চার্বাক দর্শন বা চার্বাকবাদ বা লোকায়ত বা লোকায়ত দর্শন (ইংরেজি: Charvaka) হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী মতবাদ। মূলত ভারতের প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনকে লোকায়ত দর্শনও বলা হয়। ভারতীয় দর্শনকে সাধারণত ভাববাদী বলে মনে করা হয়। কিন্তু গ্রীক দর্শনের ন্যায় ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসেও অতি প্রাচীনকাল থেকে বস্তুবাদী দর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায। ঋগবেদে বৃহস্পতির যে মতের উল্লেখ দেখা যায় সে মতকে ভারতীয় দর্শনের আদি বস্তুবাদী মত বলা যায়। বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা –ঋগবেদে বৃহস্পতির এরূপ অভিমতের উল্লেখ আছে। বৃহস্পতির এই বস্তুবাদী অভিমতের অনুসরণ করে চার্বাকবাদের উৎপত্তি ঘটে।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থ
চার্বাকবাদীদের মতে জগৎ কেবল দুঃখপূর্ণ নয়। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে সুখলাভ। সুখই হচ্ছে যথার্থ উত্তম। চার্বাকবাদীদের সুখলাভের তত্ত্বকে ভাববাদীগণ বিকৃত করে তাকে কেবলমাত্র স্থূল এবং অবিমিশ্র সুখের তত্ত্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’ প্রবচনকে বিকৃতভাবে চার্বাকবাদীদের জীবনদর্শন বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু চার্বাকবাদীগণ অবিমিশ্র সুখের কল্পনাকে অসার বলেছেন। ‘ঋণ করেও ঘৃত’ খাবার নীতি দ্বারা চার্বাকগণ জীবনে দুঃখকে বড় না করে দুঃখের মধ্যেও জীবনকে আনন্দময় ভাবার চেষ্টা করতে বলেছেন।
উৎস
লোকায়তবাদীগণের নিজস্ব রচনার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। বস্তুত ভারতীয় দর্শনের প্রধান ও পরাক্রমশালী ভাববাদী ধারা লোকায়ত দর্শনকে তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে জনমন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টা কেবল প্রতিযুক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে নি। কায়েমী স্বার্থের অনুকূলে ভাববাদী দার্শনিকগণ লোকায়তবাদীদের দৈহিকভাবেও নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে। ফলে তাদের সমালোচনার মধ্যে মাত্র লোকায়ত দর্শনের আভাস পাওয়া যায়। এতে লোকায়তবাদীদের নিজস্ব ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও প্রতিযুগে প্রতিষ্ঠিত ধারার বিরুদ্ধে লোকপ্রিয় এবং বস্তুবাদী একটি চিন্তাধারা যে ভারতের বুকে সংগ্রামরত ছিল, আমরা তা অনুমান করতে পারি।
লোকায়ত মতের আদি উল্লেখ পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্মযাজকীয় গ্রন্থে, বেদ এবং সংস্কৃতীয় মহাকাব্যে। প্রাচীন উপাখ্যানে মুনি বৃহস্পতিকে লোকায়ত মতের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করা হয়। বেদের বিরুদ্ধে নাস্তিকতাবাদী যে-সমস্ত উক্তির সাক্ষ্য পাওয়া যায়,ল সে সমস্ত উক্তি চার্বাকের বলে মনে করা হয়। এজন্য ভারতীয় বস্তুবাদ চার্বাকবাদ বলেও চিহ্নিত হয়ে আসছে।
চার্বাক দর্শন
লোকায়ত দর্শনের মূল হচ্ছে সত্তার স্বরূপ সম্পর্কে অভিমত। লোকায়ত মতে বিশ্বের মূলে আছে ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং ব্যোম অর্থাৎ মাটি, পানি, আগুন এবং আকাশ এই চারটি অস্তিত্ব। প্রত্যেক অস্তিত্ব একপ্রকার অণুর সম্মেলনে গঠিত। অণুর চরিত্র এই যে, অণু নিজে অপরিবর্তনীয় এবং অক্ষয়। সময়ের আদি থেকেই অণু অস্তিত্বমান। বস্তুর প্রকার বা চরিত্র নির্দিষ্ট হয় তার গঠনের মৌলিক অণুর প্রকার এবং তাদের সম্মেলনের অনুপাত দ্বারা। একটি সপ্রাণ অস্তিত্বের মৃত্যুর পরে তার সাংগঠনিক অণু বিশ্লিষ্ট হয়ে অপ্রাণ বস্তুজগতে তার সদৃশ্য অণুর সঙ্গে গিয়ে সম্মিলিত হয়। লোকায়তের কোনো কোনো পাঠে ক্রমবিকাশতত্ত্বেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কেননা লোকায়তবাদীগণ বস্তুকে মূল ধরে তা থেকে অপর বিশেষ বস্তু বা প্রাণের বিকাশের কথা অনুমান করেছেন। জ্ঞানের প্রশ্নে লোকায়তবাদীগণকে ইন্দ্রিয়বাদী বলা যায়। তাদের কাছে যথার্থ জ্ঞানের একমাত্র উৎস হচ্ছে ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতা। ইন্দ্রিয়সদৃশ বস্তুর জ্ঞান লাভ করতে পারে। লোকায়ত মতে অনুমানসিদ্ধ জ্ঞানের কোনো স্বীকৃতি নেই। অনুমান জ্ঞানের অনির্ভরযোগ্য এবং ভ্রান্তিকর উপায়। বেদের বিধানও যথার্থ নয়। কেননা, বেদের বিধান কারো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত নয়। বেদের বিধান পরোক্ষ এবং অনুমানমূলকমাত্র। লোকায়ত দর্শন ঈশ্বর কিংবা আত্মার অস্তিত্ব এবং পুনর্জন্ম-কাউকে স্বীকার করে না। জীবনযাপনের নীতিতে লোকায়তবাসীগণ ‘সুখবাদে’ বিশ্বাসী ছিলেন।
