ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ

ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ[১]

ফয়েরবাখের বস্তুবাদ সমেত পূর্ববর্তী সমস্ত বস্তুবাদের প্রধান দোষ এই যে, তাতে বস্তুকে [Gegenstand]. বাস্তবতাকে, সংবেদ্যতাকে কেবল বিষয় [Objekt] রূপে বা ধ্যান রূপে ধরা হয়েছে, মানবিক সংবেদনগত ক্রিয়া হিসেবে, ব্যবহারিক কর্ম হিসেবে দেখা হয় নি, আত্মগতভাবে [subjectively] দেখা হয় নি। ফলে বস্তুবাদের বিপরীতে সক্রিয় দিকটি বিকশিত হয়েছে ভাববাদ দিয়ে, কিন্তু তা কেবল বিমূর্তভাবে, কেননা ভাববাদ অবশ্য সংবেদনগত ক্রিয়া ঠিক যা সেইভাবে সেটাকে জানে না। ফয়েরবাখ চান সংবেদনগত বিষয়কে চিন্তাগত বিষয় থেকে সত্যই পথক করতে, কিন্তু খোদ মানবিক ক্রিয়াটাকে, তিনি নৈর্ব্যক্তিক [gegenstāndliche] ক্রিয়া হিসেবে ধরেন না। অতএব, ‘খ্রিস্টধর্মের সারমর্ম’ গ্রন্থে তিনি তাত্ত্বিক ধারণাকেই একমাত্র খাঁটি মানবিক ধারণা বলে গ্রহণ করেন; অপরপক্ষে ব্যবহারিক কর্মকে তিনি তার নোংরা দোকানদারী চেহারায় কলপনা করেন এবং সেইভাবেই সেটাকে স্থিরবদ্ধ করে রাখেন। তাই ‘বৈপ্লবিক’, ‘ব্যবহারিক-পরীক্ষামূলক’ ক্রিয়ার তাৎপর্য তিনি বুঝতে পারেন না।

মানব চিন্তার নৈর্ব্যক্তিক সত্য [objective truth] আছে কিনা, এ প্রশ্ন তত্ত্বগত নয়, ব্যবহারিক। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মানুষেকে তার চিন্তার সততাকে অর্থাৎ বাস্তবতা আর শক্তিকে, ইহমুখিতাকে প্রমাণ করতে হবে। ব্যবহারিক ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন চিন্তার বাস্তবতা বা অবাস্তবতা নিয়ে বিতর্ক নিছক পণ্ডিতী প্রশ্ন।

মানুষ পরিবেশ এবং পরিপালনের ফল, অতএব পরিবর্তিত মানুষ হলো অন্য পরিবেশ এবং পরিবর্তিত পরিপালনেরই ফল, এই বস্তুবাদী মতবাদ ভুলে যায় যে, মানুষই পরিবেশকে পরিবর্তিত করে, এবং স্বয়ং পরিপালককেই পরিপালন করা প্রয়োজন। অতএব, এই মতবাদ অনিবাযভাবেই সমাজকে দুই অংশে ভাগ করে, তার মধ্যে একাংশ সমাজের ঊর্ধ্বে (যথা, রবার্ট ওয়েনের ক্ষেত্রে)।

পরিবেশের পরিবতন এবং মানব ক্রিয়ার পরিবর্তনের মধ্যে মিলিটাকে ধারণা করা এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে বোঝা সম্ভব একমাত্র বৈপ্লবিক পরিবর্তনসাধক ব্যবহারিক কর্ম হিসেবে।

ফয়েরবাখ শুরু করেন ধর্মমূলক আত্ম-অন্যীভবন — জগৎকে একটা ধর্মীয় কল্পিত জগৎ এবং একটা বাস্তব জগৎ রূপে দ্বিগুণিত করার ঘটনাটা থেকে। ধর্মীয় জগৎকে সেটার ঐহলৌকিক ভিত্তিতে পর্যবসিত করাই তাঁর কাজ। তিনি এইটে উপেক্ষা করেন যে, উক্ত কার্য সমাধার পর প্রধানতম কাজটিই বাকি থেকে যায়; কেননা, ঐহলৌকিক ভিত্তিটি যে নিজের কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একটা স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে মেঘলোকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে, এই ঘটনার একমাত্র প্রকৃত ব্যাখ্যা হলো এই ঐহলৌকিক ভিত্তিটিরই স্ববিভাগ এবং স্ববিরোধ। অতএব, শেষোক্তটাকে প্রথমে তার স্ববিরোধের দিক থেকে বুঝতে হবে, তারপর এই বিরোধ দূর করে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সেটার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ফলে, যেমন ধরা যাক, ঐশ পরিবারের রহস্য হিসেবে পার্থিব পরিবার আবিস্কৃত হয়ে গেলেই, পার্থিব পরিবারটিকেই তত্ত্বগতভাবে সমালোচনা করা এবং সেটার ব্যবহারিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান প্রয়োজন।

আরো পড়ুন:  বিশেষ হচ্ছে বস্তু জগৎকে জানার জন্য মানুষের তৈরি একটি দার্শনিক সূত্র

বিমূর্ত চিন্তায় অতৃপ্ত হয়ে ফয়েরবাখ সংবেদনগত ধ্যানের দ্বারস্থ হন, কিন্তু সংবেদ্যতাকে তিনি ব্যবহারিক, মানবিক-সংবেদনগত ক্রিয়া রপে দেখেন না।

ধর্মীয় সারমর্মকে ফয়েরবাখ মানবীয় সারমর্মে পর্যবসিত করেন। কিন্তু মানবীয় সারমর্ম এমন একটা বিমূর্তায়ন নয়, যা প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে নিহিত। বাস্তবে সেটা হলো সামাজিক সম্পর্কসমূহের যোগফল।

