রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের পর(১) সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক ক্রিয়াকলাপের যে-নতুন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তাতে পার্টি সাহিত্যের প্রশ্নটি সামনে এসেছে। অবৈধ ও বৈধ সংবাদপত্রের মধ্যে পার্থক্য, ভূমিদাসভিত্তিক স্বৈরতন্ত্রী রাশিয়ার যে-যুগ তার শোকাবহ এই দায়ভাগটা অন্তর্ধান করতে শুরু করেছে। এখনও তা মরে যায় নি, মোটেই মরে নি। আমাদের প্রধান মন্ত্রীর ভণ্ড সরকার এখনও এতই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে, শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের ইজভেস্তিয়া’(২) প্রকাশিত হচ্ছে ‘বেআইনীভাবে, কিন্তু যাকে বাধা দেবার সাধ্য সরকারের নেই তাকে ‘নিষিদ্ধ করার নির্বোধ প্রচেষ্টায় সরকারের কলঙ্ক ও নব-নব নৈতিক আঘাত ছাড়া আর কিছুই লাভ হচ্ছে না।
অবৈধ ও বৈধ সংবাদপত্রের পার্থক্য বর্তমান থাকাকালে পার্টি সংবাদপত্র ও অ-পার্টি সংবাদপত্রের প্রশ্নটির সমাধান করা হতো অতি সরলভাবে এবং মেকী আর বিদঘুটে উপায়ে। সমস্ত অবৈধ সংবাদপত্র ছিল পার্টিগত, যেসব সংগঠন থেকে তা প্রকাশিত হতো ও যেসব গ্রুপ তা চালাত তারা কোনো-না-কোনোভাবে ছিল পার্টির ব্যবহারিক কর্মী দলগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সমস্ত বৈধ সংবাদপত্র ছিল অ-পার্টিগত, কেননা পার্টিগত সংবাদপত্র ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু কোনো পার্টির দিকে তা ‘ঝুকত’। বিদঘুটে জোট, অস্বাভাবিক ‘সহবাস’ ও মিথ্যার আড়াল ছিল অনিবার্য; যারা পার্টি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে ইচ্ছুক এমন লোকেদের বাধ্যতামূলক অধোক্তির সঙ্গে মিশে থাকত এমনসব লোকের অপূর্ণ চিন্তা বা চিন্তাভীরুতা, যারা পার্টি দৃষ্টি গ্রহণের পর্যায়ে বেড়ে ওঠে নি, যারা। মূলত পার্টির লোক নয়।
ঈশপীয় উক্তি(৩), সাহিত্যিক পদলেহন, দাসসুলভ ভাষা আর মতাদর্শগত গোলামির সে এক অভিশপ্ত কাল! রুশের জীবন্ত ও তাজা সবকিছুই মারা পড়ছিল এই যে-জঘন্যতাটায়, প্রলেতারিয়েত তার অবসান ঘটিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রলেতারিয়েত রাশিয়ার জন্যে জয় করেছে কেবল অর্ধেকটা স্বাধীনতা।
বিপ্লব এখনও সমাপ্ত নয়। বিপ্লবকে পরাস্ত করতে জারতন্ত্র যদি আর সক্ষম না হয়ে থাকে, তাহলে বিপ্লবও এখনও পর্যন্ত জারতন্ত্রকে পরাস্ত করতে সক্ষম নয়। আমরা এমন একটা কালের মধ্য দিয়ে চলেছি যখন সর্বত্র ও সবকিছুতেই দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্য, অকপট, প্রত্যক্ষ, সুসঙ্গত পক্ষতার মনোভাবের সঙ্গে গুপ্ত, ছদ্মবেশী, কূটনীতিক’, ধরা-না-দেওয়া ‘বৈধতার এই অস্বাভাবিক মিলন। এই অস্বাভাবিক মিলনটা আমাদের সংবাদপত্রেও দেখা যাচ্ছে: উদারনীতিক-বুর্জোয়া, নরমপন্থী সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক অত্যাচার নিয়ে গুচকোভ মহাশয় যত রসিকতাই ছাড়ুন, ঘটনাটা ঘটনাই – রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র ‘প্রলেতারি’(৪) এখন পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রী পলিসী রাশিয়ার দ্বারবহির্ভূত হয়েই আছে।
