ভূমিকা: সুন্দরী বা সুন্দর হচ্ছে মালভেসি পরিবারের হেরিটিয়েরা গণের সপুষ্পক উদ্ভিদের একটি প্রজাতির নাম। সুন্দরবনের নামের নেপথ্যে যে তরুটি জড়িয়ে আছে, সেটি হলো সুন্দরী। সুন্দরী গাছের নাম অনুসারে এ বনের নাম সুন্দরবন হয়েছে, এটিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জনশ্রুতি।
বর্ণনা: সুন্দরী মাঝারী-আকৃতির হতে বৃহৎ চিরসবুজ বৃক্ষ। এরা ১৫-১৮ মিটার উঁচু, ক্ষুদ্র শাখা শল্কল, বাকল ধূসর। পত্র সরল, ১০১৭ x ৩-৬ সেমি, একান্তর, উপবৃত্তাকার-বল্লমাকার, গােড়া ক্রমশ সরু হতে গােলাকার, সূক্ষ্মাগ্র অথবা গােলাকার এবং শীর্ষ সূক্ষ্ম খর্বাগ্র, উপরেরতল মসৃণ, নিবতল চাপা শল্কাকৃতি, পত্রবৃন্তক ২ সেমি পর্যন্ত লম্বা।
এদের পুষ্প ছােট, একলিঙ্গ, অক্ষীয় প্যানিকলে সজ্জিত। বৃত্যংশ ৫ অথবা কদাচিৎ ৪-৬ দন্তকযুক্ত, ভিতরের দিকে তারকাকার লােমযুক্ত। পাপড়ি অনুপস্থিত। পুং পুষ্প ৫-১০ পুংকেশরবিশিষ্ট, শীর্ষে ২-কোষবিশিষ্ট পরাগধানীর বলয়সহ একটি স্তম্ভে সংযুক্ত। স্ত্রী পুষ্প ৪-৬টি গর্ভপত্রবিশিষ্ট, প্রায় মুক্ত, গর্ভদন্ড খাটো, গর্ভমুন্ড ৫টি, পুরু, প্রতি গর্ভপত্রে ডিম্বক একক। ফল একটি গুচ্ছাকৃতির কাষ্ঠল, অবিদারী, তরীদলযুক্ত অথবা পক্ষযুক্ত পরিপক্ক গর্ভপত্র! জরায়ুজ অঙ্কুরােদগম ব্যতিত বীজ একক কিন্তু জোয়ার ভাটার পানিতে ভাসতে পারে।
বংশ বিস্তার: ফুল ও ফল ধারণ ঘটে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসে। বীজ দ্বারা বংশ বিস্তার হয় এবং আবার কপি তৈরী দ্বারাও হয়।
আবাসস্থল: নিয়ন্ত্রিত লবনাক্ত বলয়, সুনিষ্কাশিত মাটি বা নিম্ন লবনাক্ততার জোয়ার ভাটার পানি দ্বারা প্লাবিত স্থানে জন্মে। যদিও ইহা একটি ম্যানগ্রোভ প্রজাতি, তথাপি ইহা উচ্চ ভূমিতে টিকে থাকতে পারে।
বিস্তৃতি: প্রজাতিটি পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র উষ্ণমন্ডলীয় জলাভূমি এলাকায় পাওয়া যায়। পর্যাপ্তভাবে ভারতে (পশ্চিম বাংলা এবং উড়িষা) এবং মায়ানমারে (আরাকান) পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ইহা সুন্দরবন, চকোরিয়া এবং অন্যান্য সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার বনে পাওয়া যায়।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব/ক্ষতিকর দিক: এই প্রজাতির কাঠ সেতু এবং বাড়ির কাঠামাে, তড়িৎ এবং টেলিফোন উপযােগী খুঁটি, বাস, লঞ্চ এবং ট্রাক, কাঠের বা গাছের গুড়ির নােঙ্গর, উচ্চ মঞ্চ, উচ্চ অট্টালিকা, বাড়ির খুঁটি, যন্ত্রপাতির হাতল, রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ এবং ইট পােড়ানাে, মেঝে ও দেয়াল প্রভৃতির জন্য এবং প্যানেলসমূহের জন্য ব্যবহার করা হয়। ভাল কাঠকয়লা কাঠ হতে তৈরী হয়। ইহা জোয়ার ভাটার বনে মাটি ক্ষয় রােধ করে এবং হালকাভাবে মাটির উপরের পলি সুদৃঢ় করে।
জাতিতাত্বিক ব্যবহার: উদ্ভিদটির ট্যানিন মুক্ত বীজ খাওয়া হয় (Sharma and Sanjappa, 1993)। বীজ তৈল অর্শ রােগে ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ১০ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) সুন্দরী প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের সংকটের কারণ টপ ডায়িং রােগ এবং ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে লবনাক্ততা বৃদ্ধির, যদিও বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সুন্দরী সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে শীঘ্র টপ ডায়িং রােগ নিরাময়ের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।।[১]
লবণাক্ততা, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, আগামরা রোগ, মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরী গাছ বিশ্বের বিপন্ন উদ্ভিদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সংস্থা আইইউসিএনের ২০১০ সালে প্রকাশিত রেড ডাটা সাইটে (বিশ্বের বিপন্ন, বিলুপ্তপ্রায়, উদ্ভিদ ও প্রাণীবিষয়ক বই) সুন্দরী গাছকে বিপন্ন (Endangered) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[২]
সুন্দরবনে সাধারণত কম লবণাক্ত এলাকার মাটিতে এটি ভালো জন্মে। এ গাছের জন্য উঁচু ভূমি ও স্বাদু পানির প্রয়োজন হয়। সুন্দরী গাছে সাধারণত এপ্রিল থেকে ফুল আসা শুরু করে। পুরো গাছ ভরে যায় ফুলে ফুলে। রঙ সোনালি-হলুদ, তার সঙ্গে লালচের আভা থাকে। ফুলের পাপড়ি নেই। বৃতি ৫টি।
তথ্যসূত্র:
১. এম আহসান হাবীব (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ১০ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩৪২-৩৪৩। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
২. “Heritiera fomes“, https://www.iucnredlist.org/species/178815/7615342, The IUCN Red List of Threatened Species। সংগ্রহের তারিখ: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।