শ্রেণিসংগ্রাম

‘শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যই কেবল পারে ধনিক শ্রেণির ঐক্যকে টলিয়ে দিতে’ কার্ল মার্কস

আজকের সমাজ অত্যন্ত জটিল! এ’হলো রং- বেরংয়ের শ্রেণি ও গোষ্ঠীগুলির জোড়াতালি বৃহৎ মাঝারি ও পেটি বুর্জোয়া; বৃহৎ মাঝারি ও পেটি বুর্জোয়া সামন্ততান্ত্রিক জমিদার; দিনমজুর, অদক্ষ শ্রমিক ও দক্ষ কারখানা-শ্রমিক; উচ্চতম, মাঝারি ও নিম্নতম যাজকমন্ডলী; উচ্চতন, মাঝারি ও ক্ষুদে আমলাতন্ত্র; নানামতের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং অনুরূপ নানা রকমের অন্যান্য গোষ্ঠী। আমাদের সমাজের এই হলো বহুবর্ণ ছবি!

কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে সমাজ যত বেশি বিকশিত হতে থাকে, ততই অধিকতর স্পষ্টভাবে দুটি প্রধান প্রবণতা এই জটিলতার মধ্যেও ফুটে ওঠে এবং ততই বেশি তীব্রতরভাবে এই জটিল সমাজ দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে বিভক্ত হয় ধনিক শ্রেণির শিবির ও শ্রমিক শ্রেণির শিবির। জানুয়ারি মাসের অর্থনৈতিক দাবিতে অনুষ্ঠিত ধর্মঘটগুলি (১৯০৫) স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে রাশিয়া বস্তুত দুটি শিবিরে বিভক্ত, সেন্ট পিটার্সবুর্গের নভেম্বর মাসের ধর্মঘটগুলি (১৯০৫) এবং সারা রাশিয়াব্যাপী জুন-জুলাই মাসের ধর্মঘটগুলি (১৯০৬) এই দুই শিবিরের নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং তার দ্বারা বর্তমান সময়কার শ্রেণি বিরোধ পরিপূর্ণভাবে উদঘাটিত করে। তারপর থেকে পুঁজিবাদী শিবির পুরোপুরি সজাগ আছে। এই শিবিরে উত্তেজনাপূর্ণ ও বিরামহীন প্রস্তুতি চলছে: পুঁজিবাদীদের স্থানীয় সমিতি গঠিত হচ্ছে। স্থানীয় সমিতিগুলি মিলে গঠন করছে আঞ্চলিক সমিতি; আবার আঞ্চলিক সমিতিগুলি মিলে গড়ে তুলছে সারা রাশিয়া সমিতি; টাকা পয়সা তোলা এবং সংবাদপত্র বের করা আরম্ভ হচ্ছে এবং পুঁজিবাদীদের সারা রাশিয়া কংগ্রেস ও কনফারেন্স আহ্বান করা হচ্ছে।…

এইভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে দমন করার উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদীরা একটি পৃথক শ্রেণিতে সংগঠিত হচ্ছে।

অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণির শিবিরও সম্পূর্ণ জাগ্রত। এখানেও চলছে আসন্ন সংগ্রামের জন্য ব্যাগ্র প্রস্তুতি। প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে নির্যাতন সত্ত্বেও এখানেও স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হচ্ছে, স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি মিলে গড়ে তুলছে আঞ্চলিক ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়নের তহবিল তোলা আরম্ভ হচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়নের ছাপাখানা গড়ে উঠছে এবং শ্রমিকদের ইউনিয়নসমূহের সারা রাশিয়া কংগ্রেস ও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এটাও স্পষ্ট যে শোষণকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে শ্রমিক শ্রেণিও একটি পৃথক শ্রেণিতে সংগঠিত হচ্ছে।

একটা সময় ছিল যখন সমাজে শান্তি ও স্বস্তি বিরাজ করতো। সে-সময়ে এইসব শ্রেণি ও শ্রেণি সংগঠনের কোনো চিহ্ন ছিলো না। সে-সময়েও অবশ্য একটা সংগ্রাম চলতো, কিন্তু সে সংগ্রামের চরিত্র ছিল স্থানীয়, তার কোনো সার্বিক শ্রেণি চরিত্র থাকতো না; পুঁজিপতিদের নিজস্ব কোনো সমিতি ছিলো না এবং প্রত্যেক পুঁজিপতি নিজে নিজেই ‘তার’ ‘তার’ শ্রমিকদের সাথে মোকাবেলা করতে বাধ্য হতো। সত্য বটে, স্থানীয় সোশ্যাল ডেমোক্রাট সংগঠনগুলি শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিত। কিন্তু সকলে স্বীকার করবেন যে, তখন নেতৃত্ব ছিল দুর্বল নৈমিত্তিক। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক সংগঠনগুলি তখন তাদের নিজেদের পার্টির ব্যাপারেই পুরোপুরি সামলাতে পারতো না।