সে যাই হোক, অর্ধ-বিপ্লবটা কিন্তু আমাদের সকলকেই নতুন ধারায় কাজ সংগঠিত করতে বাধ্য করছে। এখন ‘বৈধভাবে প্রকাশিত সাহিত্যও হতে পারে ৯/১০ ভাগ পার্টি সাহিত্য। সাহিত্যকে হতে হবে পার্টি সাহিত্য। বুর্জোয়া রীতির বিপরীতে, বুর্জোয়া অর্থকরী, ব্যবসাদারী সংবাদপত্রের বিপরীতে, বুর্জোয়া সাহিত্যিক পদান্বেষণ ও অহমিকা, ‘নবাবী নৈরাজ্য ও মুনাফা শিকারের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতকে পেশ করতে হবে পার্টি সাহিত্যের নীতি, বিকশিত করতে হবে তাকে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে যথাসম্ভব পূর্ণতর ও সমগ্রতর রপে।
পার্টি সাহিত্যের এ নীতিটা কী? সেটা শুধু, এই নয় যে, সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতের কাছে সাহিত্যের ব্যাপারটা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হতে পারবে না, সমগ্র প্রলেতারিয়েতের কর্মকাণ্ড থেকে স্বাধীন একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকাও তার আদৌ চলবে না। দূর হোক অ-পার্টি সাহিত্যিক! দূরে থাক অতি-মানব সাহিত্যিক! সাহিত্যের ব্যাপারটাকে হতে হবে সমগ্র প্রলেতারিয়েতের কর্মযোগের একটা অংশ, হতে হবে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত রাজনীতি-সচেতন অগ্রবাহিনী দ্বারা চালানো একক ও অখণ্ড সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক মহা যন্ত্রব্যবস্থাটার ‘খাঁজ ও ইস্কুপ’। সাহিত্যের ব্যাপারটাকে হতে হবে সংগঠিত, পরিকল্পিত, সম্মিলিত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কাজের অঙ্গাঙ্গী অংশ।
একটা জার্মান প্রবাদে বলে, ‘প্রতিটি তুলনাই পঙ্গু’। ইস্কুপের সঙ্গে সাহিত্যের, যন্ত্রব্যবস্থার সঙ্গে জীবন্ত একটা গতির যে-তুলনাটা আমি দিয়েছি তাও পঙ্গু। নিশ্চয় ক্ষিপ্তস্নায়ু, এমন বুদ্ধিজীবী পাওয়া যাবে, যারা অবাধ ভাবাদর্শগত সংগ্রাম, সমালোচনার স্বাধীনতা, সাহিত্যিক সৃষ্টিকর্মের স্বাধীনতা, ইত্যাদিকে হেয় করা, অসাড় করা, আমলাতাশ্রয়ী করা’ এরূপ তুলনায় হল্লা তুলবেন। আসলে সেরকম হল্লা হবে বুর্জোয়। বুদ্ধিজীবী অহমিকার অভিব্যক্তি মাত্র। আসলে বলতে কি, যান্ত্রিক সমানীকরণ, সমতলীকরণ, সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরের প্রাধান্য সাহিত্যিক ব্যাপারে সবচেয়ে কম প্রযোজ্য। একথা তর্কাতীত যে, এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্যক্তিগত প্রবণতার একটা বহৎ সুযোগ, ভাবনা ও কল্পনা, রূপ ও অন্তবস্তুর সুযোগ নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহেই আবশ্যক। এসবই তর্কাতীত, কিন্তু এসবকিছু থেকেই শুধু এইটে প্রমাণ হয় যে, প্রলেতারীয় পার্টি-কর্মের