অর্থশাস্ত্র বা অর্থনীতি (ইংরেজি: Economics) হচ্ছে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময় ও ভোগের প্রক্রিয়ায় মানুষের আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র কী প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, অর্থশাস্ত্র হচ্ছে মানুষের মধ্যে উদ্ভূত সামাজিক সম্পর্ক এবং ঐতিহাসিকভাবে পরস্পরকে প্রতিস্থাপনকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠনরূপগুলোর বিকাশের নিয়ন্ত্রক অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর বিজ্ঞান। অর্থনীতি শ্রেণিচরিত্রের অধিকারী, কেননা তা মানুষের মৌলিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে হস্তক্ষেপ করে।
মার্কসবাদের অন্যতম অঙ্গীভূত অংশ হিসেবে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক অর্থশাস্ত্রের জনক কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। এটা প্রলেতারিয়, মার্কসীয়-লেনিনীয় অর্থশাস্ত্র। বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রও বিদ্যমান যা সর্বপ্রথমেই বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ প্রকাশ করে। পেটি-বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্র পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও স্তরগুলোর যথা ক্ষুদে মালিকদের, মুক্ত পেশাধারী লোকদের, খামার-মালিকদের, ম্যানেজারদের একাংশের, চাকুরীজীবীদের ও অন্যান্যদের স্বার্থবহন করে।
অর্থনীতিবিদ্যা বরাবরই মানবজাতির জীবনে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থেকেছে, আর সেটা বিশেষত যথাথ আজকাল। অর্থনীতি বিজ্ঞানের সূচনায় আমরা দেখতে পাই বিশিষ্ট চিন্তাবীরদের, যাঁরা মানব-সংস্কৃতির উপর রেখে গেছেন এমন ছাপ যা মুছে যাবার নয়, তাঁদের মনন ছিল বহুবিস্তৃত এবং মৌলিক, তাঁদের বৈজ্ঞানিক আর সাহিত্যিক প্রতিভা ছিল বিপুল – এটাও কোন হঠাত গজিয়ে ওঠা ব্যাপার নয়।
প্রাচীনকালের মনীষীরা রাজনীতি নিয়ে, আর মধ্যযুগ ক্যাথলিকতন্ত্র নিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন, এমন মত কী আজগুবি সেটা বলেছেন মার্কস। মানবজাতি বরাবরই ‘জীবন কাটিয়েছে অর্থনীতিবিদ্যা নিয়ে’, আর রাজনীতি ধর্ম বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা থাকতে পেরেছে শুধু অর্থনীতিবিদ্যার ভিত্তিতে। অর্থনীতিবিদ্যা অতীতে অপরিণত ছিল, এটাই ঐসব কালপর্যয় সম্বন্ধে অমনসব মত দেখা দেবার প্রধান কারণ। আমাদের একেবারে প্রত্যেকেরই জীবনে একটা অপরিহার্য ভূমিকায় রয়েছে আধুনিক অর্থনীতিবিদ্যা।
আজকের দুনিয়াটা প্রকৃতপক্ষে পৃথক-পৃথক দুটো দুনিয়া—সমাজতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদী — এর প্রত্যেকটার রয়েছে নিজস্ব অর্থনীতি এবং নিজস্ব অর্থশাস্ত্র। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে গেছে উন্নয়নশীল দেশগুলি – এইসব দেশও ক্রমেই আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসছে বিশ্ব রঙ্গভূমিতে। উন্নয়নের কোন পথটা ধরতে হবে, এটা স্থির করার প্রয়ােজনটা ক্রমেই আরও বেশি জরুরী হয়ে উঠছে এই দেশগুলির পক্ষে। অর্থশাস্ত্রের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে সেটা আধুনিক দুনিয়ার সমস্যাবলি বুঝতে, বিশ্ববীক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে অর্থনীতিবিদ্যাটাকে বুঝতে সহায়ক হয়।
মানুষের ইচ্ছার অনপেক্ষ কিন্তু মানুষের বােধগম্য বিভিন্ন নৈর্বক্তিক নিয়ম যাতে চালু থাকে এমন একটা তন্ত্র হিসেবে অর্থনীতি-সংক্রান্ত তত্ত্বটাকে সর্বপ্রথমে গড়ে তােলেন বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা, বিশেষত অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো। তাঁরা মনে করতেন, রাষ্ট্রের আর্থনীতিক কর্মনীতি এইসব নিয়মের পরিপন্থী হওয়া চলে না, এইসব নিয়ম হওয়া চাই ঐ কর্মনীতির অবলম্বন।
