আগর বা অগুরু গাছের ভেষজ গুণাগুণ ও বিবিধ ব্যবহার

বিবরণ: আগর বিরাট, চিরসুবজ, শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট গাছ। যা ১৫ থেকে ২০ বা কোনো কোনো সময় ৪০ মিটারের মতো দৈর্ঘ্য হতে পারে। এর আদি জন্মভূমি পূর্ব হিমালয়, ভুটান, আসাম, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। বাকল ধূসর, পাতলা, খসখসে, ভিতরের বাকল ঘষে শুকিয়ে তাতে লেখা যায়। প্রাচীন আসামের দেশীয় রাজারা এতে লিখতেন। গাছটি দেখতে সুন্দর এবং গাছের গা থেকে মধুর গন্ধ বের হয়। পাতা শাখার উভয়দিকে যুগভাবে জন্মে, পাতলা চর্মবৎ, আয়ত-বর্শাফলকাকৃতি ও ৮ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায়; অগ্রভাগ ক্রমশ সরু। একই পুষ্পদণ্ডে সাদা রঙের অনেক ফুল হয়, পাপড়ি অবনত, ৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়। ফল নরম ৩ থেকে ৪ সেমি লম্বা, ফলের বহির্বাস ফলে লেগে থাকে। জুন মাসে ফুল এবং আগস্ট মাসে ফল হয়।

অন্যান্য নাম: এর কয়েকটি পর্যায়িক নাম রয়েছে- আগর, অগুরুসার, স্বাদু, সুধুম্যো, গন্ধধূমজ, ক্রিমিজ। বিভিন্ন ভাষায় এর বিভিন্ন নাম আছে: সংস্কৃতে- অগুরু, হিন্দিতে- অগর; তামিল- আগলিচল; আরবীতে- উদ; ইউনানীতে- উদগরকী, উদহিন্দি, আগর; ইংরেজিতে- Eagle Wood। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম—Aquilaria malaccensis Lam. (সমনাম: A. agallocha Roxb.) গোত্র- থাইমেলাসিয়াস।

প্রাচীন শাস্ত্রে:

রাজনিঘটুকার চার প্রকার অগুরুর উল্লেখ করেছেন—কৃষ্ণাগুরু (আসামে জন্মে), কাষ্ঠাগুরু (পীতবর্ণ), দাহাগুরু (গুর্জরে জন্মে) এবং মাঙ্গল্যগুরু (কেদারে জন্মে) । আয়ুর্বেদে কৃষ্ণাগুরুকে উৎকৃষ্ট বলা হয়েছে। আজকাল গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এ শ্রেণীবিন্যাসে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি দেখানো হয়। রজন- ক্রমসঞ্চয়নের ব্যাপকতার উপর নির্ভর করে অগুরুকে চারভাগে ভাগ করা হয়- (১) ১ নম্বর গ্রেড বা কৃষ্ণ বা। প্রকৃত আগর- এতে রজনের সম্পৃক্ততা ঘন এবং কাঠকে কালো পাথর বলে মনে হয়; (২) ২ নম্বর গ্রেড বা বাটাং খয়েরি রং, যার কোনো কালো ছাপ নেই; (৩) ৩ নম্বর গ্রেড বা ভুটা বা ফুটা- ভুটায় অর্ধেক খয়েরি হলেও বাকি অর্ধেক বা তার অধিক হলুদ এবং (৪) ৪ নম্বর গ্রেভ বা ধুমরি প্রায় সম্পূর্ণ কাঠই হলুদ রঙের। মাঝেমধ্যে খয়েরি এবং কালো রজনের দাগ থাকে। কৃষ্ণ বা প্রকৃত আগর কাঠ ভারী, পানিতে ডুবে যায়। এজন্যই বোধ হয় নাম আগর। এতে তেলের পরিমাণ সর্বাধিক কিন্তু পাতন কষ্টকর।

