দর্শন

মাও সেতুঙের শেষ জীবনের উদ্ধৃতি

দর্শন

*** মার্কসবাদ হাজার হাজার সত্যের সমষ্টি, কিন্তু এগুলো সবই কেন্দ্রিভুত হয় একটিমাত্র বাক্যে—“বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত”। হাজার হাজার বছর ধরে, এটা বলে আসা হচ্ছিল যে দাবিয়ে রাখাটা ন্যায়সঙ্গত, শোষণ করাটা ন্যায়সঙ্গত এবং বিদ্রোহ করাটা অন্যায়। এই পুরোনো সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র মার্কসবাদের উদ্ভবের পরই উল্টে গেল। এটা একটা মহান অবদান। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সর্বহারা শ্রেণি এই সত্য শিখেছে এবং মার্কস এই উপসংহার টেনেছেন। এবং এই সত্য থেকেই তারপর আসে প্রতিরোধ, সংগ্রাম, সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই। স্তালিনের ষাটতম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ইয়েনানে সর্বস্তরের জনগণের সমাবেশে একটি ভাষণ থেকে।

*** আমাদের এই জগতে কীভাবে কোনো হৈ-হট্টগোল ও বিতর্ক না থাকতে পারে? মার্কসবাদ যেহেতু দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকে নিয়েই কাজ করে, সেজন্য এটা হচ্ছে হৈ-হট্টগোল ও বিতর্কের মতবাদ। দ্বন্দ্ব সর্বদাই আছে, এবং যেখানেই দ্বন্দ্ব আছে সেখানেই সংগ্রাম আছে। প্রদেশ, মিউনিসিপ্যাল ও স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের পার্টি কমিটিগুলোর সেক্রেটারিদের এক সম্মেলনে আলোচনা (১৯৫৭)।

*** যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম আছে, শুধুমাত্র সেখানেই দর্শন থাকতে পারে। অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন জ্ঞানতত্ত্ব আলোচনা হচ্ছে সময়ের অপচয় … … … নিপীড়করা নিপীড়িতদের নিপীড়ন করে, আর নিপীড়িতদের দরকার হয়ে পড়ে একে সংগ্রাম করা এবং এজন্য একটি পথ খুঁজে পাওয়া, তখনই তারা দর্শনের খোঁজ শুরু করে। যখন মানুষ এটাকে সূচনা-বিন্দু হিসেবে গ্রহণ করলো, মাত্র তখনই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উদ্ভব ঘটলো এবং জনগণ দর্শন আবিষ্কার করলেন। ১৯৬৪; দর্শন সম্পর্কে একটি আলোচনা।

*** “আন্তর্জাতিক” এবং লেনিনের নিবন্ধটা আগাগোড়া একটা মার্কসবাদী অবস্থান ও দৃষ্টিকোণকে প্রকাশ করেছে। এগুলোতে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে দাসদের জেগে উঠতে হবে এবং সত্যের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। কোনো পরম ত্রাণকর্তা কখনোই ছিল না, এবং আমরা ভগবান বা সম্রাট, কারোর উপরই নির্ভর করতে পারি না। আমাদের মুক্তির জন্য আমরা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের উপরই নির্ভর করি। মানুষের এই পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে? আমরা শ্রমজীবী জনগণ। ১৯৭১; লিনপিয়াও প্রশ্নে একটি আলোচনা। 

*** পর্বত ও উপত্যকা থেকে দর্শন প্রচারিত হয়েছে…………. শুধুমাত্র প্রতিকূলতা ও সংগ্রামের মাঝেই দর্শনের উদ্ভব ঘটতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে দর্শনের উদ্ভব ঘটে। ১৯৬৩; হ্যাংচৌ সম্মেলনে ভাষণ। 

*** প্রতিটি জিনিসই হচ্ছে দুই-এ বিভক্ত এক। ব্যক্তিগতভাবে আমিও হচ্ছি দুই-এ বিভক্ত একজন। আমি একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ছিলাম এবং যখন আমি কমবয়েসি ছিলাম তখন আমিও আত্মায় বিশ্বাস করতাম। আমি আমার মায়ের সাথে দুর দুর মন্দিরে যেতাম দেবতাদের উদ্দেশে ধুপ পোড়ানোর জন্য। মার্কস নামে যে একজন ব্যক্তি ছিলেন, অথবা মার্কসের পর যা ঘটেছিল তার কিছুই অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে আমি এমনকি জানতামও না।

