ভূমিকা: বড় আকন্দ বা বড় আকন বা মাদার এক প্রকারের ঝোপ ও গুল্ম জাতীয় মাঝারি ধরনের ওষধি গাছ। এদের কাণ্ড নরম। তাই ফুল আর ফলের ভারে হেলে পড়াভাব দেখা যায়। এজন্য পূর্ণ বয়স্ক আকন্দের উচ্চতাটা ঠিক অনুমান করা মুশকিল। আকন্দের কাণ্ডের রং সাদাটে সবুজ। কাণ্ড বেশ নরম। ফল পাকতে শুরু করলে কিছুটা শক্ত হয়। কাণ্ডের ওপর দিকে কিছু ডালপালা থাকে। মূল থেকে একাধিক কাণ্ড বেরিয়ে ঝোপ তৈরি করে। কাণ্ডের বেড় ১-৩ ইঞ্চি হতে পারে। গাছের ছাল ধুসর বর্ণের এবং কান্ড শক্ত ও কচি ডাল লোমযুক্ত।
আকন্দ গাছে দুধের মতো আঠা (ক্ষীরা) আছে। দু’রকম রংয়ের ফলে আমরা দেখতে পাই, সাদা ও অল্প বেগুনী; সাদা ফুলের গাছকে বলা হয় অলর্ক, যেটাকে আমরা বলি শ্বেত আকন্দ, হিন্দিভাষী অঞ্চলে বলেন “সফেদ অর্ক’ এবং ‘মন্দারাও ব’লে থাকেন।
বড় আকন্দ গাছের বিবরণ:
বড় আকন্দ বৃহৎ গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ, অনূর্ধ্ব ১.৫ মিটার লম্বা। কাণ্ড বহু শাখা বিন্যাসিত ও গোড়া ঈষৎ কাষ্ঠল। আকন্দের পাতা দেখতে অনেকটা বটের পাতার মতো। বটের পাতার মতোই পুরু। বটের পাতা ভাঙলে যেমন সাদা আঠা বের হয়, আকন্দের পাতা ভাঙলেও সাদা আঠা বের হয়। পাতার উপরিভাগ মসৃণ এবং নীচের দিক তুলোর ন্যায়। ক্ষুদ্র বৃন্ত এবং বৃন্তদেশ হৃদপিণ্ডাকৃত। তবে বটের পাতার সাথে বড় পার্থক্য হলো, এর পাতা খুবই নরম। বটের পাতা অতটা নরম নয়। তবে বটের পাতার মতোই মসৃণ। পত্র অবৃন্তক বা অর্ধবৃন্তক, পত্রফলক ৯.৫-১৮.০ X ৬-৯ সেমি, স্পষ্টতঃ ডিম্বাকার বা ডিম্বাকার-আয়তাকার, মাংসল, পার্শ্ব শিরা ৬-৭ জোড়া।
সাইম ছত্রমঞ্জরী বা উপ-সমভূমঞ্জরী, পার্শ্বীয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্বে একল, পুষ্পদন্ড অনূর্ধ্ব ১০ সেমি লম্বা, সামান্য শাখা বিন্যাসিত, গৌণ শাখা অনূর্ধ্ব ২ সেমি লম্বা, পুষ্পবৃন্তিকা দৈর্ঘ্যে পুষ্পদন্ডের তুলনায় খর্বতর, প্রায় ৪ সেমি লম্বা, ঘন তুলাতুল রোমশ। দলমণ্ডল সাদা, ঈষৎ নীল রক্তিমাভ বা রক্তিম, মসৃণ, নল খর্ব, খন্ড ডিম্বাকার-বল্লমাকার, পরিব্যাপ্ত। কিরীট পুংকেশরীয় স্তম্ভের লগ্ন ও দৈর্ঘ্যে পুংকেশরীয় স্তম্ভের তুলনায় খর্বতর, কিরীটীয় শল্ক পাঁচটি, মাংসল, শীর্ষ দুইটি কর্ণসদৃশ অভিক্ষেপ বিশিষ্ট, গোলাকার, মূলীয় স্পার স্থূলাগ্র শীর্ষ বিশিষ্ট ভিতরের দিকে বক্র।
পলিনিয়া দীর্ঘাগ্র-বল্লমাকার, বিলম্বী, প্রতি পরাগধানী থলিতে একল, গাইনোষ্টেজিয়াম প্রায় ১ সেমি লম্বা। ফলিক্যাল জোড়ায় সজ্জিত, ডিম্বাকার, নৌকা-আকৃতি, ৬.৫-৮.০ x ৩-৫ সেমি। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে প্রায় সারা বৎসর জুড়ে তবে গরমকালে প্রচুর পাওয়া যায়। ফুলে হালকা গন্ধ আছে। বৎসরের প্রায় সব মাসেই ফুল দেখা গেলেও ফুলের প্রকৃত সময় ফাল্গুন ও চৈত্র মাস। আকন্দের ফুল বিভিন্ন পোকামাকড়, প্রজাপতি ও পিপীলিকার খাবার জোগান দেয়।
প্রাচীন পরিচিতি: চরক সংহিতায় অর্কের বা আকন্দের কোনো ভেদ আছে ব’লে বর্ণনা করা হয়নি, কিন্তু সুশ্রুত সংহিতায় শ্বেত ও রক্তবর্ণের পুষ্পের উল্লেখ দেখা যায়, আর অপেক্ষাকৃত নবীন বনৌষধির নিঘন্টু গ্রন্থ রাজনিঘন্টুতে চার প্রকার অর্কের বা আকন্দের কথা উল্লেখ দেখা যায়। ক্রোমোসোম সংখ্যা: ২n = ২২ (Sharma, 1970)।
চাষাবাদ ও আবাসস্থল:
উন্মুক্ত পতিত ভূমি, রাস্তার পার্শ্ববর্তী স্থান এবং রেললাইনের ধারে ও গ্রামে নিকটবর্তী এলাকায়, বিশেষত শুষ্কতম অঞ্চল। বংশ বিস্তার হয় বীজ এবং শাখাকলম দ্বারা । ৩ থেকে ৪ ফুট দুরুত্বে আকন্দ গাছ লাগাতে হয়। তবে মে-জুন মাসে ফল পাকলে ফেটে বীজ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এ সময় এটি চাষ করা ভালো। এছাড়াও কাটিং পদ্ধতিতেও এটি চাষ করা যায়। প্রতি কেজিতে বীজের পরিমাণ ১ লক্ষ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজারটি। বীজ থেকে বংশ বিস্তর সম্ভব হলেও সাধারণ এর মোথা ও সাকার অংশ থেকে বংশ বিস্তার হয়ে থাকে।
