শাসক শ্রেণিগুলির বিরুদ্ধে তলস্তয়ের অভিযোগ প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং অকৃত্রিম; গির্জা, আইন-আদালত, সমরবাদ, ‘আইনগত’ বিবাহবন্ধন, বুর্জোয়া বিজ্ঞান, ইত্যাদি যেসব প্রতিষ্ঠানাদি দিয়ে আধুনিক সমাজ বজায় থাকে সেগুলোর ভিতরকার মিথ্যাচার তিনি একেবারে স্পষ্ট করে খুলে ধরেছেন। কিন্তু, আধুনিক সমাজব্যবস্থার কবরখনক প্রলেতারিয়েতের জীবন, কর্ম এবং সংগ্রামের একেবারে বিরুদ্ধ প্রতিপন্ন হয়েছে তাঁর মতবাদ। লেভ তলস্তয়ের শিক্ষায় তাহলে প্রতিফলিত হয়েছে কার দৃষ্টিকোণ? তাঁর মুখে ফুটেছে সেই বহুসংখ্যক রুশ জনগণের কথা, যারা আধুনিক জীবনের কর্তাদের অত্যন্ত ঘৃণা করে ইতিমধ্যেই, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সচেতন, সামঞ্জস্যপূর্ণ, পুরাদস্তুর, অনমনীয় সংগ্রাম চালাবার পর্যায়ে পৌছয় নি এখন পর্যন্ত।
রাশিয়ার মহাবিপ্লবের ইতিহাস আর পরিণতি থেকে দেখা গেছে, শ্রেণি সচেতন সমাজতন্ত্রী প্রলেতারিয়েত এবং পুরনো রাজের ডাহা সমর্থকদের মধ্যবর্তী জনসমষ্টি ছিল ঠিক এমনই। প্রধানত কৃষকদের নিয়ে এই জনসমষ্টি বিপ্লবের মধ্যে দেখিয়েছে পুরনোর বিরুদ্ধে তার ঘৃণা কত প্রবল, আধুনিক রাজের আঘাতগুলোকে তারা অনুভব করে কত তীব্রভাবে, সেইসব আঘাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া এবং উন্নততর জীবনের জন্যে তাদের ভিতরে স্বতঃস্ফত আকুল আকাঙ্ক্ষা কী বিপুল।
কিন্তু, তারই সঙ্গে সঙ্গে, বিপ্লবের মধ্যে এই জনসমষ্টি দেখিয়েছে ঐ ঘৃণা করতে গিয়ে তারা রাজনীতিগতভাবে যথেষ্ট সচেতন ছিল না, সংগ্রামে তারা সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না, উন্নততর জীবনের সন্ধানে তারা আবদ্ধ ছিল সংকীর্ণ গণ্ডির ভিতরে।
গভীরতম প্রদেশ অবধি আলোড়িত এই মানব-মহাসমুদ্র তার যাবতীয় দুর্বলতা এবং বলিষ্ঠ উপাদানগুলি সমেত প্রতিবিম্বিত হয়েছে তলস্তয়ের মতবাদে।
লেভ তলস্তয়ের সাহিত্যিক রচনাবলি পড়ে রুশ শ্রমিক শ্রেণি তার শত্রুদের আরও ভালভাবে চিনতে শিখবে, কিন্তু তলস্তয়ের মতবাদ বিচারবিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমগ্র রুশ জনগণকে বুঝতে হবে তাদের নিজেদের দুর্বলতাটা কোথায় – যে-দুর্বলতা তাদের মুক্তির লক্ষ্যটাকে সমাপ্তি অবধি নিয়ে যেতে দেয় নি। এগিয়ে যাবার জন্যে এটা অবশ্যই বোঝা দরকার।
তলস্তয়কে যারা বলে ‘সর্বজনীন বিবেক’, ‘জীবনের গুরু’, তারা সবাই এই অগ্রগতি ব্যাহত করছে। তলস্তয়ের মতবাদের বিপ্লববিরোধী দিকটাকে কাজে লাগাবার বাসনা অনুসারে উদারপন্থীরা সুপরিকল্পিতভাবে ছড়াচ্ছে এই মিথ্যাটাকে। ‘জীবনের গুরু’ হিসেবে তলস্তয়-সংক্রান্ত এই মিথ্যাটাকে উদারপন্থীদের ঢঙে পুনরাবৃত্তি করছে কিছু-কিছু প্রাক্তন সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট।
রুশ জনগণ মুক্তি অর্জন করবে কেবল তখনই যখন তারা উপলব্ধি করবে যে, উন্নততর জীবন লাভ করতে তাদের শিখতে হবে তলস্তয়ের কাছ থেকে নয়, তা শিখতে হবে সেই শ্রেণির কাছ থেকে যার তাৎপর্য তলস্তয় বোঝেন নি, তলস্তয় যে-পুরনো দুনিয়াটাকে ঘৃণা করতেন সেটাকে বিনষ্ট করতে সক্ষম যে-শ্রেণি। সে-শ্রেণি প্রলেতারিয়েত।
২০ম খণ্ড, ৭০-৭১ পৃষ্ঠা
২ নং ‘রাবোচায়া গাজেতা’,
১৮ (৩১) ডিসেম্বর, ১৯১০
বি. দ্র. লেখাটি ভি. আই. লেনিনের সংকলিত গ্রন্থ সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭ থেকে সঙ্কলিত।
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (এপ্রিল ২২, ১৮৭০ – জানুয়ারি ২১, ১৯২৪) ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা, একজন মার্কসবাদী রুশ বিপ্লবী এবং সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। লেনিন ১৯১৭ সালে সংঘটিত মহান অক্টোবর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।