মার্কস ছিলেন দুই-এ বিভক্ত একজন। হেগেল ও ফয়েরবাখ থেকে মার্কস দর্শন শিখেছিলেন, তার অর্থনীতি ছিল ইংল্যান্ডের রিকার্ডো ও অন্যান্যদের থেকে, এবং ফ্রান্স থেকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্র তিনি অধ্যয়ন করেন। এগুলো সবই ছিল বুর্জোয়া। এ থেকে এক দুই-এ বিভক্ত হয়ে গেল এবং মার্কসবাদের সৃষ্টি হলও। আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, মার্কস যখন কমবয়েসি ছিলেন তখন কি তিনি কোনো মার্কসের লেখা পড়েছিলেন? ১৯৬৪; একটি আলোচনার সময় মন্তব্য।

*** বাস্তবে লক্ষ লক্ষ বছরের (বিবর্তনের) মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরই মানুষের একটি বড় মস্তিষ্ক ও একজোড়া হাত গড়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে প্রানিরা বিকশিত হতেই থাকবে। আমি এটা বিশ্বাস করি না যে শুধুমাত্র মানুষই দুটো হাতের অধিকারি হতে সমর্থ। ঘোড়া, গরু, ভেড়া কি বিকশিত হতে পারে না? ……… ঘোড়া, গরু, ভেড়া এবং পোকামাকড়—সবই বদলে যাবে। উদ্ভিদ থেকে প্রাণির উদ্ভব ঘটেছে, তাদের উদ্ভব ঘটেছে সমুদ্রশৈবাল থেকে, ….. পানিরও ইতিহাস আছে। প্রথমাবস্থায়, এমনকি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনও ছিল না। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সৃষ্টির পরই মাত্র এ দুটো পদার্থ মিলে পানি সৃষ্টির সম্ভাবনা আসলো। আমাদেরকে অবশ্যই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ইতিহাস অধ্যয়ন করতে হবে, এই বিষয়টিকে অবহেলা করলে চলবে না। কিছু বই আমাদেরকে অবশ্যই পড়তে হবে। আমাদের বর্তমান সংগ্রামের প্রয়োজন থেকে পড়া, আর উদ্দেশ্যহীনভাবে পড়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ১৯৬৪; দর্শনের উপর আলোচনা।

*** দ্বন্দ্ববাদের মূল নিয়ম বিপরীতের একত্বের নিয়ম অনুযায়ী, বিপরীতগুলোর মাঝে একই সাথে সংগ্রাম ও ঐক্য রয়েছে যারা পরস্পর ব্যতিরেকী ও সম্পর্কযুক্ত এবং যারা নির্দিষ্ট শর্তে একটি অন্যটিতে নিজেদেরকে রূপান্তরিত করে… …। যদি জীবন ও মৃত্যু—একটি অন্যটিতে পরিবর্তিত হতে না পারে তাহলে দয়া করে আমাকে বলুন দেখি জীবন্ত জিনিসগুলো কোত্থেকে আসে। আদি অবস্থায় পৃথিবীতে শুধুমাত্র জড় পদার্থই ছিল এবং পরে জড়বস্তু, অর্থাৎ মৃত পদার্থ থেকে পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত জীবন্ত বস্তু সৃষ্টি হয়নি। সকল জীবন্ত বস্তুতেই বিপাক প্রক্রিয়া চলেঃ এটা বাড়ে পুনরুৎপাদন করে এবং ধ্বংস হয়। যখন জীবনের বিকাশ হচ্ছে, তখন জীবন ও মৃত্যু সর্বদাই সংগ্রামে ব্যাপৃত এবং সর্বদাই তারা একে অন্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। ১৯৫৭; প্রদেশ, মিউনিসিপ্যাল ও স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের পার্টি কমিটিগুলোর সেক্রেটারিদের এক সম্মেলনে আলোচনা।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক কাজ