কিন্তু জানুয়ারির অর্থনৈতিক দাবিতে অনুষ্ঠিত ধর্মঘটসমূহ একটি নতুন মোড় সূচিত করলো। পুঁজিপতিরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে উঠলো এবং স্থানীয় সমিতি গড়তে শুরু করলো। জানুয়ারির ধর্মঘটগুলি সেন্ট পিটার্সবুর্গ, মস্কো, ওয়ারসো, রিগা ও অন্যান্য শহরে পুঁজিপতিদের সমিতির জন্ম দেয়। তেল, ম্যাঙ্গানিজ, চিনি, কয়লা শিল্পসমূহে পুঁজিপতিরা তাদের পুরানো ‘শান্তিপূর্ণ’ সমিতিগুলিকে ‘সংগ্রামী সমিতিতে’ রূপান্তরিত করে এবং তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে আরম্ভ করে। কিন্তু পুঁজিপতিরা এতেই সন্তুষ্ট থাকেনি। তারা একটি সারা রাশিয়া সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিল এবং তদনুসারে ১৯০৫ সালের মার্চ মাসে মরোজভের উদ্যোগে তারা মস্কোতে একটি সাধারণ কংগ্রেসে সমবেত হলো। এটিই হলো পুঁজিপতিদের প্রথম রাশিয়া কংগ্রেস। এখানে তারা একটি চুক্তি সম্পাদন করলো; এই চুক্তির দ্বারা তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হলো যে, নিজেদের মধ্যে আগে বন্দোবস্ত না করে শ্রমিকদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা দেবে না এবং চরম অবস্থায় তারা লক আউটও ঘোষণা করবে। পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের প্রচন্ড সংগ্রামের এই হলো সূচনা। এ থেকে রাশিয়ায় একের পর এক বড় লক আউট ঘোষণার হিড়িক পড়লো। একটি বিরাট সংগ্রাম চালাতে হলে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সমিতির; এবং এজন্য একটি আরও বেশি সুসংবদ্ধ সমিতি গড়ে তোলার জন্য পুঁজিপতিরা আরেকবার মিলিত হবার সিদ্ধান্ত নিলো। তাই প্রথম কংগ্রেসের তিন মাস পরে (১৯০৫ সালের জুলাই মাসে) পুঁজিপতিদের সারা রাশিয়া দ্বিতীয় কংগ্রেস মস্কোতে আহুত হলো। এখানে তারা প্রথম কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলি পুনরোনুমোদন করলো, পুনরোনুমোদদের পর লক আউটের প্রয়োজনীয়তা এবং নিয়ম কানুনের খসড়া তৈরির জন্য আরও একটি কংগ্রেস অধিবেশনের বন্দোবস্ত করার জন্য একটি কমিটি নির্বাচিত করলো। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলি কার্যে পরিণত করা হলো। বাস্তব ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে, পুঁজিপতিরা অক্ষরে অক্ষরে এই প্রস্তাবগুলি কার্যে পরিণত করছে। রিগা, ওয়ারসো, ওদেসা, মস্কো ও অন্যান্য বড় বড় নগরের লক আউটগুলির কথা যদি স্মরণ করা যায়, যদি স্মরণ করা যায় সেন্ট পিটার্সবুর্গের নভেম্বরের সেই দিনগুলির কথা, যখন ৭২ জন পুঁজিপতি সেন্ট পিটার্সবুর্গের ২ লক্ষ শ্রমিকদের নিষ্ঠুর লক আউটের ভয় দেখিয়েছিল, তাহলে সহজেই বোঝা যায়, পুঁজিপতিদের সারা রাশিয়া সমিতি কী প্রচন্ড শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। কিভাবে খুটিনাটি ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তগুলি কার্যে পরিণত করে। তারপর দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর পুঁজিপতিরা আর একটি কংগ্রেস ডাকলো (১৯০৬ সালের জানুয়ারি মাসে), এবং সর্বশেষ এ বছর এপ্রিল মাসে পুঁজিপতিদের সারা রাশিয়া উদ্বোধনী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলো। এখানে সকলের জন্য একরূপ আইন-কানুন তৈরি হলো এবং একটি কেন্দ্রীয় ব্যুরো (দফতর) নির্বাচিত হলো। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যায় এই সমস্ত নিয়ম-কানুন সরকার এরই মধ্যে অনুমোদন করেছে।