আরো পড়ুন:  সাদা তুঁত গাছের নানাবিধ ভেষজ প্রয়োগের বিবরণ

অগুরু উষ্ণবীর্য, কুটরস, তিক্ত, ত্বকের উপকারী, তীক্ষ্ণ, পিত্তবর্ধক, লঘু, কর্ণ এবং চোখের রোগনাশক, শীতনিবারক এবং কফ বাতনাশক। চরক সংহিতার চিকিৎসাস্থানের ২১ অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে হিক্কা রোগীকে মধুর সঙ্গে কৃষ্ণ আগর (কৃষ্ণাগুরু) চূর্ণ সেবন করানোর বিধান। সুশ্রুত সংহিতায় আছে লবণ মেহে অগুরু এবং আকনাদি-এর ক্বাথ সেবন করার কথা (চিকিৎসাস্থান ১৩ অধ্যায়)। চিকিৎসাস্থানের ৩১ অধ্যায়ে দুদ্র, কুষ্ঠ ও কিটিম রোগে অগুরুর তৈল অভ্যঙ্গ করানোর কথা বলা হয়েছে। এক চা-চামচ কৃষ্ণাগুরু ঘষা হালকা গরম পানি ১ কাপসহ খেলে মেহ, হাঁপানি ও পাণ্ডরোগে উপকার হয়।

আগর বা অগুরু গাছের আধুনিক চিকিৎসায় বর্ণনা:

বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারী ১৯৯২-তে দশটি ওষুধে আগর গাছের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করার উল্লেখ করা হয়েছে। ওষুধগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যথা: মুখদৌর্গন্ধ, মেদোরোগ, হৃদরোগ, পাণ্ডু, প্রমেহ, অর্শ খিল, কুষ্ঠ, প্রমেহাশ্রিত বাতরোগ, ধ্বজভঙ্গ, পিত্তদুষ্টি, রক্তদুষ্টি, জরায়ুদোষ, রজোদুষ্টি, শুক্রদোষ প্রশমক হিসাবে প্রয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় ইউনানী ফর্মুলারী ১৯৯৩-তে পঁচিশটি ওষুধে আগর ব্যবহারের উল্লেখ করা হয়েছে। ওষুধগুলো ক্ষেত্রবিশেষে হৃৎকম্প, পাকস্থলীর দুর্বলতা, বমি, ক্ষুধামান্দ্য, দাস্ত, যকৃতের দুর্বলতা, পাকস্থলীর দুর্বলতা, মূত্রাশয়ের দুর্বলতা, মূত্রাধিক্য, বৃক্ক বেদনা, কোমর ব্যথা, বৃক্কের দুর্বলতাজনিত মূত্রাধিক্য লক্ষণে প্রয়োগ করা হয়। আগর কাঠকে পাতনপ্রণালীর সহায়তায় যে বান তেল নিষ্কাশন করা হয় তাতে সেলিনিন, এগারল, কিটোন প্রভৃতি পাওয়া যায়।

আগর বা অগুরু গাছ ঔষধি হিসাবে ব্যবহার:

শ্বাস কষ্ঠে: বাগভট চিকিৎসাস্থান ৩ অধ্যায়ে কাশিতে মধুসহ অগুরু; হিক্কা ও শ্বাস কৃষ্ণাগুরুর ধোঁয়া নাক দ্বারা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

মেদ কমাতে: আয়ুর্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে আগর রসবহ ও রক্তবহ স্রোতে কার্যকর। কৃষ্ণাগুরু চন্দনের মতো ঘষে ১ চা-চামচ করে সকাল-বিকাল খেলে মেদরোগ সারে।

চর্মরোগ সারাতে: আগর ঘষে গায়ে মাখলে চুলকানি, ছুলি ও ঘামাচি নিরাময় হয়।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

আরো পড়ুন:  ঝুনঝুনা কড়ই বা লোহা শিরিষ এশিয়ার শোভাবর্ধক ও ভেষজ বৃক্ষ

তথ্যসূত্রঃ

১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার),  দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ১৪৫-১৪৭।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Vinayaraj

Leave a Comment

error: Content is protected !!