*** চিনা জনগণ বিয়েকে রক্তিম আনন্দের ঘটনা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে শুভ্র সুখের ঘটনা হিসেবে গণ্য করে। আমি একে খুব যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি। চিনারা দ্বান্দ্বিকতা জানেন। বিয়ে হলে সন্তান হয়। একটা সন্তান মায়ের শরীর থেকে বিযুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়। এটা একটা আকস্মিক পরিবর্তন, একটা আনন্দের ঘটনা। একটা এক্ক ব্যক্তি দুটা বা তিনটা এমনকি দশটাতে বিভক্ত হয়ে যায়, বিমানবাহি জাহাজের মতো।

সাধারণ লোক নতুন পদার্থের আবির্ভাব, পরিবর্তন ও বিলুপ্তিকে আনন্দের ঘটনা হিসেবে দেখেন। যখন একজন লোক মারা যায়, তখন স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। যখন শোকসন্তপ্তরা শোকে কাঁদে, তারা অনুভব করে যে এটা একটা সুখের ঘটনা। বাস্তবেও এটা তাই। শুধু কল্পনা করুন, কনফুসিয়াস এখনো বেঁচে আছেন এবং হুয়াই জেন হল-এ এই মিটিং-এ উপস্থিত আছেন! তাহলে তার বয়স হতো দুহাজারের বেশি এবং এটা খুব ভাল হতো না। কেউ যদি দ্বান্দ্বিকতাকে সমর্থন করেন ও মৃত্যুকে অস্বীকার করেন তাহলে তা হবে অধিবিদ্যা। বিপর্যয় হচ্ছে সামাজিক ঘটনা, প্রাকৃতিক ঘটনা। আকস্মিক পরিবর্তনগুলোও হচ্ছে বিশ্বের একেবারে মৌলিক নিয়ম। জন্ম হচ্ছে আকস্মিক পরিবর্তন; মৃত্যুও তাই। জন্ম থেকে মৃত্যুর মাঝে দশকগুলোতে ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন হয়। যদি চিয়াং কাইশেক মারা যায়, তাহলে আমরা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠবো। যদি ডালেস মারা যায়, তাহলে আমাদের মাঝে কেউই একফোঁটা অশ্রু ফেলবে না। এটা এজন্যই যে, পুরনো সমাজের বস্তুগুলোর মৃত্যু হচ্ছে ভাল ব্যাপার, প্রত্যেকেই যা আশা করে। নতুন জিনিসের জন্ম যেহেতু ভাল, তাই তাদের মৃত্যু স্বভাবতই ভাল নয়। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতা এবং আমাদের দক্ষিণের ঘাঁটি হাতছাড়া হওয়াটা হচ্ছে শিলাবৃষ্টি ও ঢলে চারাগাছের ধ্বংসের মতো ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই এটা ভাল নয়। এবং ক্ষতিগ্রস্ত চারাগুলোকে প্রতিস্থাপন করার সমস্যাটাও তখন আসে। আমরা কমিউনিস্টরা পরিবর্তনের আশা করি। কথিত লম্ফ দিয়ে অগ্রগতির অর্থ হচ্ছে অতীত থেকে পরিবর্তন … … আকস্মিক পরিবর্তন পরিমাণগত পরিবর্তনের চেয়ে ভাল। কিন্তু পরিমাণগত পরিবর্তন ছাড়া আকস্মিক পরিবর্তন হতে পারে না। পরিমাণগত পরিবর্তন অপরিহার্য এবং একে অস্বীকার করলে হঠকারিতা হবে। ভারসাম্যের ধ্বংসসাধন করতে হলে লম্ফ দিয়ে অগ্রগতি প্রয়োজন, এবং এই ধ্বংসসাধন ভারসাম্যের চেয়ে ভাল। ভারসাম্যহীনতা ও মাথাব্যথা ভাল জিনিস … … ভারসাম্যতা, পরিমাণগত পরিবর্তন, এবং ঐক্য হচ্ছে সাময়িক ও আপেক্ষিক; ভারসাম্যহীনতা, আকস্মিক পরিবর্তন ও অনৈক্য হচ্ছে অনপেক্ষ ও স্থায়ী। বহু অনৈক্যকে কাটানো গেছে এবং ঐক্যে পরিবর্তিত করা গেছে। অনৈক্যের কারণেই ঐক্য সাধনের কথা আসে। ১৯৫৮; ৮ম পার্টি কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৃতীয় ভাষণ। 