বীজ থেকে প্রাপ্ত ফ্লস ভারতীয় উপমহাদেশে বালিশ তৈরীতে সালমালিয়া কটন-এর প্রতিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বড় আকন্দের ফলগুলি শিমুল গাছের ফলের মতো আর টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা। ফলের ভেতর তুলোর মতো আঁশ থাকে। আঁশ স্তরে স্তরে সাজানো থাকে থাকে। প্রতিটা স্তরে মাঝে একটা করে পাতলা বিঁচি থাকে। বিঁচির গায়ে পাখনার মতো লেগে থাকে আঁশগুলো। ফল পাকার পর বিঁচিসহ বাতাসে উড়ে দূরে চলে যায় আকন্দের আঁশ। অর্থাৎ আকন্দের বংশবিস্তারে আঁশ এবং বাতাসের ভূমিকা বিরাট। আকন্দগাছ ৭-৮ বছর বাঁচে।
বড় আকন্দ গাছের বিস্তৃতি:
চীন, ভারত, ইন্দেনেশিয়া, মায়ানমার, নেপাল, থাইল্যাণ্ড ও হাওয়াই দ্বীপে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এটি অত্যন্ত সহজপ্রাপ্য এবং সর্বত্র বিদ্যমান। বাংলাদেশে আকন্দের দুটি উপপ্রজাতি দেখা যায়। গাঁয়ের পথের দুপাশে এদের দেখা মেলে সবচেয়ে বেশি। আবার খুব বেশি ছায়াও পছন্দ করে না। তাই বড় বড় গাছের নিচে, কিংবা বাঁশবনে, বাগানে এদের কম দেখা যায়। তবে ছোট-ছোট গুল্মের ওপর নিজের বাহাদুরিটা ফলাতে পারে বলেই পরিত্যক্ত জমিতে এদের দেখা মেলে। উঁই ঢিবিতেও এদের দেখা যায়। আসলে উঁই ঢিবিটা মনে হয় সব গুল্মদের একটু বেশি পছন্দ। উঁই ঢিবির মাটি একটু বেশি উর্বর কিনা! পতিত নীরস জমিতেও তার বাড়বাড়ন্ত কম হয় না।
অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:
আকন্দের তুলো বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে এর তুলো কলকাতায় আমদানি হয়, এর তুলোয় বালিশ তৈরী হয়। এদের মূলের বাকল পরিবর্তন সাধক পদার্থ, বলকারক, খিচুনীনাশক, কফ নিঃসারক, কোষ্টবর্ধক এবং কঠিন আমাশয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। দুগ্ধবৎ নির্যাস কুষ্ঠরোগের উপশমকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদ্ভিদটির জলজ শুরা জাতীয় দ্রবণ ও চূর্ণ ব্রংকাইটিস ও আমাশয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
অল্পমাত্রায় সেবন করলে গাছের সকল অংশেরই পরিবর্তন সাধক গুনাবলী আছে (Chopra et al., 1958)। Calotropis gigantea এর দুগ্ধবৎ তরুক্ষীর অতিকার্যকর কোষ্ঠবর্ধক এবং পাকান্ত্রিক উত্তেজক (Kapoor, 1990)।। জাতিতাত্বিক ব্যবহার হিসেবে বলা হয়েছে বাংলাদেশে, বাঙ্গালী ও আদিবাসি উভয়েই শোথ এবং বাতের ব্যথার জন্য এর তাজা পাতা শুষ্ক উষ্ণ সেঁক হিসেবে প্রয়োগ করে বলে জানা গেছে। গাছের পাতার রস সদ্য হওয়া ক্ষতে জীবাণুনাশক হিসেবেও প্রয়োগ করা হয়। ভারতে এর পাতা হতে “বার” নামক প্রমোত্ততাকারক শুরা তৈরী হয় (Santapau and _Irani, 1962)। এদের ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন
অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ষষ্ঠ খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) বড় আকন্দ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে প্রজাতিটির সংকটের কারণ ও আবাসস্থল বিনাশ এবং বর্তমান অবস্থায় এটি আশংকা মুক্ত (lc) হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে এটিকে সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি এবং বর্তমানে প্রস্তাব করা হয়েছে যে বড় আকন্দ সংরক্ষণের কোনো আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন নেই।
সাহিত্যে আকন্দ: আকন্দকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ_ আপনার মনে
ভাঙিতেছ ধীরে ধীরে;_ চারিদেক এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস …
সতর্কীকরণ: আকন্দ গাছের সব অংশই বিষাক্ত। তাই ব্যবহারে সতর্ক হোন। অতিরিক্ত ব্যবহারে ক্ষতি হবে।
তথ্যসূত্র:
১. এম আতিকুর রহমান, (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস” আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ০৬ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৩৭-২৩৮। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Anup Sadi
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।