আরো পড়ুন:  কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, রক্ষণশীল অথবা বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র

তাই কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না রাশিয়ার বৃহৎ বুর্জোয়ারা ইতিমধ্যে একটি পৃথক শ্রেণিতে সংগঠিত হয়েছে; এর নিজস্ব স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন আছে এবং তারা একটি মাত্র পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা রাশিয়ার পুঁজিপতিদের জাগিয়ে তুলতে পারে।

মজুরি কমানো, কাজের দিন লম্বা করা, শ্রমিক শ্রেণিকে দুর্বল করা, তার সংগঠনগুলিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করাপুঁজিপতিদের সাধারণ সমিতির এই হলো উদ্দেশ্য।

ইতোমধ্যে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এগোচ্ছে এবং বাড়ছে। এখানেও অর্থনৈতিক দাবির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত জানুয়ারির ধর্মঘটগুলির (১৯০৫) প্রভাব অনুভূত হলো। আন্দোলন গণচরিত্র ধারণ করলো, এর প্রভাবগুলিও ব্যাপকতর হলো, এবং কালে এটা সুস্পষ্ট হলো যে, সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক সংগঠনগুলি পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের কাজ দুই-ই চালাতে পারছে না। পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির মধ্যে শ্রমবিভাগের ধরনের একটা কিছু প্রয়োজন দেখা দিল। পার্টির বিষয়গুলি পার্টি সংগঠনসমূহের দ্বারা পরিচালিত করতে হলো, আর ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়গুলি ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের দ্বারা। সুতরাং ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠন আরম্ভ হলো সারা দেশ জুড়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হলো- মস্কো, সেন্টপিটার্সবুর্গ, ওদেসা, ওয়ারসো, রিগা, খারকভ ও তিফলিসে। সত্য বটে প্রতিক্রিয়াশীলরা ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কাজে বাধা দিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলনের প্রয়োজন বৃহত্তর হয়ে দাঁড়ালো এবং ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়েই চললো। শীঘ্রই স্থানীয় ইউনিয়নের পিছনে পিছনে গড়ে উঠলো আঞ্চলিক ইউনিয়ন এবং অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যখন, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ট্রেড ইউনিয়নের একটা সারা রাশিয়া সম্মেলন আহুত হলো। শ্রমিকদের ইউনিয়নের সেইটিই হলো প্রথম সম্মেলন। অন্যান্য ফলাফলের মধ্যে এই সম্মেলনের অন্যতম ফলাফল হলো; এই সম্মেলন বিভিন্ন শহর থেকে ইউনিয়নগুলিকে এক জায়গায় টেনে আনলো এবং অবশেষে ট্রেড ইউনিয়গুলির একটি সাধারণ কংগ্রেস আহ্বানের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যুরো (দফতর) নির্বাচিত করলো। অক্টোবরের দিনগুলি এসে গেল এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলি তখন আগেকার তুলনায় দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল। স্থানীয় এবং শেষে আঞ্চলিক ইউনিয়নগুলি দিনের পর দিন বেড়ে চলতে লাগলো। সত্য বটে ডিসেম্বরের পরাজয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের গতিবেগ লক্ষণীয়ভাবে মন্দীভূত করলো, কিন্তু পরবর্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হলো এবং ঘটনা এমন ভালভাবে এগোল যে, এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রেড ইউনিয়নগুলির দ্বিতীয় সম্মেলন ডাকা হলো এবং প্রথম সম্মেলনের তুলনায় তা আরও ব্যাপক হলো। সম্মেলন স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং সারা রাশিয়া কেন্দ্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিল; আসন্ন সারা রাশিয়া কংগ্রেসের বন্দোবস্ত করার জন্য একটি সাংগঠনিক কমিশন নির্বাচিত করলো এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংক্রান্ত সমসাময়িক প্রশ্নের ওপর যথোপযুক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করলো।

আরো পড়ুন:  সমাজতন্ত্র শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, ধারনার উদ্ভব ও ব্যখ্যা