*** এটা বলা হতো যে দ্বান্দ্বিকতার তিনটি প্রধান নিয়ম আছে, তারপর স্তালিন বললেন চারটি। আমার মতে একটিমাত্র মূল নিয়ম আছে এবং তা হচ্ছে দ্বন্দ্বের নিয়ম। গুণ ও পরিমাণ, ইতিবাচক ও নেতিবাচক, বাহ্যিক চেহারা ও সারমর্ম, সারবস্তু ও রূপ, প্রয়োজনীয়তা ও স্বাধীনতা, সম্ভাবনা ও বাস্তবতা প্রভৃতি…… সবই হচ্ছে বিপরীতের একত্বের দৃষ্টান্ত। “১৯৬৫; হ্যাংচৌ-এ ভাষণ।” (১৯৬৫)

*** অগ্রসর বলতে আমরা কী বুঝি? অগ্রসর হওয়ার অর্থ হচ্ছে পশ্চাৎপদদের কাজগুলো করা, আমাদের চারপাশে যা আছে তার বিশ্লেষণ করা, তদন্ত কাজে দৃঢ় সংকল্প হওয়া এবং আমরা যেখানেই যাই না কেন সেখানেই বন্ধু সৃষ্টি করা। আমাদের যুব সম্প্রদায়কে অবশ্যই দ্বন্দ্ববাদকে অধ্যয়ন করতে হবে এবং সমস্যার বিশ্লেষণে দ্বান্দ্বিকতার ব্যবহারকে আয়ত্ব করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ আমার কথাই ধর। আমি অন্যদের থেকে মোটেই বেশি বুদ্ধিমান নই, কিন্তু আমি দ্বন্দ্ববাদ বুঝি এবং আমি জানি সমস্যার বিশ্লেষণে কীভাবে একে ব্যবহার করতে হয়। যদি আমরা একটা অস্বচ্ছ সমস্যার বিশ্লেষণে দ্বন্দ্ববাদ ব্যবহার করি সমস্যাটা মুহূর্তের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায়। তোমাদেরকে অবশ্যই অধ্যবসায়ের সাথে দ্বান্দ্বিকতা অধ্যয়ন করতে হবে; এর কার্যকরীতা খুবই বেশি। ১৯৬৬; মাও উয়ান লিন-এর সাথে আলোচনা।

*** একটা বস্তু অন্যটাকে গ্রাস করে, বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে_ এটা হচ্ছে সংশ্লেষণ। বইয়ে এভাবে কখনই বলা হয়নি। আমি পূর্বে আমার বইগুলোতে একে এভাবে তুলে ধরিনি। ইয়াং শিয়েন চেন তার পক্ষ থেকে বিশ্বাস করতেন যে, দুই মিলে এক হয় এবং এই সংশ্লেষণই দুই বিপরীতের মাঝে অচ্ছেদ্য বন্ধন। এ-পৃথিবীতে কোন অচ্ছেদ্য বন্ধন রয়েছে? বস্তুকে একত্রে বেধে রাখা যেতে পারে, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত তারা অবশ্যই পৃথক হয়ে যাবে। পৃথক করা যায় না এমন কিছুই থাকতে পারে না। ১৯৬৪; দর্শনের উপর আলোচনা।

আরো পড়ুন:  সাম্রাজ্যবাদ ও সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা কাগুজে বাঘ

