শার্ল ফুরিয়ে ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী

শার্ল ফুরিয়ে বা ফ্রাঙ্কো-ম্যারি-চার্লস ফোরিয়ার (ইংরেজি: François Marie Charles Fourier; ৭ এপ্রিল ১৭৭২ – ১০ অক্টোবর ১৮৩৭ খ্রি.) ছিলেন বিখ্যাত ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী। ফুরিয়ে একটি অর্থবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং পিতার মৃত্যুর পরে নিজে যথেষ্ট অর্থের মালিকও হন। কিন্তু পরিবর্তীকালে রাজনৈতিক গণ্ডগোলে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিনষ্ট হয়। ফুরিয়ে প্রথমে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন। পরে তিনি একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন। সমাজ সম্পর্কে তাঁর প্রথম বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ ১৮০৮ সনে প্রকাশিত হয়।[১]

একদিকে ফরাসি বিপ্লবের সাম্যমৈত্রীয় আদর্শ, অপর দিকে পুঁজিবাদের বাস্তব জীবনে শোষক শোষিতের ব্যবধান ফুরিয়েকে সমাজের এই বৈপরিত্যের বিশ্লেষণে উদ্ধুদ্ধ করে। ফুরিয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে সমাজের এক শ্রেণীর সম্পদ এবং অপর শ্রেণীর দারিদ্র্যের চিত্র অঙ্কন করেন। এই অসঙ্গতি তাঁকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার পথে নিয়ে যায়। এই বৈষম্যের কারণ কি? মানুষ কি স্বভাবগতভাবে কেউ শোষক এবং কেউ শোষিত হবে? এ প্রশ্নের জবাবে ফুরিয়ে ফরাসি বস্তুবাদীদের দর্শনকে সমর্থন করে বলেন যে, মানুষ স্বভাবগতভাবে শোষক বা শোষিত নয়। মানুষের কোনো প্রবৃত্তিই তার মনজাত নয় –তা তার সমাজ বা পরিবেশজাত।

ফুরিয়ের মতে চরিত্র অধিকাংশ মানুষের জন্য অমঙ্গলকর তা দূরীকরণের উপায় হচ্ছে বাস্তব পরিবেশকে পরিবর্তন করা। সুখ কিংবা স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করার ইচ্ছা মানুষমাত্রেরই স্বাভাবিক। প্রয়োজন হচ্ছে এমন এক সমাজ সৃষ্টির যে সমাজে প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছা চরিতার্থ হতে পারবে। ফুরিয়ের মতে এ সমাজ সৃষ্টিতে বিপ্লব বা জবরদস্তির কোনো প্রয়োজন নেই। এজন্য আবশ্যক মানুষের বৃহৎ সমাজকে স্বল্পসংখ্যক (চারশত পরিবারের) উৎপাদনশীল কতকগুলি ফ্যালাঞ্জ বা বাহিনীতে বিভক্ত করা। ফুরিয়ের মতে এরূপ স্বল্পায়তন একই ভবিষ্যৎ সমাজের মূল কোষ হিসাবে কাজ করবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যরা গৃহের ন্যায় স্বাধীনভাবে পরিশ্রম করবে। পরিশ্রমের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা থাকবে না এবং শ্রমের বিভাগও এই ফ্যালাঞ্জ সমাজে এরূপ হবে না যে, একজন উৎপাদক উৎপাদিত দ্রব্যের মাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে জড়িত থাকবে।

আরো পড়ুন:  রবার্ট বেলারমিন মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত ক্যাথলিক লেখক

আধুনিক শিল্পোৎপাদনের চরম শ্রমবিভাগ শ্রমকে অর্থহীন একঘেঁয়েমিপূর্ণ যাতনাকর দৈহিক শ্রমে পর্যবসিত করেছে। পরিকল্পিত সমাজে একজন শ্রমিক শুধু এক রকম নয়, সব রকম উৎপাদনের সঙ্গেই জড়িত থাকবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যদের দৈনন্দিন শ্রম এরূপভাবে সংগঠিত হবে যাতে একজন শ্রমিক একটা নির্দিষ্ট সময় (দেড় ঘণ্টা থেকে দুঘণ্টা) একটা নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত থাকার পরে ভিন্নতর কাজে নিযুক্ত হবে। এভাবে সংকীর্ণ পেশাদারী চরিত্র কারুর মধ্যে জন্মলাভ করতে পারবে না। সবাই উৎপাদনের সামগ্রিকরূপের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। এভাবে ফ্যালাঞ্জ-এর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ফ্যালাঞ্জ-এর সম্পদে প্রাচুর্য আসবে। উৎপাদিত সম্পদ ফ্যালাঞ্জ-এর সদস্যদের মধ্যে তাদের নিজ নিজ দক্ষতা এবং শ্রমের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে।

ফুরিয়ে শহর এবং গ্রাম এবং দৈহিক শ্রম এবং মানসিক শ্রমের মধ্যকার পুঁজিবাদী সমাজের বিরোধ দূর করার প্রয়োজনের উপরও জোর দিয়েছিলেন। ফুরিয়ের এসব মানবতাবাদী কল্পনার মহত্ত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ পরিবর্তনে শ্রমিক শ্রেণি যে অগ্রসর ভূমিকা পালন করবে –এ সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। অন্যান্য কল্পলৌকিক সমাজতান্ত্রিকের মত ফুরিয়েও পুঁজিবাদীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন।

শার্ল ফুরিয়ে ছিলেন সেই অল্প সংখ্যক সমাজতন্ত্রীদের অন্যতম, নারী মুক্তির জন্য যিনি উদ্দীপ্ত সংগ্রাম চালান। মহান এই ইউটোপিয়ান সামাজিক প্রগতিকে স্থাপন করেছেন নারী মুক্তির উপর সরাসরি নির্ভরশীলরূপে।[২]

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬।

২. অনুপ সাদি, সমাজতন্ত্র, কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র, ভাষাপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৫; পৃষ্ঠা ৪০

Leave a Comment

error: Content is protected !!