সুতরাং কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, প্রতিক্রিয়া প্রচন্ড মারমূর্তি ধারণ করা সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণিও পৃথক শ্রেণিতে সংগঠিত হচ্ছে; তার স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে জোরদার করছে এবং পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে তার অগণিত সহকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে।

উচ্চতর মজুরি অর্জন করা, কাজের দিনের সময় কমানো, শ্রম সংক্রান্ত উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা কায়েম করা, শোষণ বন্ধ করা এবং পুঁজিপতিদের সমিতিগুলি প্রতিহত করা- শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নগুলির এই হলো উদ্দেশ্য। এইভাবে আজকের দিনের সমাজ দুটি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত হচ্ছে; প্রত্যেকটি শিবির পৃথক শ্রেণিতে সংগঠিত হচ্ছে; তাদের মধ্যে যে শ্রেণি সংগ্রাম প্রজ্জলিত হয়েছে, তা বিস্তৃতিলাভ করেছে, প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং অন্যান্য সমস্ত গোষ্ঠী এই দুই শিবিরের চারপাশে সমবেত হচ্ছে।

মার্কস বলেছেন প্রতিটি শ্রেণিসংগ্রামই একটি রাজনেতিক সংগ্রাম। এর অর্থ হলো যদি আজ শ্রমিকেরা ও পুঁজিপতিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রাম চালায়, তাহলে আগামী কাল তারা রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে বাধ্য হবে এবং এইভাবে একটি সংগ্রামে, তারা তাদের নিজ নিজ শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করবে। এই সংগ্রামের দুটি ধরণ আছে। পুঁজিপতিদের বিশেষ ব্যবসাগত স্বার্থ আছে, এবং এই সমস্ত স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই তাদের অর্থনীতি ভিত্তিক সংগঠনগুলি বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবসাগত স্বার্থের অতিরিক্ত তাদের সাধারণ শ্রেণিস্বার্থ রয়েছে, যে স্বার্থ হলো পুঁজিবাদকে জোরদার করা। এবং এই সমস্ত সাধারণ স্বার্থ রক্ষা করতে তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হবে এবং তাদের প্রয়োজন একটি রাজনৈতিক পার্টি। রাশিয়ার পুঁজিপতিরা এই সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করলো। তারা উপলব্ধি করলো যে, পার্টি অকপটে এবং নির্ভীকভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে, তাহলো অক্টোবরি পার্টি, সেই জন্য তারা এই পার্টির চারপাশে সমবেত হতে এবং তার মতাদর্শগত নেতৃত্ব মেনে নিতে মনস্ত করলো। তারপর থেকে পুঁজিপতিরা এই পার্টির মতাদর্শগত নেতৃত্বের অধীনে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে আসছে এবং এর সাহায্যে তারা বর্তমান সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে (যে সরকার শ্রমিকদের ইউনিয়ন দাবিয়ে রাখে, কিন্তু পুঁজিপতি সমিতির সংগঠনের মঞ্জুরি ত্বরান্বিত করে) ডুমায় তাদের প্রার্থীদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এইভাবে সমিতিগুলির সাহায্যে অর্থনৈতিক সংগ্রাম এবং অক্টোবরী পার্টির মতবাদগত নেতৃত্বের অধীনে সাধারণ রাজনৈতিক সংগ্রাম- বৃহৎ বুর্জোয়াদের চালিত শ্রেণি সংগ্রাম আজ সেই রূপই ধারণ করেছে।

