সরিষা দানা ও তেলের বিশটি ভেষজ উপকারিতা

সরিষা দানা বা সর্ষে আমাদের পরিচিত একটি তেল উৎপাদনকারী ফসলি উদ্ভিদ। আমাদের রান্নায় প্রধানত সর্ষের তেলই ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে মাছ রান্নায়, আলু ভর্তা, বেগুন পোড়া মাখায়, আমের আচারে সর্ষের তেল সুস্বাদ আনে। আয়ুর্বেদের মতে, সর্ষের তেল খিদে বাড়ায়, রস তথা পাকে তীক্ষ্ণ, হালকা, মল নিঃসরণ করে, স্পর্শে উষ্ণ, উষ্ণবীর্য (গরম ও কড়া), তীক্ষ্ণ, পিত্ত ও রক্ত খারাপ করে, কফ, মেদ, বায়ু, অর্শ, মাখার ব্যথা (শিরঃশূল), কানের অসুখ, চুলকানি, কুষ্ঠ কৃমি, শ্বেতী এবং দুই ব্রণ নাশ করে। ভাবপ্রকাশ মতে এই তেল আগ্নেয়, কটু, লঘু, উষ্ণবীর্য ও তীক্ষ্ণ। এই তেলের আছে, বিষ দোষ এবং কোষ্ঠবতা নাশের ক্ষমতা[২] 

সরিষা দানা ও তেলের রোগ প্রতিকারে অনেক রকমের ব্যবহার রয়েছে যা নিম্নে আলোচনা করা হলো। সরিষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন

সরিষা একটি তেল জাতীয় শস্য

এই ভেষজটির রক্তবহ ও মজ্জাবহ স্রোতের উপর প্রভাব বেশি।

১. কুষ্ঠ: এই নামটি শুনলেই তো মুখে মাছি ঢুকে যায়, কিন্তু শব্দটির বিন্যাস দেখলে সেরকম ধরনের কোনো প্রশ্ন মনেই আসবে না। ‘কুৎসিৎ তিষ্ঠতি ইতি কুষ্ঠ’ অর্থাৎ যে দেখতে অসুন্দর সে দেহে বাসা বাঁধলেই তাকে কুষ্ঠ বলা যায়। আমাদের অতি সাধারণ গা সওয়া জিনিস ঘামাচি, সেও তো কুষ্ঠ আর দাদ বা দদ্রু। সেটাও তো কুষ্ঠ, তাই বৈদ্যকের চিন্তায় এই নামটি তাঁকে উৎকন্ঠিত করে না। এমনি সাধারণ রোগকে নিয়ে আমরা সচরাচর চিন্তা করি, সেসব ক্ষেত্রের এমন কি শ্বেতিও প্রথম দর্শনে যদি খাঁটি সরষের তেল লাগানো যায়, তাতে প্রাথমিক ভাবে উপশম হবে। তবে এর আভ্যন্তরিক দোষ নিরসনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি আছে চরকের চিকিৎসা স্থানের সপ্তম অধ্যায়ে।[১]

২. উরুস্তম্ভ: বৈদ্যকের মতে এটি রসবহ স্রোত থেকে আরম্ভ করে মেদবহ স্রোত পর্যন্ত দূষিত হয়, এখানে বায়ু অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এই রোগ দুই পায়েই হয়ে থাকে। এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ঝিমুনি থাকেই, তার সঙ্গে অল্প জ্বর। অনেক সময় ভ্রম হয়, এটা বোধ হয় বাত; এখানে কোনো স্নেহজাতীয় পদার্থ দিয়ে (oily substance) যত দলাই মলাই করা যায়, ততই যন্ত্রণা বেড়ে যায়। যখন দেখা যাবে যে উরুতে জ্বালা আরম্ভ হয়েছে, তখনই বুঝতে হবে এটি অসাধ্যের পর্যায়ে এসে পরেছে।[১]

এই সার্থক অর্থবহ নামকরণ এই জন্য যে, পা দুটি যেন স্তম্ভের বা থামের মতো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সুশ্রুতের উপদেশ সাদা সরষে ও ডহর করঞ্জার, যার সংস্কৃত নাম নক্তমাল (Pongamia Pinnata), বীজ সমান পরিমাণে নিয়ে, গোমূত্রে বেটে একটু গরম করে ওখানে লাগাতে হবে। এর দ্বারা প্রাথমিক স্তরে নিশ্চয়ই উপশম হবে। এটা আছে চরকের চিকিৎসা স্থানের বাতব্যাধিতে ।

