বুদ্ধনারকেল বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী একটি সংরক্ষিত উদ্ভিদ। এটি ফুল কিংবা ফলের জন্য নয়, তার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই বিখ্যাত। গাছের কাণ্ড বেশ বড়, গোলাকার এবং বহু শাখা-প্রশাখা সত্ত্বেও যথেষ্ট বলিষ্ঠ। শাখা-প্রশাখাগুলো ততটা লম্বা নয়, অনেকটা বিক্ষিপ্ত ধরনের। অবশ্য অল্প বয়সী গাছের বৈশিষ্ট্যটি তেমন স্পষ্ট নয়। বাকল মসৃণ ও ধূসর। ভূমিলগ্ন কাণ্ড ও গোড়া গভীর খাঁজযুক্ত। পাতা তুলনামূলকভাবে বড়ই বলা চলে। দেখতে অনেকটা তাম্বুলাকৃতির, দীর্ঘবৃন্তক, শাখান্তে একান্তরভাবে ঘনবদ্ধ গাঢ়-সবুজ এবং শিরাবিন্যাস যথেষ্ট সুস্পষ্ট।
বসন্তের শুরুতেই গাছটি পাতা ঝরাতে শুরু করে। কিন্তু চৈত্র মাসের প্রথম ভাগেই আবার অসংখ্য পাতায় ঢেকে যায় সারা গাছ। তবে বিলম্বিত পত্রোদ্গম এ গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কচি পাতার রং অনেকটা ম্লান সবুজ। পরিণত বৃক্ষ ছায়াসমৃদ্ধ না হলেও নতুন গাছ পত্রনিবিড়। ফুল ফোটার মৌসুম বসন্তকাল। এর স্বল্পপৌষ্পিক মঞ্জরি নিতান্তই অনাকর্ষী। পাপড়ির বাইরের দিকটা বাদামি রঙের, আর ভেতরটা লাল রঙের। পরাগকেশর পাঁচটি। ফুল দুর্গন্ধী।
পরিণত ফলগুলো আপনা-আপনিই ফেটে যায়। এর পর বীজগুলো বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফল দেখতে নারকেলের মতো এবং গন্ধও অনেকটা নারকেলের মতো মনে হলেও, ভিতরে নারকেল বলতে যা থাকে তা অত্যন্ত ক্ষীণ। ফলের ভেতরে বিসরণের জন্য থাকে ভাঁজ করা পক্ষল বীজ যা জোর বাতাসে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ে।
বুদ্ধনারিকেলের বয়স্ক গাছের গোড়ায় যে চ্যাপ্টা অধিমূল (Buttress) সৃষ্টি হয় তা বেশ চোখে পড়ার মতো, শিমুলের সঙ্গে যা কিছুটা তুলনীয়। ব্রাজিল-নাট, শিমুল বা বুদ্ধনারিকেল বৃষ্টিবনের সর্বোচ্চ স্তবক বা ইমার্জেন্ট লেয়ারের গাছ। এদের মাথা অন্য গাছের ক্যানপির উপর দিয়ে দেখা যায়।
বুদ্ধনারিকেল গাছ বেশ লম্বা হয়, পুরনো গাছ ১৫০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ভারত-বাংলাদেশে অধিকাংশ পুরনো গাছই কাটা পড়েছে। এই গাছের কাঠ বেশ মূল্যবান। বীজ কোনো কোনো অঞ্চলে আফিমের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার্য।
প্রাপ্তিস্থান: বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বুদ্ধনারিকেল (Pterygota alata) গাছ দেখা যায়। আছে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে, আসাম, পুনা, কর্ণাটক এবং তামিলনাডুতেও। টেরিগোটা গণে বেশি গাছ নেই। মাদাগাস্কার, বোর্নিও, মালয়েশিয়া, চীন ও আফ্রিকা মিলিয়ে সন্ধান পাওয়া গেছে ২১টি প্রজাতির। এই গাছের কাঠ হালকা যা দিয়ে প্যাকিং বাক্স ও প্লাইউড তৈরি করা যায়। বীজ থেকে তৈরি হতে পারে উপাদেয় তেল এবং গাছের ছাল থেকে পাওয়া যায় শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যার ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক মূল্য আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে গিয়ে আপনি রাজু ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়ালে সবচেয়ে উঁচু যে গাছটি চোখে পড়বে, তার নাম বুদ্ধনারকেল। পাশেই পাবেন দুটো সুদর্শন বেরিয়া গাছ। প্রাক বর্ষায় এদের ফুল ফোটার সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য। এই শহরে বুদ্ধনারকেলের মতো এমন উঁচু গাছ অনেকটাই দুর্লভ। কাছাকাছি উচ্চতার মধ্যে রয়েছে দেবদারু। জানামতে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বুদ্ধনারকেল দেখা যায় দিলকুশা সংলগ্ন বঙ্গভবনের সীমানা প্রাচীরের পাশে। রমনা উদ্যানের মধ্যেও এক দুটি গাছ আছে। ঢাকার বাইরে আছে সবচেয়ে বেশি রংপুর শহরে। সেই সূত্রে রংপুর শহরকে নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধনারকেলের শহর বলা যায়।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।