সাহিত্যিক দিকটাকে প্রলেতারীয় পার্টি-কর্মের অন্যান্য দিকের সঙ্গে ছকবাঁধা এক করে দেখা চলে না। তা সত্ত্বেও, বুর্জোয়া শ্রেণী ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাছে অনাত্মীয় ও অদ্ভুত এই প্রতিপাদ্য তাতে মোটেই খণ্ডিত হচ্ছে না যে, সাহিত্যিক ব্যাপারটাকে নিশ্চয় ও অবশ্যই হতে হবে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কাজের একটা অংশ, যা তার অন্যান্য অংশের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সংবাদপত্রগুলোকে হতে হবে বিভিন্ন পার্টি সংগঠনের মুখপত্র। লেখকদের অবশ্যই থাকতে হবে পার্টি সংগঠনের ভেতরে। প্রকাশভবন ও গুদাম, দোকান ও পাঠকক্ষ, গ্রন্থাগার এবং বইয়ের নানাবিধ ব্যবসা— এসব কিছুই হবে পাটির জিনিস, পার্টির কাছে জবাবদিহি করবে। এ সমস্ত কাজটার দেখাশোনা করতে হবে সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতকে, তার সবকিছুর ওপর সে নিয়ন্ত্রণ রাখবে, বিনা ব্যতিক্রমে এই সমস্ত কাজটার মধ্যে সঞ্চার করবে জীবন্ত প্রলেতারীয় কর্মযোগের প্রাণস্রোত, এবং তাতে করে লেখক লেখেন পাঠক পড়েন – এই সাবেকী আধা-অবলোমভী(৫), আধা-ব্যবসাদারী রুশী নীতির সবকিছু, ভিত্তি তা দূর করবে।
বলাই বাহুল্য, আমরা একথা বলছি না যে, এশীয় সেন্সর ও ইউরোপীয় বুর্জোয়ার দ্বারা কলুষিত এই সাহিত্যিক ব্যাপারটার পুনর্গঠন সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভব। কোনো একটা একরূপ ব্যবস্থার প্রস্তাব বা গুটিকয় নির্দেশজারি মারফত কর্তব্য সমাধানের কথা আমরা আদৌ ভাবছি। এক্ষেত্রে ছকবাঁধার কথা উঠতে পারে সবচেয়ে কম। আসল কথা হলো, আমাদের সমগ্র পার্টি, সারা রাশিয়ার সমস্ত সচেতন সোশ্যাল— ডেমোক্র্যাটিক প্রলেতারিয়েত যেন এই নতুন কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, কর্তব্যটা যেন পরিষ্কার করে হাজির করে ও সর্বত্র তা সমাধানের জন্যে লাগে। সামন্ততান্ত্রিক সেন্সরের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসার পর আমরা বুর্জোয়া-ব্যবসাদারী সাহিত্যিক সম্পর্কের বন্ধনে যেতে ইচ্ছুক নই ও যাব না। মুদ্রণের স্বাধীনতা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই ও প্রতিষ্ঠা করব শুধু, পলিসী অর্থে নয়, পুঁজির হাত থেকে স্বাধীনতা, পদলালসা থেকে স্বাধীনতার অর্থেও এবং আরও বড় কথা: বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদী অহমিকা থেকে স্বাধীনতার অর্থেও।
এই শেষের কথাগুলো আপাত-বিপরীত বা পাঠকদের প্রতি উপহাস বর্ষণ বলে মনে হতে পারে। সে কী! হয়ত বা চেঁচিয়ে উঠবেন স্বাধীনতার উগ্র সমর্থক কোনো বুদ্ধিজীবী। সে কী! সাহিত্য সৃজনের মতো অমন সক্ষম ব্যক্তিগত ব্যাপারটাকে আপনারা যৌথের অধীন করতে চান! আপনারা চাইছেন বিজ্ঞান, দর্শন, নন্দনতত্ত্বের সমস্যা শ্রমিকেরা সমাধান করবে অধিকাংশের ভোটে! একান্ত ব্যক্তিগত ভাবাদর্শগত রচনার পরম স্বাধীনতা আপনারা অস্বীকার করছেন!