আরো পড়ুন:  কুলেখাড়া শাকের বারোটি ভেষজ চিকিৎসা সংক্রান্ত গুণাগুণ ও উপকারিতা

৩. শ্লীপদে বা ফাইলেরিয়া: এই রোগের ক্ষেত্রে শুধু সরষের তেল ৩ থেকে ৫ গ্রাম মাত্রায় প্রতিদিন বিকালে একবার করে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা আস্তে আস্তে চলে যাবে। এটিও আছে সুশ্রুতের শ্লীপদ চিকিৎসায়।

৪. উন্মাদে ও অপষ্মার: সাদা সরষে গোমূত্র দিয়ে বেটে শুকিয়ে রাখতে হবে। তা থেকে ৩ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে সকালে ও বিকালে দুবার জলসহ খেতে দিতে হবে। এর দ্বারা ঐ রোগের উপশম হবে। এটি আছে হরীত সংহিতায়।

৫. ঝি ঝি বাতে ও স্নায়ু সঙ্কোচ: এটার লক্ষণ হলো হঠাৎ কোনো অঙ্গে এমন টান ধরলো যে জীবন কণ্ঠাগত। হঠাৎ কোনো জায়গায় ঝি ঝি লাগে, সেক্ষেত্রে ৩ গ্রাম সাদা সরষে বেটে ছেঁকে নিয়ে সরবতের মতো দু’বেলাই খেতে হবে। এর মধ্যে একটু লবণ দেওয়া চলতে পারে, তাই বলে দুধ বা দই দিয়ে সরবত করে নয় পানি দিয়ে সরবত করতে হবে।

৬. পেটে বায়ু ও অগ্নিমান্দ্যে: এদের বাহিরের লক্ষণ হলো পায়খানা করেও মন স্তুষ্টি হয় না, আর পরিষ্কার হয় না। এদিকে যারা অল্প খাওয়া দাওয়া করেন, তাদের স্নেহ জিনিসের অভাব শরীরে, বিশেষত খাদ্যে, পেটে বায়ু, কিছু না কিছু থাকবেই, তাই এদের উচিত ভালো মাখন অল্প অল্প খাওয়া আর এটা খাওয়ার সঙ্গতি যদি না থাকে অথবা খাঁটি না পাওয়া যায়, তাহলে এক গ্রাম করে সাদা সরিষে বেটে, ছেঁকে, সরবতের মতো খাওয়া সরবত করার জন্য জল ১ কাপ হলেই হবে।

৭. হজমে: অল্প পরিমাণ সর্ষের গুড়া খেলে হজমশক্তি বাড়ে এবং কোষ্ঠশুদ্ধি হয়।

৮. দাঁতের মাড়ির ক্ষত: সরষে তিন ভাগ ও সৈন্ধব লবণ এক ভাগ একসঙ্গে পিষে গুঁড়ো করে রাখতে হবে। সেইটা দিয়ে দাঁত মাজলে ঐ মাড়ির ক্ষতের উপশম হয়ে থাকে, অবশ্য এটিও হারীত সংহিতায় বলা হয়েছে।

এছাড়াও জানা যায়, প্রতিদিন স্নানের সময় সর্ষের তেল কিছুক্ষণ মুখে রেখে সেই তেল দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত শক্ত হয়। সর্ষের তেল ও মিহি নুন দিয়ে দাঁত মাজলে মুখের ক্লেদ বেরিয়ে যায়, দুগন্ধি দূর হয় এবং মুখের ভেতরটা পরিষ্কার হয়। সপ্তাহে একদিন অন্তত নুন ও সর্ষের তেল দিয়ে দাঁত মাজা উচিত।

আরো পড়ুন:  কলমি সহজলভ্য যথেষ্ট খাদ্যমান ও ঔষধি গুণসম্পন্ন উপকারি শাক

৯. কর্ণমূল শোথে: এটিকে চলতি কথায় মামস (mumps) বলে। এই ক্ষেত্রে সজনে গাছের মূলের (Moringa oleifera) ছাল ও সরষে সমান পরিমাণ নিয়ে, বেটে, অল্প গরম করে কর্ণমূলে লাগাতে হবে। এটা আছে ভাবপ্রকাশে (ষোড়শ শতকের গ্রন্থ)।

১০. বাতরক্ত প্রথমাবস্থায়: এই লক্ষণ দেখা দিলে সাদা সরষে বেঁটে ঐ জায়গায় লাগাতে হবে।

১১. চর্মদল কুষ্ঠ: এই কুষ্ঠর প্রাথমিক লক্ষণ হবে কোনো জায়গায় ফেটে যাওয়া অথবা ফোস্কা পড়ে পরে শুকিয়ে চামড়াটা উঠে যাওয়া। এক্ষেত্রে সরষে ও সৈন্ধব লবণ সমান পরিমাণে নিয়ে, বেটে ওখানে লাগাতে হবে। এটা একদিন অন্তর কয়েকদিন লাগাতে হয়। তবে এর সঙ্গে আভ্যন্তরিক ঔষধ ব্যবহার না করলে পুনরায় এটা হতে পারে।

