লোকশিল্প (ইংরেজি: Folk-Art) হচ্ছে ধর্মীয়, সামাজিক জীবন, কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজন থেকে উদ্ভব। লোকশিল্প কোনো একটি অঞ্চল, গোষ্ঠী, সভ্যতার সংস্কৃতিকে ফুটে তোলে। এটি একটি নিখুঁত শৈলী দ্বারা চিহ্নিত হয়, যা তৈরি হয় প্রথাগত নিয়মে। লোকশিল্প ঐতিহ্য হিসাবে সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়কে বর্ণনা করে থাকে, তবে দ্রুত আধুনিকতা, শিল্পায়ন বা বাইরের প্রভাবের কারণে সেটা হ্রাস পায়। বাংলার সংস্কৃতির আবহমান ধারায় লোকশিল্প বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। ‘লোকশিল্প’-এর ইংরেজি প্রতিশব্দটি বহুল পরিচিত ও প্রচলিত।
আদিকাল থেকে মানুষ জীবন সংগ্রামের চিহ্ন হিসাবে যে শিল্পকর্ম রেখে গিয়েছে, তা শিল্পকলা চর্চার পটভূমি আলোচনায় বিশেষভাবে বিষয়বস্তু। হাজার হাজার বছর আগের মানুষগুহায় করতে যে চিত্র, ব্যবহার্য পাথর ও হাড়ের তৈরি প্রাচীন জীবনচর্যার বিষয়কে ফুটে ওঠে। পরবর্তীকালের যুগের পরিবর্তনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, বস্তুগত শিল্পধারার বিকাশ ও বিস্তারে ইন্ধন জোগায়। প্রাচীন সময়কাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বিবর্তনের পরিক্রমায় সমাজ-সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তু লোকশিল্পও সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। কালানুক্রমিক বিবর্তন ও ভৌগোলিক অবস্থানের রকমফেরে লোকশিল্প একটি সজীব বস্তুগত সাংস্কৃতিক উপাদান।
লোকশিল্পের উপকরণ অতি সাধারণ। যা আমরা হাতের কাছেই পাই। মাটি, কাঠ, কাপড়, সুতা, শোলা, শঙ্খ, নল, বাঁশ, বেত, শিং ইত্যাদি দিয়ে নানা ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়। এছাড়া সোনা, রূপা, পিতল, হাতির দাঁত প্রভৃতি মূল্যবান উপকরণও ব্যবহার করা হয়। লোকশিল্পে সাধারণ উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নানন্দিক করে তোলে। লোকশিল্প মুলত গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে আসে তাই এই শিল্পের শিল্পীদের বাস গ্রামে।
লোকশিল্পে মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কাজ করে সেটি হলও মোটিফ। এই মোটিফ গড়ে ওঠে স্থানের আবহাওয়া, ভৌগলিক অবস্থা, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে। মোটিফের বিষয় হয় ফুল, গাছ, লতা, নদী, মাছ, নৌকা ইত্যাদি। [১]
এই লোকশিল্পের বিভিন্ন রূপ আছে যেমন মৃৎশিল্প, কাঠ খোদাই শিল্প, শোলার কাজ, শিকা, ডোকরা শিল্প, পিঠা তৈরির ছাঁচ, মুখোশ শিল্প, বাস্তুশিল্প, নকশি কাঁথা, আলপনা, পটচিত্র, চালচিত্র প্রভৃতি লোকশিল্পের সম্পদ। প্রতিটির শিল্পের আঙ্গিক অঞ্চলভেদে পার্থক্য থাকে। সারাদেশে এর তারতম্যের লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- পুতুল পোড়ামাটি, কাঠ, শোলা ইত্যাদি নানাবিধ মাধ্যমে হয়; মুখোশ যেমন তৈরি হয় মাটি-কাগজ-কাঠ ইত্যাদিতে । সাধারণভাবে দেখা যায় গ্রামীণ শিল্পকলার রূপই লোকশিল্পে প্রতিফলিত হয়। এসব তৈরি করা হয় সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে, নিজেস্ব প্রযুক্তি আর সহজাত কৃৎকৌশলে। সেই কারণে অঞ্চলভেদে লোকশিল্প গুরুত্বলাভ করে। বিশেষ বিশেষ শিল্পীর মৌলিকত্ব ও সৃজনশীলতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক সমাজ-চাহিদায় লোকশিল্প সর্বজনীন রূপ পায়।
প্রাগৈতিহাসিক বা সেকেলে শিল্প ও লোকশিল্পের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা গেলেও লোকবিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস নানা প্রাসঙ্গিক মিল দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে, প্রাচীন মানুষের শিল্পরূপের সঙ্গে লোকশিল্পের পার্থক্য সবক্ষেত্রে উপলব্ধি করা যায় না। তবে লোকশিল্পের স্বকীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। মানব জীবনের চলমান জীবন ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য তাতে দেখা যায়।
