয়া দিতে হবে । ইহাতে গাছের স্বাস্থ্য ভাল থাকে। সমতল বাংলায় গোলাপ গাছে দুই বার ফুল জন্মায়। ছাঁটার পর প্রথম দফায় ফুল ও পুরানো ফুল ঠিকমতো কেটে দিলে আর এক দফা ফুল পাওয়া যায়। প্রথম দফার ফুল দেয়ার পর ঠিকমতো তরল সার প্রয়োগ করতে পারিলে দ্বিতীয় দফায় ভাল ফুল পাওয়া যায়। ফুল তোলার সময় ৭ সেঃ মিঃ লম্বা ডালসহ কাটা দরকার।
তথ্যসূত্র:
১. সিরাজুল করিম আধুনিক পদ্ধতিতে ফুলের চাষ প্রথম প্রকাশ ২০০১ ঢাকা, গতিধারা, পৃষ্ঠা ১২৪-১২৭। আইএসবিএন 984-461-128-7
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।