*** লেনিন বলেছিলেন সমস্ত বস্তুকেই বিভক্ত করা যেতে পারে। তিনি উদাহরণস্বরূপ পরমাণুর দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, শুধুমাত্র পরমাণুই নয়, ইলেকট্রনকেও বিভক্ত করা যেতে পারে। যাহোক, পূর্বে এটা মনে করা হতো যে, একে বিভক্ত করা যাবে না; পারমাণবিক নিউক্লিয়াসকে ভাঙার কাজে নিয়োজিত বিজ্ঞানের শাখা এখনও খুবই নতুন, মাত্র বিশ বা ত্রিশ বছরের। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বৈজ্ঞানিকরা পারমাণবিক নিউক্লিয়াসকে তার উপাদানসমূহ, যেমন_ প্রোটন, এ্যান্টি প্রোটন, নিউট্রন, এ্যান্টি নিউট্রন, মিসন ও এ্যান্টি মিসন-এ ভেঙেছেন … এখনো ইলেকট্রন ভাঙা যায়নি, কিন্তু একদিন না একদিন বৈজ্ঞানিকরা অবশ্যই একে ভাঙতে সমর্থ হবেন। চুয়াং জু বলেছিলেনঃ “এক ফুট দৈর্ঘ্য, যাকে প্রতিদিন অর্ধেক করা হয়, কোনো দিনই শূন্যে পরিণত হবে না” (চুয়াং জু, চ্যাপ্টার, ৩৩জি, ‘বিভিন্ন মতবাদের স্কুল, কুংসুন লুং-এর উদ্ধৃতি) এটাই হচ্ছে সত্য। আপনি যদি এটা বিশ্বাস না করেন, তাহলে বিবেচনা করতে পারেন। যদি একে শূন্যে নামিয়ে আনা যেত, তাহলে বিজ্ঞান বলে কিছু থাকত না। হাজার হাজার জিনিস অবিরতভাবে ও সীমাহীনভাবে বিকশিত হয় এবং তারা অসীম। সময় ও স্থান হচ্ছে অসীম। স্থানের ক্ষেত্রে, দুরবীক্ষণিকভাবে অ অণুবীক্ষণিকভাবে_ উভয়ভাবে দেখলেই দেখা যাবে, এটা অসীম, একে অন্তহীনভাবে বিভক্ত করা যাবে। তাই, লক্ষ বছর পরেও বৈজ্ঞানিকদের করার মতো কাজ থাকবে … … …। ১৯৬৪; দর্শনের উপর আলোচনা।

*** দ্বান্দ্বিকতার মূল বিষয় হচ্ছে বিপরীতের দিকে অবিরাম গতি। মানব জাতিও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হবে। ঈশ্বরবাদিরা যখন মহাপ্রলয়ের দিনের কথা বলে, তারা হয় হতাশাপূর্ণ এবং তারা জনগণকে ভীত করে।  আমরা বলি যে মানবজাতির বিলুপ্তি হচ্ছে এমন কিছু যা মানব জাতি থেকে আরো অগ্রসর কিছুকে সৃষ্টি করবে। মানব জাতি এখনো তার শৈশবাবস্থায় রয়েছে। এঙ্গেলস প্রয়োজনের রাজ্য থেকে স্বাধীনতার রাজ্যে অবিরাম গতির কথা বলেছেন এবং বলেছেন যে প্রয়োজনের উপলব্ধিই হচ্ছে স্বাধীনতা। এই বাক্যটি সম্পূর্ণ নয়, এতে মাত্র অর্ধেক বলা হয়েছে এবং বাকিটা বলা হয়নি। মাত্র উপলব্ধিই কি আপনাকে মুক্ত করে ফেলে? স্বাধীনতা হচ্ছে প্রয়োজনের উপলব্ধি এবং প্রয়োজনের রূপান্তর। একজন ব্যক্তিকে কিছু কাজও করতে হবে। ১৯৬৪; দর্শনের উপর আলোচনা।

*** বস্তুকে চেতনায় রূপান্তরিত করা যায়, এবং চেতনাকে বস্তুতে……। সঠিক ধারণা কোথা থেকে আসে; ১৯৬৩

*** আমাদের সর্বদাই নতুন জিনিসকে সামনে আনতে হবে। এছাড়া আমরা এখানে কেন আছি? আমরা বংশধরদের জন্য কি চাই? বাস্তবতাতেই নতুন জিনিস পাওয়া যায়, আমাদের অবশ্যই বাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ১৯৬৪; দর্শনের উপর আলোচনা।

*** আমাদের আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সৃষ্টি ও অগ্রগতির জন্য চেষ্টা করতে হবে। এক জায়গায় স্থির থাকা, হতাশা, অহংকার ও আত্মতৃপ্তির মনোভাব হচ্ছে সবই ভুল। ১৯৭৪; ওয়াং হুং ওয়েন কর্তৃক কেন্দ্রিয় শিক্ষা ক্লাসে আলোচনায় উদ্ধৃত।