প্রাচীন নিদর্শন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে বর্তমান লোকশিল্পের পার্থক্য বহুলাংশে বিবেচিত হয়। আবার আদিবাসী সংস্কৃতির স্ব-শৃঙ্খলিত সামাজিক কাঠামোর মধ্যে তৈরি হওয়া শিল্পের সঙ্গে সমতলের শিল্পকলার ভেদরেখাও গড়ে ওঠে। এজন্য লোকশিল্পের বিভিন্ন প্রকারভেদ করা হয়েছে যেমন- কারুশিল্প, চারুশিল্প, হস্তশিল্প এবং কুটিরশিল্প। এসব প্রকারভেদ আঞ্চলিক জনজীবন ও আঙ্গিকগত অবস্থা থেকে প্রকাশ পায়। নকশা, মোটিফ, প্রতীক, রূপকল্প প্রভৃতি চিহ্নিতকরণের মাধ্যমেও আঞ্চলিক ঐতিহ্যে প্রকৃত রূপ বোঝা যায়। জীবজগৎ, পরিবেশ, ব্যবহারিক জীবনসহ জ্যামিতিক নকশার কাঠামো গড়ে ওঠে লোকশিল্পের আঙ্গিক তৈরির পদ্ধতি, উপাদান ও সমাজ-সাংস্কৃতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তা বহুলাংশে জানা যায় ।
একটি দেশের অঞ্চল বিশেষে আচার, বিশ্বাস এবং ধর্মীয় পটভূমির সর্বজনীন প্রেক্ষাপটে লোকশিল্পের সম্পর্কসূত্র মূল্যায়ন করা হয়। তবে লোকশিল্পের বিভাজনরেখা নির্দিষ্টকরণ নিতান্তই জটিল প্রক্রিয়া। কোনো জনগোষ্ঠীর শিল্প কাজমাত্রই যেমন লোকশিল্প নয়, তেমনি সূক্ষ্ম কারুকাজই সবসময় লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত নয়। আদিবাসী শিল্পকলায় একান্তভাবে ব্যবহারিক ও ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক রূপ দেখা যায়। এই শিল্পকলা অনাদিকালের উত্তরাধিকারী ও নিয়মরীতির অনুসারী। কারুশিল্পের ক্ষেত্রে বাঁধাধরা নিয়ম, পূর্বধারণাপ্রসূত ঐতিহ্য ও সুশৃঙখল সূত্রপাত পাওয়া যায় । চিত্রকলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ই যেমন চারুশিল্পের চৌহদ্দি। অন্যদিকে, হস্তশিল্প যান্ত্রিক উৎপাদনের বিপরীত অর্থবোধক বিষয়। মামুলি সূচিকাজ, মডেল প্রভৃতি হস্তশিল্পরূপে চিহ্নিত করা হয়। লোকঐতিহ্যের ধারা এতে পাওয়া যায় না। আবার ক্ষুদ্রায়তনের কারখানায় যে উৎপাদিত সামগ্রী তা কুটিরশিল্পের পর্যায়ে পড়ে।
আদি প্রস্তর যুগ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগ এবং পরে কৃষিকাজের বিস্তার-গ্রাম ও শহরের প্রসার ঘটার সঙ্গে মানুষের শিল্পকাজেরও রূপান্তর এবং বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা যায়। শিল্পকাজ তাই মানুষের ক্রমবিবর্তনে উৎপাদনগত অবস্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। মুর্শিদাবাদের যে হাতির দাঁতের শিল্প বিশেষ পরিচিত ছিল তা ঐতিহ্যশালী শিল্পকাজ, তবে, লোক-উপাদানের সামগ্রিক বিশিষ্টতা নেই। পোড়ামাটির শিল্প, পটচিত্র, মোম গলানো পদ্ধতিতে তৈরি ডোকরা ধাতুশিল্প প্রভৃতিতে যেমন লোক-উপাদানের প্রাচুর্য। সাধারণভাবে যেমন আসবাবের জন্য কাঠের কাজ বা পোড়ামাটির মন্দিরফলক লোকশিল্প নয়।
লোকশিল্পের ক্ষেত্রে গঠনশৈলীতে বা স্টাইলে এবং গ্রামীণ লৌকিক পরিবেশের সরলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা শিল্পের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। লোকশিল্পে শিল্পীর সৃজনশীল মনের আবেগের অভিব্যক্তি যেমন থাকে, তেমনই থাকে সৃষ্টির আনন্দ। মনোরঞ্জন, লোকবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, খেলনা এবং ব্যবহার্য বস্তু হিসাবেও তা ব্যবহৃত হয়। লোকশিল্প সবসময় ঐতিহ্যবাহী হলেও সমস্তপ্রকার ঐতিহ্যবাহী শিল্প লোকশিল্প নয়। মাটি, পাথর, কাঠ, কাগজ, কাপড়, ধাতু, বেত, বাঁশ ইত্যাদি নানা উপকরণ মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে লোকশিল্পের মাধ্যমে। বলা যেতে পারে, যত্র লগ্নং হি হং’-হৃদয় যার সঙ্গে যুক্ত আছে যে শিল্পবস্তু শাস্ত্রের লক্ষণের সঙ্গে না মিলেও মন হরণ করে।
সময়ের স্রোতে লোকশিল্পের বহু বিষয়বস্তু যেমন হারিয়ে যাচ্ছে; আবার, সময়ের পথ ধরে ঐতিহ্যাশ্রিত হয়ে সমাজ-চাহিদায় নতুন সাংস্কৃতিক উপকরণ অঙ্গীভুত হচ্ছে। বহমান সমাজ-সংস্কৃতির অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য ও উপলব্ধিতে লোকশিল্প অনন্য।[২]
তথ্যসূত্র:
১. ওয়াকিল আহমদ; চারু ও কারু লোকশিল্প; বাংলাপিডিয়া, প্রকাশকাল ২৯ অক্টোবর ২০১৪।
২. সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৭৪-৫৭৬।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।