১২. আমবাত বা রাসবাতের ব্যথায়: এই বাত রোগকে পাশ্চাত্য চিকিৎসকগণ বলেন রিউম্যাটিজিম। এই ব্যথার জায়গায় সরষে অল্প ভেজে নিয়ে সেটাকে বেটে ওখানে প্রলেপ দিতে হবে। এটাতে ব্যথার খানিকটা উপশম হবে। বাতের ব্যথার বা কোনো জায়গায় রস জমলে সর্ষের পুলটিশ উপকারী। যাদের বাত আছে তাঁরা যদি সর্ষের তেল মালিশ করেন উপকার পাবেন।

১৩. অকালে রজঃরোধে: এদের বিশেষ উপসর্গ হয় মাথার যন্ত্রণা। এক্ষেত্রে সরষে ১০ গ্রাম বেটে গামছায় ছেঁকে নিয়ে, সেইটা বাথটবে ২ বালতি জলে গুলিয়ে সেটাতে অল্প গরম জল মিশিয়ে ঐ জলে কোমর ডুবিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০ মিনিট করে বসে থাকতে হবে। এই পদ্ধতিতে কয়েকদিন হিপ বাথ (Hip-bath) নিলে পুনরায় মাসিক ঋতু আরম্ভ হবে।

১৪. বসা সর্দি: কপালে সর্দি বসে গেলে (Synovitis) সরষের গুড়োর নাস্যি নিলে সর্দিটাও তরল হবে, তার সঙ্গে হাঁচি হয়ে ওটা বেরিয়ে যাবে। এছাড়া সর্ষের তেল পায়ের তলায় মালিশ করলে এবং নাকের মধ্যে দিলে সর্দি ও সর্দির জন্যে মাথার ভার দূর হয়। বাচ্চাদের বুকে খাঁটি মাসকলাই সহ তেল ফুটিয়ে সেই তেল মালিশ করলে সর্দি তাড়াতাড়ি সারে।

১৫. শ্লেষ্মা বের করতে: এই তেলের পিদিম জ্বালিয়ে সলতে এবং পিদিম নিচু করে রাখলে ফোটা ফোটা করে যে গরম তেল পড়ে সেই তেল গরম গরম ছোট ছেলেমেয়েদের বুকে মালিশ করলে শ্লেষ্মা বেরিয়ে যায়।

আরো পড়ুন:  সুষনি ঔষধি গুণ সম্পন্ন শাক

১৬. আফিংয়ের মাত্রাধিক্যে: যেকোনো কারণে মাত্রাধিক্য হয়ে থাকুক না কেনো, সেটাতে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে ৫ থেকে ৬ গ্রাম সাদা সরষে বেটে সরবতের মতো খেতে হবে। তখনই বমি হয়ে ওটা বেরিয়ে যাবে।

১৭. গলার ঘায়ে: গলার ভেতরে ঘা হলে গলার বাইরে এই তেল লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

১৮. পচন রোধে: সর্ষের তেল সংক্রামক দোষ নষ্ট করে এবং পচন রোধ করে। সেইজন্যে আমের আচার এবং অন্যান্য আচার সর্ষের তেলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। 

১৯. শ্বাস রোগে: সর্ষের তেলে গুড় মিশিয়ে খেলে শ্বাস রোগে সুফল পাওয়া যায়।

২০. কানের সমস্যা: কানে এই তেলের ফোঁটা দিলে কানের ব্যাথা, কানে তালা লাগা বা কর্ণনাদ, এমনকী বধিরতাও সারে।

এইভাবে আমাদের ঘরোয়া সর্ষের তেল অনেক উপকার দেয়, ‘খাওয়া-দাওয়া’র কাজে তো লাগেই। তবে বেশি সর্ষের তেল এবং ভাজাভুজি খেলেই অম্বলের ব্যাধি, অজীর্ণতা, পেটফাঁপা ইত্যাদি রোগ দেখা দেবে। সেইজন্যে জিভে ভাল লাগলেও যতদূর সম্ভব কম তেলেই রান্নার কাজটা সারা উচিত। গরগরে করে সর্ষের তেল সর্ষে বাটা ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভাপা ইলিশ, কাটা পোনার বা পার্শে বাটার ঝাল মাসে এক আধদিন মাত্র তার বেশি নয়।[২]

রাসায়নিক গঠন

Essential oil, allyl isothiocyanate and related compounds viz., crotonyl isothiocyanate.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা ১১১-১১২।

২. সাধনা মুখোপাধ্যায়: সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নতুন সংস্করণ ২০০৯-২০১০, পৃষ্ঠা, ৫১-৫২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!