বিপরীত দিকে শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি আন্দোলনেও আজ অনুরূপ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। শ্রমিক শ্রেণির পেশাগত স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হচ্ছে এবং এগুলি উচ্চতর মজুরি অর্জন, কাজের দিনের সময় কমানো ইত্যাদির জন্য সংগ্রাম করছে। কিন্তু পেশাগত স্বার্থের অতিরিক্ত শ্রমিক শ্রেণির অভিন্ন শ্রেণিস্বার্থও আছে; তাহলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগঠন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি যতদিন একটি ঐক্যবদ্ধ এবং অবিভাজ্য শ্রেণি হিসাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় না করে, ততদিন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন করা অসম্ভব। এই জন্যই শ্রমিক শ্রেণিকে অতি অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হবে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাবাদর্শগত নেতা হিসাবে কাজ করার জন্য তার একটি রাজনৈতিক দল প্রয়োজন। অবশ্য অধিকাংশ শ্রমিক ইউনিয়ন কোন দলভুক্ত নয় এবং নিরপেক্ষ। কিন্তু এর মানে কেবল এই যে, অর্থ ও সাংগঠনিক বিষয়ে এইগুলি পার্টি নিরপেক্ষ। অর্থাৎ তাদের নিজস্ব তহবিল আছে, নিজস্ব পরিচালক সংস্থা আছে, তারা নিজেদের কংগ্রেস আহ্বান করে, তারা নিজেদের কংগ্রেস আহ্বান করে সরকারিভাবে তারা রাজনৈতিক পার্টিগুলির সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য নয়। কোন নির্দিষ্ট পার্টির ওপর ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ভাবাদর্শগত নির্ভরতা সম্পর্কে বলতে গেলে এরকম নির্ভরতা সন্দোহাতীতভাবেই বিদ্যমান এবং তা না হয়ে পারে না, কেননা, অন্য সবকিছু ছাড়াও বিভিন্ন পার্টির সদস্যরা ইউনিয়নগুলির অন্তর্ভুক্ত এবং তারা অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের রাজনৈতিক প্রত্যয় ইউনিয়নগুলির ভিতর নিয়ে যায়। স্পষ্টতই শ্রমিক শ্রেণি যদি রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া কাজ না চালাতে পারে তাহলে তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক পার্টির ভাবাদর্শগত নেতৃত্ব ছাড়াও চলতে পারে না। এর চেয়ে আরও কিছু বেশি। তারা নিজেরাই একটা পার্টি খুঁজবেই যে পার্টি সুযোগ্যভাবে তার ইউনিয়নগুলিকে নেতৃত্ব দিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেশের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে শ্রমিক শ্রেণিকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এবং সব দিকে নজর রেখে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক পার্টিগুলির ভাবাদর্শগত সম্পদ তাকে অবশ্যই সযত্নে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে এবং অবাধে সেই পার্টির ভাবাদর্শগত নেতৃত্বই সে গ্রহণ করবে, যে পার্টি সাহসিকতার সঙ্গে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে তার শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করবে, সর্বহারার লাল পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে, এবং অকুতোভয়ে তাকে রাজনৈতিক ক্ষমতার দিকে- সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে পরিচালিত করবে।

আরো পড়ুন:  কার্ল মার্কসের ‘পুঁজি’র প্রথম খন্ডের পর্যালোচনা

এই পর্যন্ত এই ভূমিকা রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টি পালন করে এসেছে এবং সেই জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলির কর্তব্য হলো একটি পার্টির ভাবাদর্শগত নেতৃত্ব মেনে নেওয়া। সর্বসাধারণ জানে যে তারা প্রকৃতপক্ষে তা-ই করে।

এইভাবে ট্রেড ইউনিয়নগুলির সাহায্যে রাজনৈতিক দাবিতে অনুষ্ঠিত সংঘর্ষ এবং সোশ্যাল ডেমোক্রাসির ভাবাদর্শগত নেতৃত্বে রাজনৈতিক আক্রমণ- শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি সংগ্রাম আজ এইরূপ ধারণ করেছে।

শ্রেণি সংগ্রাম যে ক্রমবর্ধমান উদ্দীপনায় জ্বলে উঠবে, তাতে কোন সন্দেহই তাকতে পারে না। শ্রমিক শ্রেণির করণীয় কাজ হলো তার সংগ্রামে সাংগঠনিক পদ্ধতি ও মনোভাব প্রবর্তন করা। এই কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন হলো ইউনিয়নগুলিকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করা এবং এই কাজে ট্রেড ইউনিয়নগুলির সারা রাশিয়া কংগ্রেস বিপুল সাহায্য দিতে পারে। একটি দল নিরপেক্ষ শ্রমিকদের কংগ্রেস নয়, আমরা আজ যা চাই তা হলো শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের কংগ্রেস, যাতে শ্রমিক শ্রেণি এক ঐক্যবদ্ধ ও অবিভাজ্য শ্রেণিতে সংগঠিত হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণি অবশ্যই এই পার্টিকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করবে, যে পার্টি তার শ্রেণি সংগ্রামের ভাবাদর্শগত নেতা হিসাবে কাজ করবে।

১৪ নভেম্বর, ১৯০৬, উৎসঃ Works, Vol. 1, November 1901 – April 1907; অনলাইন উৎস “The Class Struggle

Leave a Comment

error: Content is protected !!