বিভিন্ন আর্থনীতিক প্রক্রিয়ার মাত্রিক বিশ্লেষণের ভিত্তি স্থাপন করেন উইলিয়ম পেটি, ফ্রাঁসােয়া কেনে এবং অন্যান্য মনীষী। একরকমের বিপাক হিসেবে এইসব প্রক্রিয়া বিচার-বিশ্লেষণ করতে এবং সেটার বিভিন্ন অভিমুখ আর পরিধি নির্ণয় করতে তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন। মার্কস তাঁর সামাজিক উৎপাদন পুনরুৎপাদন-সংক্রান্ত তত্ত্বে কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁদের বৈজ্ঞানিক সাধন সাফল্যগুলিকে।
ভােগ্যপণ্য আর উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে আপেক্ষিকতা, সঞ্চয়ন আর ভােগ-ব্যবহারের অনুপাত এবং বিভিন্ন শাখার মধ্যে সম্পর্ক আধুনিক অর্থনীতি আর আর্থনীতিক গবেষণার খুবই গুরত্বপর্ণ ভূমিকায় থাকে। অর্থনীতিবিদ্যাক্ষেত্রে এইসব পথিকৃতের কাজ থেকে পয়দা হয় আধুনিক আর্থনীতিক পরিসংখ্যান, সেটার গুরুত্বের কোন অতিরঞ্জন হতে পারে না।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আর্থনীতিক বিশ্লেষণে বিভিন্ন গাণিতিক প্রণালী প্রয়ােগের চেষ্টা হয়েছিল, এখন সেটা ছাড়া অর্থনীতিবিদ্যার বহু শাখার বিকাশের কথা কল্পনা করা অসম্ভব। এক্ষেত্রে একজন পথিকৃৎ হলেন ফরাসী অর্থনীতিবিদ আঁতােয়াঁ কুর্নো।
বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা এবং পেটিবুর্জোয় আর কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারাও পুঁজিবাদী অর্থনীতির বহু দ্বন্দ্ব-অসংগতি বিশ্লেষণ করেছিলেন। বুর্জোয়া সমাজে মহা যন্ত্রণাকর আর্থনীতিক সংকটের কারণ বুঝতে যাঁরা সর্বপ্রথমে চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের একজন হলেন সুইজারল্যাণ্ডের অর্থনীতিবিদ সিসমন্দি। মহান কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী সাঁ-সিমোঁ, ফুরিয়ে, ওয়েন এবং তাঁদের অনুগামীরা পুঁজিবাদের জ্ঞানগর্ভ সমালােচনা করেছিলেন এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধারায় সমাজ পুনর্গঠনের জন্যে।
ভ. ই. লেনিন লিখেছেন, মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবীরেরা আগেই যেসব প্রশ্ন তুলেছিলেন সেগুলির উত্তর যুগিয়ে দিলেন মার্কস, ঠিক এটাই তাঁর মহাপ্রতিভার পরিচায়ক। দর্শন, অর্থশাস্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মহত্তম প্রতিনিধিদের শিক্ষার সরাসরি এবং অব্যবহিত অনুবৃত্তি হিসেবে উদ্ভূত হলো তাঁর মতবাদ।*
ক্লাসিকাল বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্র হলো মার্কসবাদের অন্যতম আকর। তুব, মার্কসের শিক্ষা হলো অর্থশাস্ত্র ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বাঁক। মার্কস দেখালেন পুঁজি হলো একটা সামাজিক সম্পর্ক, যেটা মূলত প্রলেতারিয়ানদের মজুরি-শ্রম শােষণ। মার্কস তাঁর উদ্বত্ত মূল্য তত্ত্বে এই শােষণের প্রকৃতিটার অর্থ করে বুঝিয়ে দেখিয়েছেন পুঁজিবাদের ইতিহাসক্রমিক প্রবণতা: সেটার বৈরিতামুলক, শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব-অসংগতিগুলাের প্রকোপন এবং শেষে পুঁজির উপর শ্রমের বিজয়। এইভাবে মার্কসের অর্থনীতি তত্ত্বে রয়েছে একটা দ্বান্দ্বিক একত্ব : এতে তাঁর পূর্বসুরিদের বুর্জোয়া ধারণাগুলিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, আবার তাঁদের সৃষ্টি করা বাস্তবিক সবকিছুর সৃজনী বিকাশ ঘটানােও হয়েছে। এই একত্বটাকে খুলে ধরা এবং তার ব্যাখ্যা করাই মার্কসবাদী অর্থশাস্ত্রের লক্ষ্য।
চিত্র প্রসঙ্গে: ২০১৬ সালে দেশসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মানচিত্রে দেখানো হয়েছে। চিত্রটি Kami888 এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
তথ্যসূত্র:
১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৪।
২. আন্দ্রেই আনিকিন, বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় অনূদিত, অর্থশাস্ত্র বিকাশের ধারা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৫-৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।