*** জলোচ্ছাসে ভীত হওয়ার কোনো যুক্তি নাই। মানব সমাজ ‘জলোচ্ছ্বাস’ হতে সৃষ্ট। পিপলস ডেইলির সম্পাদকীয়, ২৬ জুলাই, ১৯৬৬।

*** সত্য, মিথ্যার বিপরীতে দাঁড়ায় এবং তার সাথে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয় … … জনগণকে মিথ্যা, কুৎসিত ও বৈরি বস্তু, ভাববাদ ও অধিবিদ্যা এবং কনফুসিয়াস, লাওজু ও চিয়াংকাইশেক-এর বাজে বকুনির সংস্পর্শে আসতে বাধা দেয়াটা হচ্ছে একটা বিপদজনক কর্মনীতি। এটা মানসিক অবনতি, একপেশে মানসিকতা এবং পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়া ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অপ্রস্তুতির দিকে নিয়ে যায়। ১৯৫৭; প্রদেশ, মিউনিসিপ্যাল ও স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের পার্টি কমিটিগুলোর সেক্রেটারিদের এক সম্মেলনে আলোচনা।   

“পুরাদস্তুর বস্তুবাদিরা হচ্ছেন নির্ভীক।”—মাও সেতুং

*** ধ্বংস ছাড়া গঠন হয় না। ধ্বংস অর্থ হচ্ছে সমালোচনা ও বর্জন, এর অর্থ বিপ্লব। এতেই রয়েছে যুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বের করে আনা, যা হচ্ছে গঠন। ধ্বংসকে প্রথম স্থান দাও, এবং এই প্রক্রিয়াতেই তুমি গঠন করতে পারবে। ১৯৬৬; ১৬ মে সার্কুলার।

*** সত্য, সকল সত্যই সবসময়ই শুরুতে সংখ্যালঘুর হাতে থাকে। তাদের উপর সর্বদাই সংখ্যাগুরু কর্তৃক আরোপিত চাপ থাকবে। চারশ’ বছর আগে, একজন মহান পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস আবিষ্কার করেন যে পৃথিবী ঘোরে। চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্ররাজি পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে_ এই তত্ত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানে রাজত্ব করে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। কোপার্নিকাসের জীবনকালে তার সবচেয়ে মহান অবদান ছিল এই তত্ত্বকে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে_ এই বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব দ্বারা অপসারিত করা। সে সময়কার ধর্মীয় গোষ্ঠীরা তাকে আক্রমণ করার জন্য, তাকে বিরোধিতার জন্য এবং তাকে ধর্মবিরোধিতার দায়ে অভিযুক্ত করার জন্য একত্রিত হয়। সমস্ত দিক থেকে তিনি অত্যাচারিত হন। তিনি মৃত্যুশয্যায় যাওয়ার [১৫৪৩] পূর্ব পর্যন্ত তার “ডি রিভলিশানিবাস” প্রকাশিত হয়নি। এতে তিনি উৎফুল্ল হন। সে সময়কালেই ইতালিতে প্রতিভাবান পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) কোপার্নিকাসের “সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব”-কে সমর্থন করেন। ১৬০৯ সালের প্রথম দিকে একটি ঘরে তৈরি দূরবীনের সাহায্যে নক্ষত্র ঘোরে কিনা এটা দেখার জন্য তিনি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু সে সময়কার ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো দ্বারা তিনি চরমভাবে নির্যাতিত হন, এবং প্রতিক্রিয়াশীল রোমান আদালত দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত হন। অন্য এক ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারা হয়। একজনকে পুড়িয়ে ফেলাটা কিছু নয়। সত্য তার হাতে ন্যস্ত নয়। কাউকে পুড়িয়ে ফেললেও পৃথিবী কিন্তু ঘুরতেই থাকে। ১৯৬৪; একটি আলোচনায় মন্তব্য। 

আরো পড়ুন:  সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম

*** স্মরণাতীত কাল থেকে কোনো প্রগতিই প্রথমে সহজে গৃহীত হয়নি এবং প্রতিটি প্রগতিশীলতাকেই ব্যতিক্রমহীনভাবে দুর্ব্যবহারের লক্ষ্য হতে হয়েছে। মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রথম থেকেই গালাগাল শুনতে হয়েছে। এখন থেকে ১০,০০০ বছর পরেও, প্রগতিশীল বিষয়গুলোকে তার সূত্রপাতে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। প্রদেশ, মিউনিসিপ্যাল ও স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের পার্টি কমিটিগুলোর সেক্রেটারিদের এক সম্মেলনে আলোচনা (১৯৫৭)।

*** জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হচ্ছে একটি মার্কসবাদী- লেনিনবাদি নীতি। দশম পার্টি কংগ্রেসের উদ্ধৃতি।