এই আসল সারমর্মের সমালোচনায় প্রবত্ত হন নি বলেই ফয়েরবাখ বাধ্য হন :

১) ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মীয় অনভূতিকে [Gemuit] আপনাতে একটা কিছু হিসেবে স্থিরবদ্ধ করে তুলতে এবং একটা বিমূর্ত – বিচ্ছিন্ন — ব্যক্তি-মানুষকে ধরে নিতে।

২) তাই মানবিক সারমর্মকে তাঁর পক্ষে কেবল একটা ‘গণ’ [genus] হিসেবে, একটি অভ্যন্তরীণ মূক সাধারণ গণ হিসেবে গ্রহণ করাই সম্ভব, যা বহু ব্যক্তি-মানুষকে মেলায় কেবল স্বাভাবিকভাবে।

তাই ফয়েরবাখ দেখতে পান না যে, ‘ধর্মীয় অনভূতি’ নিজেই একটা সামাজিক ফল এবং যে বিমূর্ত ব্যক্তিটির বিশ্লেষণ তিনি করেন সেও প্রকৃতপক্ষে কোনো একটা নিদিষ্ট রূপের সমাজের অন্তর্ভুক্ত।

সামাজিক জীবন মূলতই ব্যবহারিক। যেসব রহস্য তত্ত্বকে বিপথচালিত করে নিয়ে যায় অতীন্দ্ৰিয়বাদে, সেই সমস্ত রহস্যেরাই যুক্তিসিদ্ধ সমাধান পাওয়া যায় মানবিক ব্যবহারিক কর্মের মধ্যে এবং সেটা উপলব্ধি করার মধ্যে।

মননসর্বস্ব বস্তুবাদ, অর্থাৎ যে বস্তুবাদ সংবেদ্যতাকে ব্যবহারিক কর্ম হিসেবে বোঝে না, সেটার অর্জিত সর্বোচ্চ শিখর হলো ‘নাগরিক সমাজের’ পৃথক পৃথক ব্যক্তি-মানুষকে নিয়ে ধ্যান।

১০

পুরনো বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হলো ‘নাগরিক সমাজ’; নতুন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হলো মানব-সমাজ বা সমাজীকৃত মানবজাতি।

১১

দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো সেটাকে পরিবর্তন করা ।[২]

টীকাঃ

. ‘ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমহ’ রচনাটি কার্ল মার্কস লেখেন ব্রাসেলসে। ১৮৪৫ সালের বসন্তে। এই সময়ের মধ্যেই তিনি ইতিহাসের বস্তুবাদী তত্ত্বের বিকাশ সাধন মোটের উপর শেষ করেন এবং মানবসমাজটাকে উপলব্ধি করার জন্যে বস্তুবাদ সম্প্রসারিত করেন। এঙ্গেলসের বক্তব্য অনসারে এটি হলো ‘নতুন বিশ্বদৃষ্টির প্রতিভাদীপ্ত ভ্ৰণসত্তার প্রথম দলিল’।

আরো পড়ুন:  সর্বেশ্বরবাদ কাকে বলে?

‘ফয়েরবাখ সম্পবন্ধে থিসিসসমূহ’ রচনায় কার্ল মার্কস ফয়েরবাখ এবং তাঁর নিস্ক্ৰিয়-অনুধ্যয়নশীল দৃষ্টিপাত, মানুষের বৈপ্লবিক, ‘ব্যবহারিক-পরীক্ষামূলক’ কাৰ্যকলাপের গুরুত্ব বুঝতে অপারকতা। জগৎ সংবেদ এবং জগৎটাকে নতুন করে গড়ায় বৈপ্লবিক চলিতকর্মের চূড়ান্ত ভূমিকার উপর মার্কস জোর দেন।

‘ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ’ রয়েছে মার্কসের ১৮৪৪ — ১৮৪৭ সালের ‘মন্তব্য-পুস্তক’-এ এবং শিরোনাম হলো ‘ফয়েরবাখ সম্বন্ধে’। ১৮৮৮ সালে ‘থিসিসসমূহ’ প্রকাশ করার সময়ে এঙ্গেলস এগুলিতে কিছু কিছু, সম্পাদকীয় পরিবর্তন করেন, যাতে এই দলিলটিকে পাঠকের পক্ষে অপেক্ষাকৃত বোধগম্য করা যায় (মার্কস এটিকে ছাপা মনস্থ করেন নি)। বর্তমান সংস্করণে ‘থিসিস সমূহ’ দেওয়া হয়েছে এঙ্গেলসের দেওয়া আকারে, তাতে মার্কসের পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে কিছু কিছুর বাঁকা ছাঁদের অক্ষর এবং উদ্ধার-চিহ্ন যোগ করা হয়েছে, যা ১৮৮৮ সালের সংস্করণে নেই। ‘ফয়েরবাখ সম্পবন্ধে থিসিসসমূহ’ নামটি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্ৰীয় কমিটির মাকসবাদ-লেনিনবাদ ইনসিটটিউট।

২. ১৮৪৫ সালের বসন্তকালে মার্কসের লেখা, ১৮৮৮ সালে এঙ্গেলসের ‘ল্যুডভিগ ফয়েরবাখ এবং চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’ গ্রন্থের স্বতন্ত্ৰ সংস্করণে পরিশিষ্ট হিসেবে প্রথম প্রকাশিত। এই অনুবাদ প্রগতি প্রকাশন মস্কো থেকে ১২ খণ্ডে প্রকাশিত মার্কস এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলীর ১ম খণ্ডের ৭-১০ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হলেও অনুবাদের সময় কিছু শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।– অনুপ সাদি

Leave a Comment

error: Content is protected !!