শান্ত হোন ভদ্রমহোদয়েরা! প্রথমত, কথাটা হচ্ছে পার্টি সাহিত্য ও তার ওপর পার্টি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। যা খুশি বলা ও লেখার অবাধ স্বাধীনতা প্রত্যেকেরই আছে। কিন্তু, পার্টি-বিরোধী মতামত প্রচারের জন্যে যারা পার্টির ধজা কাজে লাগাচ্ছে তেমন সদস্যদের বিতাড়নের স্বাধীনতাও আছে প্রতিটি স্বাধীন সমিতির (পার্টি সমেত)। বাক ও মুদ্রণের থাকা চাই পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু সমিতি গঠনের স্বাধীনতাও তো হওয়া চাই পরিপূর্ণ। বাক স্বাধীনতার নামে যত খুশি চিৎকার, মিথ্যাভাষণ ও লেখার অধিকার তোমায় দিতে আমি বাধ্য। কিন্তু, অমুক-অমুক কথা যারা বলছে তাদের সঙ্গে জোট বাঁধা বা ভাঙার অধিকারও তুমি আমায় সমিতির স্বাধীনতা হেতু দিতে বাধ্য। পার্টি একটা স্বেচ্ছামূলক সংগঠন, যেসব সদস্য পার্টি-বিরোধী মতামত প্রচার করছে তাদের হাত থেকে আত্মশুদ্ধি না-করলে প্রথমে ভাবাদর্শের দিক থেকে, পরে দৈহিকভাবে পার্টি ভেঙে পড়বে, তা অনিবার্য। কোনটা পার্টির, কোনটা পার্টি-বিরোধী তার সীমারেখা নির্ধারিত হয় পার্টি কর্মসূচি দিয়ে, পার্টির কর্মকৌশলগত সিদ্ধান্ত ও নিয়মাবলি দিয়ে, এবং শেষত, নির্ণীত হয় প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছামূলক সমিতির, আন্তর্জাতিক সোশ্যাল-ডেমক্র্যাসির সমগ্র অভিজ্ঞতা দিয়ে; যারা পুরোপুরি সঙ্গতিনিষ্ঠ নয়, পুরোপুরি নির্ভেজাল মার্কসবাদী নয়, পুরোপুরি সঠিক নয় এমনসব বিচ্ছিন্ন লোক ও ধারাকে অবিরাম নিজ পার্টির মধ্যে প্রলেতারিয়েত গ্রহণ করছে, এবং সেই সঙ্গে নিজ পার্টির পায়িক পরিশুদ্ধি’ও করে চলেছে অবিরাম। “সমালোচনার ব্যাপারে বুর্জোয়া ‘স্বাধীনতার সমর্থক মহোদয়েরা, আমাদের এখানেও, পার্টির অভ্যন্তরে তাই হবে: এখন আমাদের পার্টি হঠাৎ গণ-পার্টি হয়ে উঠতে শুরু করেছে, এখন আমরা প্রকাশ্য সংগঠনে উত্তরণের একটা ঝটকা বাঁকের মধ্যে দিয়ে চলেছি, এখন আমাদের মধ্যে অনিবার্যভাবেই আসবে সঙ্গতিহীন (মার্কসবাদী দৃষ্টি থেকে) বহু, লোক, হয়ত বা এমনকি খৃষ্টানও, হয়ত বা কিছু-কিছু, অতীন্দ্রিয়বাদীও। আমাদের পাকস্থলী ভালো, পাথরের মতো শক্ত মার্কসবাদী আমরা। এইসব সঙ্গতিহীন লোকেদের আমরা হজম করতে পারব। চিন্তার স্বাধীনতা এবং পার্টির অভ্যন্তরে সমালোচনার স্বাধীনতায় আমাদের কখনও পার্টি নামক স্বাধীন সমিতিতে জোট বাঁধার স্বাধীনতা ভোলানো যাবে না।
দ্বিতীয়ত, বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মহোদয়েরা, আমরা বলতে বাধ্য যে, আপনাদের পরম স্বাধীনতা কথাটা একেবারেই ভণ্ডামি। যে সমাজ অর্থাধিপত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে মেহনতী জনগণ দারিদ্র্যে ভোগে আর পরজীবী হয়ে দিন কাটায় মুষ্টিমেয় ধনী, সেখানে বাস্তব ও সত্যকারের স্বাধীনতা থাকতে পারে না। লেখক মহাশয়, আপনার