আধা-সামন্তবাদ হচ্ছে কৃষিপ্রধান দেশগুলোতে মুৎসুদ্দি ও জমিদার চালিত দুঃশাসন

আধা-সামন্তবাদ বা আধা-সামন্ততন্ত্র (ইংরেজি: Quasi-feudalism) হচ্ছে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদে উন্নীত হওয়ার পর তাদের দ্বারা নিপীড়িত কৃষিপ্রধান দেশগুলােতে মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদীরা সামন্তবাদ-আধা সামন্তবাদকে উচ্ছেদ না করে তাদের সাথে একত্রে জড়িয়ে থেকে যে শোষণ শাসন চালায়। বাদ ও আধা বা অর্ধেক শব্দ দুটি থেকেই বুঝা যায় পুরাে সামন্তবাদী নয়, এটি হচ্ছে আংশিক বা আপাত-সামন্তবাদ। সামন্তবাদের গর্ভে পুঁজিবাদের সূচনার পর থেকেই বিভিন্ন উপায়ে সামন্তবাদ ক্ষয় হতে হতে আধা-সামন্তবাদ হয়ে যায়।[১]

আধা বলতে ৫০% এমন নয়। মূল বিষয় হচ্ছে এ ধরনের সমাজে উৎপাদন যন্ত্র আর শুধুমাত্র ভূ-স্বামী (ইংরেজি: Landlord) বা জমিদারদের হাতে থাকে না। তাদের ভিত্তির উপর পুঁজিবাদেরও বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ আধা-সামন্তবাদ এমন একটি সামাজিক শ্রেণিবদ্ধ ব্যবস্থা যা প্রায় সামন্তবাদের মতো তবে হুবহু একই নয়, বরং কিছু দিক থেকে আংশিক।

এমনকি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলেও জমির মালিকানার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদীরা প্রাধান্যে আসে না। জোতদাররা জমির মালিকানার জোরে সামন্তবাদী-আধাসামন্তবাদী কায়দায় কৃষকদেরকে শােষণ করে। অথবা ক্ষুদে মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একই কায়দায় শাসকশ্রেণি ও তাদের রাষ্ট্র কৃষকদের উপর শােষণ-নিপীড়ন চালিয়ে যায়।

বঙ্গে আধা-সামন্তবাদ

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে গত বিশ শতকে দেখা গেছে, কৃষিতে পুঁজিবাদের যে বিকাশ ঘটছে তা জাতিবাদী-সামন্তকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার মাধ্যমে ঘটছে না। বরং আধা সামন্তবাদকে নতুন রূপে টিকিয়ে রাখার মধ্যে দিয়ে এটা ঘটছে। পুঁজিবাদী রূপের সাথে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কগুলি জড়িয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে এবং এমনকি পুঁজিবাদী উদ্বৃত্ত মূল্য নিষ্কাশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে সামন্তবাদী শােষণের সম্পর্কগুলি কাজ করে চলেছে। উপরের আলােচনা থেকে এটা পরিস্কার যে গ্রামের নয়া জোতদার শ্রেণি তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা, জমি ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের উপর তাদের একচেটিয়া মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ এবং জাত-পাত প্রথাকে ব্যবহার করে কৃষকদের থেকে উদ্বৃত্ত নিংড়ে নিচ্ছে। ফলে এই পুঁজিবাদের চরিত্র সামন্তবাদী।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে পুঁজিবাদের যে বিকাশ ঘটছে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ও নিয়ন্ত্রণে জন্ম নিয়েছে ও বিকশিত হচ্ছে। ফলে এর বিকাশ অবাধ নয়, নিয়ত্রিত ও অধীনস্থ। কৃষিক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অনুপ্রবেশের মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে নয়া জোতদাররা। সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের প্রয়ােজনে এই শ্রেণিটাকে তৈরি করেছে। পুরােনাে জোতদারদের দিয়ে এই কাজটা হচ্ছিল না। জনগণ বিদ্রোহ করছিলেন এবং লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে পুরােনাে জোতদারদের শেষ করে দেন। এই পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ সবুজ বিপ্লব এবং সীমিত ও নিয়ত্রিত ভূমি সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয় এবং সামন্তবাদ বিরােধী লড়াইয়ে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে থেকে একটা গতিশীল দালাল অংশকে এনজিও ও বিকেন্দ্রিকৃত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে তুলে আনে। ফলে নয়া জোতদারদের মধ্যে যে পুঁজিবাদী চরিত্র এসেছে তা আসলে দালাল চরিত্রের।

আরো পড়ুন:  ভূমি থেকে কৃষিজীবী জনগণের উচ্ছেদ

এই নতুন শ্রেণিটার বিকাশে সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাষ্ট্র পুরােপুরি মদত দেয়। ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে সমস্ত সরকারি সুযােগ সুবিধার বেশির ভাগটাই এরা পেয়ে থাকে। এরা পার্টি-পঞ্চায়েত ও ইউনিয়নের মাথায় বসে থাকার সুবিধা নিয়ে গ্রামের জন্য বরাদ্দ সরকারি টাকা লুঠ করে এবং এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কৃষকদের শােষণ করে। এমনকি উপরের দিকের প্রশাসনিক পদগুলিতেও এরাই বসে আছে। সেজন্য নয়া জোতদারদরে মধ্যে যে পুঁজিবাদী চরিত্র এসেছে তা প্রতিযােগিতামূলক নয় বরং একচেটিয়া ও আমলাতান্ত্রিক।

সাধারণভাবে বলা যায় যে, আশির দশক থেকে উভয় বাংলার গ্রামে সামন্তবাদের ভিত্তির উপর, সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণের অধীনে এবং রাষ্ট্রীয় মদতে এক বিশেষ ধরনের পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানাের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সেজন্য এই পুঁজিবাদের চরিত্র সামন্ততাত্রিক, দালাল এবং আমলাতান্ত্রিক। এই পুঁজিবাদ পুরােনাে ধরনের সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কগুলিকে পরিবর্তিত করে এবং নতুন রূপ দেয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটা নতুন ধরনের আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী জোতদার শ্রেণিকে গড়ে তােলে। আজকে যখন সাম্রাজ্যবাদ আরও গভীরভাবে কৃষি ক্ষেত্রকে নিজের থাবার তলায় নিয়ে আসতে চাইছে তখন এই নয়া জোতদার শ্রেণিটাই তার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করছে।

তথ্যসূত্র

১. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ২৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!