দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতির প্রধান প্রধান শক্তি হচ্ছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে (ইংরেজি: Aftermath of World War II) বিশ্ব রাজনীতির প্রধান প্রধান শক্তি হচ্ছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই মহাযুদ্ধের পরে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল, সমস্ত ইউরোপীয় উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন এবং একই সাথে দুটি পরাশক্তির উত্থান ঘটেছিল। পরাশক্তি দুটি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের পরে বিশ্ব মঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েছিল এবং স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এটিকে শীতল যুদ্ধ বলা হয়, কারণ এর ফলে কখনই দুটি শক্তির মধ্যে উত্তপ্ত যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়নি, বরং এর পরিবর্তে গুপ্তচরবৃত্তি, রাজনৈতিক উৎখাতকরণ এবং প্রক্সি যুদ্ধ হিসেবে বৈশিষ্ট্য ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মানবজাতিকে সাম্যবাদের মুক্তির ধারায় চালিত করেছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবজাতিকে পরাধীনতা ও দাসত্বের ধারায় নিয়ে চলেছে।

দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব রাজনীতিতে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা যায় দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপই ছিলো বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রভূমি। ইউরোপের বাইরে তখন একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিছুটা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে দেখা যেত। দুই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী ও ইতালির দ্বারাই মুলতঃ বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী মহাযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতিতে এক অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। পুঁজিবাদী শিক্ষার আলোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের নানামুখী প্রবণতা স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াই নামে পরিচিতি পায়।

১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হলে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্র অভিমুখী সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এই ভয়াবহ প্রতিযোগিতা পৃথিবীর রাজনীতিতে যে শক্তিসাম্য (balance of power) স্থাপন করে তা সত্যবিরোধী পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ত্রাসের সাম্য (balance of terror) নামেও পরিচিত হয়। নতুন নতুন মারাত্মক পারমাণবিক অস্ত্র আবিষ্কারের ফলে মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ এবং মানব জাতির অস্তিত্ব এই দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মতিগতি এবং সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। দুই পক্ষের এই ভয়াবহ প্রতিযোগিতার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বা bipolar রপ লাভ করে এবং এই দ্বিমেরুকেন্দ্রিক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে পথিবীর বিভিন্ন অংশে নানা ধরনের সামরিক জোট (Military alliance) এবং আঞ্চলিক সংগঠন (Regional organization) গড়ে উঠে। যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল শক্তির সাথে এই ধরনের সংস্থা ও সংগঠন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে।

আরো পড়ুন:  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ প্রযুক্তি শিল্পবাদ এবং অস্ত্রের জন্য ব্যাপক-উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োগ

জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের বৃদ্ধি

এই স্নায়ু যুদ্ধ ছাড়া আরো যে একটি শক্তি দ্বারা যুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতি বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয় তা হলো এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদের অবসান এবং সেই সব দেশের জাতীয় স্বাধীনতা বা পতাকা স্বাধীনতা লাভ। ল্যাতিন আমেরিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রসহ এই সব দেশ সাম্রাজ্যবাদী প্রচারমধ্যম দ্বারা তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত হয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তারা বিশিষ্ট অভিনেতার ভূমিকা পালন করতে আরম্ভ করে। স্নায়ু যুদ্ধের কোনো পক্ষে যোগ না দিয়ে নিপীড়িত অধিকাংশ দেশ জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদ ও বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে এবং বিশ্বশান্তি ও জাতীয় স্বাধীনতার পক্ষে একটি বিরাট সুবিধাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই আন্দোলন দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়।

এশিয়াতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের আবির্ভাব যুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনীতির একটি বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা এবং চীনের বৈদেশিক নীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গঠনে এবং পরিবর্তনে একটি অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৪৯ সালে চীনে সাম্যবাদীগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং তার পরেই গণচীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে ঠাণ্ডা লড়াইতে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। কিন্তু স্তালিনের মত্যুর পর সোভিয়েত সংশোধনবাদী নেতৃত্ব যে নীতি গ্রহণ করে চীন তা মেনে নিতে পারে না, এবং ফলে চীন-সোভিয়েত বিরোধ উপস্থিত হয়। এই চীন-সোভিয়েত বিরোধ দ্বারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং স্নায়ুযুদ্ধের প্রকৃতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। অতএব যুদ্ধোত্তর, বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক চীনের বৈদেশিক নীতিকে একটি অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

অতএব দুইটি মহাশক্তির (super power) আবির্ভাব, তাদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই, পারমাণবিক অস্ত্রের মারাত্মক প্রতিযোগিতা ও তার ভিত্তিতে শক্তিসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা, দুই মহাশক্তির নেতৃত্বে গঠিত বিভিন্ন সামরিক জোট ও আঞ্চলিক সংগঠন, এশিয়া ও আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদের পতন ও বিভিন্ন পতাকা স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব, সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নিয়ে গঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, চীনের বৈদেশিক নীতি ও চীন-সোভিয়েত বিরোধ—এই সব শক্তি দ্বারা যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই সব শক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের পরিবর্তন ঘটে এবং ফলে যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কও অপরিবর্তিত অবস্থায় না থেকে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হতে থাকে।

আরো পড়ুন:  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছে ইউরোপে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী বিশ্বযুদ্ধ

তথ্যসূত্র:

১. গৌরীপদ ভট্টাচার্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ ডিসেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!