বুর্জোয়া প্রকাশকের কাছ থেকে কি আপনি স্বাধীন? আপনার বুর্জোয়া পাঠকদের কাছ থেকে, যারা কাঠামোয়[৬] ও চিত্রে আপনার কাছ থেকে চায় যৌনকুরুচি, ‘পবিত্র’ অভিনয়কলার ‘পরিপূরণ হিসেবে চায় বেশ্যাবৃত্তি? এই পরম স্বাধীনতাটা হলো বুর্জোয়া অথবা নৈরাজ্যবাদী ফাঁকা বুলি (কেননা, বিশ্বধ্যান হিসেবে নৈরাজ্যবাদ হলো উল্টিয়ে নেওয়া বুর্জোয়াপনা)। সমাজে থেকে সমাজ থেকে স্বাধীন হওয়া চলে না। বুর্জোয়া লেখক, শিল্পী, অভিনেত্রীর স্বাধীনতা হলো টাকার থলি, উৎকোচ, রক্ষিতাবৃত্তির ছদ্মবেশী (অথবা ভণ্ড ছদ্মবেশী) পরাধীনতা।
আর আমরা সমাজতন্ত্রীরা এই ভণ্ডামির মুখোশ খুলি, মিথ্যা লেবেল ছিঁড়ি – শ্রেণিহীন সাহিত্য ও শিল্পকলা পাওয়ার জন্যে নয় (সেটা সম্ভব হবে কেবল সমাজতান্ত্রিক শ্রেণিহীন সমাজে), ভণ্ড-স্বাধীন ও আসলে বুর্জোয়ার সঙ্গে জড়িত সাহিত্যের সঙ্গে তুলনায় খোলাখুলি প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে জড়িত, সত্যিই স্বাধীন সাহিত্যের বৈপরীত্য দেখাবার জন্যে।
সে হবে স্বাধীন সাহিত্য, কারণ স্বার্থসাধন ও পদান্বেষণে নয়, সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শ ও মেহনতীদের প্রতি সহানুভূতিতে নতুন-নতুন শক্তি টেনে আনবে তা নিজ সারিতে। সে হবে স্বাধীন সাহিত্য, কারণ। কোনো অতিতৃপ্ত নায়িকা কিংবা বেজার, মেদপীড়িত ‘ঊর্ধ্বতন দশ সহস্রের’ নয়, তা সেবা করবে দেশের যারা মুকুল, দেশের যারা শক্তি, দেশের যারা ভবিষ্যৎ সেই কোটি-কোটি মেহনতীদের। সে হবে স্বাধীন সাহিত্য, সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতের অভিজ্ঞতা ও জীবন্ত কাজ দিয়ে যা ফলবান করে তুলবে মানবজাতির বিপ্লবী ভাবনার সর্বশেষ বাণীকে, অতীত অভিজ্ঞতা (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, প্রাথমিক ইউটোপীয় রপ থেকে যাতে সমাজতন্ত্রের বিকাশ সম্পূর্ণ হচ্ছে) ও বর্তমান অভিজ্ঞতার (কমরেড শ্রমিকদের বর্তমান সংগ্রাম) মধ্যে অবিরাম পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া ঘটাবে।
কাজে লাগুন কমরেডরা! দুরূহ ও নতুন, কিন্তু মহান ও সার্থক এক কর্তব্য আমাদের সামনে – সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড় ও অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত একটা সুপ্রসর, বহুমুখী, বহুরূপী সাহিত্য গড়ে তোলা। সমস্ত সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক সাহিত্যকে হতে হবে পার্টি সাহিত্য। সমস্ত সংবাদপত্র, পত্রিকা, প্রকাশভবন, ইত্যাদিকে অবিলম্বে কাজ-পুনর্গঠনে লাগতে হবে, এমন পরিস্থিতি গড়ে তোলায় লাগতে হবে যাতে তারা কোনো-না-কোনো ভিত্তিতে কোনো-না- কোনো পাটি সংগঠনের মধ্যে পুরোপুরি এসে যায়। কেবল তাহলেই ‘সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক’ সাহিত্য সত্য সত্যই সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক হবে, কেবল তখনই সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে, কেবল তখনই বুর্জোয়া সমাজের পরিধির মধ্যেই বুর্জোয়ার দাসত্ব ছিন্ন করে সত্যসত্যই অগ্রগামী, শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী শ্রেণীটির আন্দোলনের সঙ্গে মিলে যেতে পারবে।