*** সামাজিক সংগ্রামে অগ্রগামি শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারি শক্তিগুলো কখনো কখনো পরাজিত হয়, তাদের পরাজয়ের কারণ এ নয় যে, তাদের চিন্তাধারা ভুল, বরং তার কারণ এই যে, সংগ্রামরত শক্তিগুলোর পারস্পরিক ভারসাম্যে প্রতিক্রিয়াশিল শক্তিগুলো যতটা শক্তিশালি, অগ্রগামি শক্তিগুলো আপাতত ততটা শক্তিশালি নয়; তাই তারা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়, কিন্তু একদিন না একদিন তারা জয়ী হতে বাধ্য। মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?” (মে ১৯৬৩)

*** পৃথিবীতে সকল জিনিসই আঁকাবাঁকা পথে বিকশিত হয়, উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি হাঁটেন, তখন আপনি কখনো সরলরেখায় হাঁটেন না। আপনি কি কখনো মোকান পর্বতে গিয়েছেন? এর উপরে উঠতে আঠারটি জটিল বাঁক রয়েছে। ব্যতিক্রমহীনভাবে সমাজও সামনের দিকে এগোয় সর্পিলভাবে। বুর্জোয়া ডানপন্থীদের আক্রমণকে প্রতিহত করুন, ১৯৫৭

*** প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে নদীতে সাঁতরালে ইচ্ছাশক্তি ও সাহস গড়ে উঠে। সর্বহারা শ্রেণি হচ্ছে বিপ্লবী আশাবাদি-তে উদ্ধৃত, পিকিং, ১৯৭৬

*** এক ধরনের অতি ক্ষুদ্রকায় জীব আছে যাদেরকে জীবাণু বলা হয়। যদিও আকারে ছোট, তবু এক দিক থেকে তারা মানুষের চেয়েও শক্তিশালি। তাদের কোনো কুসংস্কার নেই এবং তারা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। তারা উচ্চতর লক্ষ্যে উপনীত হতে এবং মহত্তর, দ্রুততর, আরো ভালো ও আরো বেশি অর্থনৈতিক ফল পেতে চেষ্টা করে। তারা স্বর্গ বা মর্তের ভয় করে না। তারা কাউকে শ্রদ্ধাও করে না। তারা যদি মানুষকে খেতে চায় তাহলে তুমি কে _ তা পরোয়া না করেই তারা মানুষের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়বে। এমনকি যদি তোমার ওজন ৮০ কিলোগ্রামও হয় তবুও তারা তোমাকে ধ্বংস করতে পারে। তাদের ব্যাপারে যতটুকু হওয়া উচিত কেউই ততটা মনোযোগ দেয় না। তাদের নির্ভীক মনোভাব কি কিছু ব্যক্তির চেয়ে শক্তিশালি অনেক নয়? ৮ম পার্টি কংগ্রেসের ২য় অধিবেশনে ১ম ভাষণ, (১৯৫৮)

*** পুরাদস্তুর বস্তুবাদিরা হচ্ছেন নির্ভীক। প্রচার কার্য সম্পর্কে সিপিসির জাতীয় কংগ্রেসে ভাষণ। (১৯৫৭)

*** ভাববাদ ও অধিবিদ্যা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে সোজা জিনিস, কারণ বস্তুগত বাস্তবতার উপর ভিত্তি না করেই বা তাতে যাচাই-এর ভিত্তি ছাড়াই তারা মানুষকে যা ইচ্ছা তাই আজেবাজে বকতে অনুমোদন দেয়। অপরদিকে বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতা পরিশ্রম দাবি করে। তাকে অবশ্যই বস্তুগত বাস্তবতার ভিত্তিতে ও তাতে যাচাইয়ের ভিত্তিতে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে। কেউ যদি পরিশ্রম না করে, তাহলে সে ভাববাদ ও অধিবিদ্যায় চালিত হতে বাধ্য। জনমতের একরূপত্বকে খণ্ডন। (১৯৫৫)

*** পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়, যদি পাহাড় অতিক্রমের দুঃসাহস থাকে। চিং ফাং শানে পুনর্বার (১৯৬৫)

*** ভবিষ্যত উজ্জ্বল, কিন্তু পথটা আঁকাবাঁকা। চুংকিং আলোচনার উপর (১৯৪৫)

Leave a Comment

error: Content is protected !!