মহাকাব্য রামায়ণে ঋষি জাবালীর উক্তির মধ্যেও বস্তুবাদী ভাব পাওয়া যায়। চার্বাকবাদী দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্ব। তাদের মতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বাইরে কোনো জ্ঞানই সংশয়মুক্ত হতে পারে না। চার্বাক দর্শনে গোড়ার দিকে ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম মনে করা হত। এ কারণে চার্বাক দর্শনে প্রথমে আনুমানকে জ্ঞানের উপায় হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। প্রত্যক্ষভাবে মানুষ কেবল বিশেষকেই জানতে পারে, নির্বিশেষকে নয়। এ জন্য যে জ্ঞান বিশেষের নয়, নির্বিশেষের সে জ্ঞানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনুমান হচ্ছে নির্বিশেষ জ্ঞান। কিন্তু অনুমানকে অস্বীকার করলে আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধি থেকে পরবর্তীযুগের চার্বাকবাদীগণ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে অনুমানকেও জ্ঞানের একটি মাধ্যম বলে স্বীকার করেছেন। অনুমানের অস্বীকৃতির ভিত্তিতে আদি চার্বাকবাদীগণ কার্যকারণের জ্ঞানকেও অগ্রাহ্য করেন।
মানুষ ঘটনাকেই শুধু প্রত্যক্ষ করতে পারে। তাদের মধ্যকার সম্বন্ধকে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। ঘটনায় ঘটনায় কোনো প্রত্যক্ষ যোগ সম্পর্ক নেই। মানুষ বলে, আগুণের কারণে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। চার্বাক দর্শনের মতে আগুন এবং ধোঁয়া দুটি ঘটনা। মানুষ এই ঘটনা দুটিকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে। আগুণ ও ধোঁয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ককে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। কাজেই একটি অপরটির কারণ কিংবা ফল একথা বলার উপায় নেই। চার্বাকবাদীদের এই মতের সঙ্গে ইউরোপীয় অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিক হিউমের কার্যকারণতত্ত্বের মিল দেখা যায়।
চার্বাকবাদীগণ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অর্থাৎ মাটি, পানি ও আগুন এবং বায়ু এই চাররকম বস্তুকে সমস্ত সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেন। বস্তু থেকেই জীবনের সৃষ্টি। চেতনার কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। মানুষ দেহ এবং তার চেতনা হচ্ছে মূল-সত্তা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুতের যৌগিক মিশ্রণের ফল। মন বা আত্মারও কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। দেহের মৃত্যুর সঙ্গে চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু ঘটে। জীবন্ত দেহ মৃহ হয়ে পরিশেষে তার মূল বস্তুতে পরিণত হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আত্মার পুনর্জন্মকে সর্বকালের চার্বাকবাদীগণই অস্বীকার করেছেন।
বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়েছে মূল পদার্থের আকষ্মিক সংমিশ্রণে, কোনো অতি প্রাকৃতিক স্রষ্টার কারণে নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান মানুষের নেই। ভারতীয় দর্শনের ভাববাদ যেখানে জগৎকে মায়া এবং দুঃখপূর্ণ বলে অভিহিত করেছে চার্বাকবাদীগণ সেখানে জগৎ এবং জীবনকে আশাবাদের দৃষ্টিতে দেখেছেন।
চার্বাকবাদীগণ সামাজিক শ্রেণিভেদকেও অস্বীকার করেছেন। ব্রাহ্মণ কিংবা চণ্ডাল সকলের দেহের রক্তের রঙই লাল, এরূপ দ্বিধাহীন সাম্যমূলক উক্তি চার্বাকবাদীগণ করেছেন। বস্তুত ভারতীয় দর্শনে চার্বাকবাদ কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির দর্শন নয়। প্রতি যুগের কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতার প্রতিবাদই চার্বাকবাদ। ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন যুগে ভাববাদী চিন্তা ধারাই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রধান সেই ভাবধারা চার্বাকবাদী বা লোকায়ত চিন্তাধারাকে তার প্রতিপক্ষ মনে করে তাকে বিকৃত এবং নিষিদ্ধ করেছেন। চার্বাকবাদ কোনো প্রখ্যাত দার্শনিকের দর্শন হিসাবে স্বীকৃত না হলেও ভাববাদী ধারার আক্রমণের ভিতরে তার অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ১০৮-১১০, ২৬৯-২৭০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।