১২ নং ‘নোভায়া জিজন’, ১৩ নভেম্বর, ১৯০৫[৭]
১২শ খণ্ড, ৯৯-১০৫ পঃ
স্বাক্ষর: ন. লেনিন
টিকা:
১. ১৯০৫ সালের অক্টোবর সাধারণ ধর্মঘটের কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে ঐ বছরের ১৭ অক্টোবর জার জনগণের জন্যে নাগরিক স্বাধীনতা ‘ঘােষণা করে’ এক ইশতেহার প্রকাশ করেন। বলশেভিকরা নিজেদের পত্র-পত্রিকার বৈধ প্রকাশনার জন্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কাজে লাগায়। ১৯০৫ সালের শেষের দিকে, ডিসেম্বরের সশস্ত্র অভ্যুত্থান দমনের পর, স্বৈরতন্ত্র শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক পত্র-পত্রিকা জগতের উপর হামলা শুরু করে।
২. শ্রমিক প্রতিনিধি সােভিয়েতের ইজভেস্তিয়া’ – পিটার্সবুর্গ শ্রমিক প্রতিনিধি সােভিয়েতের সরকারী মুখপত্র; ১৯০৫ সালের ১৭ (৩০) অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন বুর্জোয়া ছাপাখানায় ছাপানাে হতো সংবাদপত্রটি। ১০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, একাদশ সংখ্যাটি ছাপানাের সময় পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে।
৩. প্রাচীন গ্রীক উপাখ্যান লেখক ঈশপ (Aisopos)-এর নামানুসারে। দ্ব্যর্থবােধক ভাষা, চিন্তা প্রকাশের গােপন ভঙ্গী।
৪. ‘প্রলেতারি’ (‘প্রলেতারিয়ান’) – অবৈধ বলশেভিক সাপ্তাহিক পত্রিকা, রুশ সােশ্যাল-ডেমােক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র, পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্থাপিত; প্রকাশিত হয় জেনেভায় ১৯০৫ সালের ১৪ (২৭) মে থেকে ১৩ (২৬) নভেম্বর পর্যন্ত। পত্রিকাটির সম্পাদনা করতেন ভ. ই. লেনিন। ২৬টি সংখ্যা বেরােয়, লেনিন রাশিয়ায় চলে আসার পর শেষের সংখ্যাগুলাে সম্পাদনা করেন ভ. ভ. ভরােভস্কি।
৫. অবলােমভ – রুশ লেখক ই. আ. গনচারােভের একই নামের উপন্যাসের নায়ক। অবলােমভের নামটি জাড্য, গতিহীনতা ও অচলতার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে।
৬. মূল উৎসে সম্ভবত ছাপার ভুল ছিল, অর্থের দিক থেকে হওয়া উচিত উপন্যাসে (রমানাখ), কাঠামোয় (রামকাখ) নয়। – সম্পাঃ
৭. লেখাটি অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি. আই. লেনিনের সংকলিত গ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, টাঙ্গন ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃষ্ঠা ১৪-১৯ থেকে সঙ্কলিত।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।