আরোহ যুক্তি বা আরোহ পদ্ধতি (ইংরেজী: Inductive reasoning বা inductive logic, logical induction) হচ্ছে যুক্তির এমন একটি পদ্ধতি যা প্রতিজ্ঞাসমূহের উপসংহারে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু প্রমাণ সরবরাহ করে; এটা অবরোহ যুক্তির বিপরীত। জ্ঞান আরোহনের দুটি পদ্ধতি প্রধান। একটি অবরোহী, অপরটি আরোহী। অবরোহীতে কোনো সাধারণ সত্যের সাহায্যে কোনো বিশেষের জ্ঞান আমরা লাভ করি। আরোহীর ক্ষেত্রে বিশেষের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা একটি সাধারণ বা সার্বিক সত্যে উপনীত হই।
ইউরোপীয় দর্শনে জ্ঞান ও যুক্তির পদ্ধতি প্রথমে বিশ্লেষণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন এরিস্টটল। এরিস্টটলের পরে আরোহী পদ্ধতির বিকাশ ঘটে আধুনিককালের প্রধানত ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলিউ, নিউটন, মিল প্রমুখ বিখ্যাত ইউরোপীয় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের হাতে। জ্ঞানের আরোহী পদ্ধতির বিকাশ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে আরোহী পদ্ধতির প্রয়োগ যেমন সহজতর করেছে তেমনি বিজ্ঞানের বিকাশ আরোহী পদ্ধতিকে সুবিস্তারিত এবং সঠিক করে তুলেছে।
সাধারণত আরোহী যুক্তি ও অনুমানকে তিন প্রকারে বিভক্ত করা হয়। (১) পূর্ণা্ঙ্গ আরোহ, (২) আংশিক আরোহ বা সাধারণ আরোহ, (৩) বৈজ্ঞানিক আরোহ।
পূর্ণাঙ্গ আরোহ বলতে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক বস্তু বা বিষয়ের প্রত্যেকটি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত বুঝানো হয়। পর্যবেক্ষণের সম্পূর্ণতার ভিত্তিতে এই অনুমানকে পূর্ণাঙ্গ বলা হয়। একটি বিদ্যায়তনের প্রত্যেকটি ছাত্রকে পর্যবেক্ষণ করে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে, উক্ত বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি ছাত্র বাংলা ভাষাভাষী তা হলে এই অনুমানটি পূর্ণাঙ্গ আরোহী অনুমান হবে। কারণ বিদ্যায়তনের সকল ছাত্রকে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছে। এমন অনুমানের সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিশ্চিত। কিন্তু এরূপ অনুমান কেবলমাত্র তেমনক্ষেত্রেই সম্ভব যেখানে পরীক্ষণীয় বা বিবেচ্য বস্তু বা বিষয়ের সংখ্যা সীমাবদ্ধ।
পূর্ণাঙ্গ অনুমানের বিপরীত হচ্ছে অপূর্ণাঙ্গ অনুমান। একটি স্কুলের কয়েকটি মাত্র ছাত্রকে পরীক্ষা করে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে, এই স্কুলের সকল ছাত্র বুদ্ধিমান কিংবা ইংরেজ জাতির কিছু সংখ্যক লোকের পরিচয় পেয়ে যদি সিদ্ধান্ত করা হয় যে, ইংরেজ জাতি পরিশ্রমী অর্থাৎ সকল ইংরেজ পরিশ্রমী, তাহলে সিদ্ধান্তটি অ-পূর্ণাঙ্গ অনুমানের দৃষ্টান্ত হবে। এখানে বিবেচ্য বিষয়ের সকলকে পর্যবেক্ষণ করা হয় নি। এরূপ অনুমানের সংখ্যাই অধিক। মানুষ এই পদ্ধতিতে সাধারণত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে অপূর্ণাঙ্গ অনুমানকে সাধারণ বা জনপ্রিয় আরোহী অনুমান বলে অভিহিত করা হয়।
বৈজ্ঞানিক আরোহেও আংশিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেমন রাম মরেছে, রহিম মরেছে, জালাল মরেছে, সুতরাং সকল মানুষ মরবে বা সকল মানুষ মরণশীল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক আরোহীর প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং শর্ত হচ্ছে এই যে, অ-পূর্ণাঙ্গ অনুমান যেখানে পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলির মধ্যে সাধারণ সাদৃশ্যের ভিত্তিতে করা হয়, সেখানে বৈজ্ঞানিক আরোহে পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ কারণে বৈজ্ঞানিক অনুমানে পর্যবেক্ষণের বিষয়ের সংখ্যা কম বা আংশিক হলেও সিদ্ধান্ত সুনিশ্চিত।
জ্ঞানের জন্য বৈজ্ঞানিক আরোহীই প্রধান উপায়। বৈজ্ঞানিক আরোহের ক্ষেত্রে প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে পর্যবেক্ষণের বিষয় বা বস্তুর মধ্যে অনিবার্য কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা। প্রচলিত যুক্তিবিদ্যায় এই সম্পর্ক আবিষ্কারের জন্য আরোহী অনুমানের কয়েকটি পদ্ধতির বিবরণ দেওয়া যায়। এই পদ্ধতিগুলি আরোহী পদ্ধতি বা আরোহী অনুমানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। সাধারণভাবে এরূপ পদ্ধতির সংখ্যা হচ্ছে পাঁচটি। ১. সাদৃশ্যপদ্ধতি: বিবেচিত বিষয়ের মধ্যে একাধিক গুণের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সকল সম্পর্কে অনুমান। ২. ব্যতিরেকে পদ্ধতি: বিবেচিত বিষয়গুলির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট গুণের ক্ষেত্রে পার্থক্যের ভিত্তিতে বিষয়গুলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ৩. সাদৃশ্য ও ব্যতিরেকের সংযোগগঠিত যুক্ত পদ্ধতি। ৪. সহপরিবর্তন পদ্ধতি : বিবেচিত বিষয়ের একটির মধ্যে কোনে পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপর কারুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হতে দেখলে উভয় কার্যকারণ রূপে সম্পর্কিত বলে অনুমান গ্রহণ। ৫. অবশেষ পদ্ধতি : কোনো বিষয়ের এক অংশ যদি অপর কোনো অংশের কারণ বলে আমাদের জানা থাকে তা হলে তার ভিত্তিতে এই বিষয়ের অবশিষ্ট অংশকে অপর বিষয়ের অবশিষ্ট অংশের কারণ বলে অনুমান করা।
অবরোহ অনুমানে আমরা সাধারণ বা সার্বিক সত্য থেকে বিশেষ সত্যে উপনীত হই এবং আরোহ অনুমানে বিশেষ থেকে সার্বিকের দিকে অগ্রসর হই বলে এরূপ মনে হতে পারে যে, অবরোহ এবং আরোহ পরস্পর বিরোধী। কিন্তু তা ঠিক নয়। বস্তুত, জ্ঞানের ক্ষেত্রে অবরোহ এবং আরোহ হচ্ছে পরস্পর সম্পর্কিত এবং পরিপূরক পদ্ধতি।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২২৩-২২৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।