তালীশ-এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Abies abebbiana Lindle. এর দুটো সমনাম বিভিন্ন প্রকাশনায় দেখা যায়। (Synonym; Abies spectabilis (D.Don.) spach এবং A. densa Griff). গোত্র-পাইন্যাসী। হিমালয়ের পশ্চিমাঞ্চলে পাহাড়ি কিন্তু নিচু এলাকায় A. prindrow এবং পূর্বাঞ্চলে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় দেখা মেলে A. Webbiana প্রজাতির।
অন্যান্য নাম:
তালীশ নামটার সঙ্গে কেমন একটা তালু, তালী বা সাধারণ বাংলায় যাকে বলে ‘টাকরা শব্দ এসে যায়। আসলেও তা-ই। উপবর্হনে বলা হয়েছে যে, তালীশ- তালী বা তালুজাত বিকারে একক ওষুধি হিসাবে চমৎকার। নাম যা-ই হোক, হিমালয় অঞ্চলের কোনো ছবি যখন টেলিভিশন বা অন্য কোন রুপালি পর্দায় ভেসে ওঠে, তখন যে লম্বা লম্বা গাছগুলো মাথায় একরাশ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে আলোচ্য তালীশকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
সাধারণভাবে তালীশ নামে পরিচিত হলেও সুদীর্ঘকাল ধরে দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হওয়ায় এর বিভিন্ন নাম এসেছে, যেমন—পত্রখ্য, শুকোদর, ধাত্রীপত্র, অর্কবেধ, করিপত্র, ঘনচ্ছদ, নীল, নীলাম্বর, তাল, তালীপত্র, তলায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষায়ও এর কিছু অদ্ভুত নাম রয়েছে। যেমন- হিন্দিতে বাং, ডোডিষ্মা, রাঘা, তালীশপত্র (পাতা); কাশ্মীর-বদর, কালারি; পাঞ্জাবে- চিলরু, ধুনু; ভুটানে- ধুনসিং, গোদরা, শাল্লা; ফারসি- জার্নব; আরবিতে- তালীসদর; নেপালে- গোব্রিয়া। এবং ইংরেজিতে Indian silver fir.
তালীশ গাছের বিবরণ:
এই তালীশ দেখতে উঁচু, চিরসবুজ বৃক্ষ। এই গাছ প্রায় ৬০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয় এবং ৩ থেকে ১০ মিটার ব্যাস সম্পন্ন হতে পারে। গাছটি শীর্ষের দিকে ছড়ানো পল্লব থাকে। বাকল ধূসরাভ খয়েরি বা রুপালি সাদা। পাতা বিভিন্ন আকারের, শক্ত শাখায় দুই থেকে চার ধাপে ঘনবিন্যস্ত, চর্মবৎ, চকচকে, গাঢ় সবুজ, ১০ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী। পুরুষ ফল ক্যাটকিন, ১.৩-১.৮ সেমি লম্বা, উপবৃত্তাকৃতি; স্ত্রী-ফল যাকে কোণ বলা হয়; এটা প্রায় অবৃন্তক, নলাকৃতি, কচি অবস্থায় লাল-বেগুনী (পার্পল) রঙের, পরিণত বয়সে খয়েরি, চওড়া পাখার মতো শল্ক এবং গুপ্ত বা অল্প বের হওয়া মঞ্জরিপত্র। বীজ আয়ত-বিডিম্বাকৃতি, কৌণিক, খাজ-কাটা পক্ষল। বৈশাখে ফুল হয় এবং আশ্বিনে পাকে।
বিস্তৃতি:
বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারি ১৯৯২-তে ২১টি ওষুধে তালীশ পাতা ব্যবহারের উল্লেখ দেখা গেলেও এটি আমাদের দেশে বলতে গেলে হয় নাই। তালীশ সংশ্লিষ্ট মহল বা ব্যবসায়ী মহলে ‘ফার’ নামে পরিচিত এবং ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার পার্বত্যাঞ্চলে প্রচুর জন্মে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এর ২৪টি প্রজাতি পাওয়া যায়। এদের মধ্যে দুটি প্রজাতি হিমালয় অঞ্চলে জন্মে।
প্রাচীন শাস্ত্রের উল্লেখ:
চরক সংহিতার চিকিৎসাশাস্ত্রে তালীশ-এর উপকারীতার কথা উল্লেখ আছে। মুখ বলতে দুটি ঠোঁট, দাঁত, দাঁতের মাড়ি, জিহবা, তালু এবং গলা- সবগুলো অংশ বোঝায়। ঔষধি ব্যবহারে সজিনা, শিরীষ, তেলাকুচা, অপরাজিতা, শাল প্রভৃতির মতো তালীশপত্রকে এক বিশেষ শক্তিসম্পন্ন ওষুধ বলে ধরা হয়। বাগভটের চিকিৎসাশাস্ত্রে অরুচি রোগে তালীশের উপযোগিতার কথা বলা হয়েছে। চক্রদত্তে একে রক্তপিত্তে সমান কার্যকর অর্থাৎ পিত্তশ্লেষ্মা বিকারে যেমন বাতপিত্তেও তেমনি কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ সংহিতায় কফজনিত অগ্নিমান্দ্য তালীশ কার্যকর বলে উল্লেখ দেখা যায়। তালীশ লঘু, তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, শ্বাস, কাস, কফবাতজ রোগ, অরুচি, গুল্ম, আমদোষ, অগ্নিমান্দ্য ও ক্ষয়রোগনাশক। রাজনিঘণ্টুতেও একই গুণীবিলির বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
ঔষধ হিসাবে তালীশ গাছের ব্যবহার:
ওষুধ হিসাবে মুলত এর পাতাই ব্যবহৃত হয়। তবে তালীশকে এককভাবে কোন কোন লক্ষণে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা জানা গুরত্বপুর্ণ।
১. অগ্নিমান্দ্য: যে অগ্নিমান্দ্যে ক্ষুধাই হয় না সেটা হলো কফপ্রধান অগ্নিমান্দ্য। এক্ষেত্রে তালীশ পাতা আধগ্রাম মাত্রায় ঈষদুষ্ণ পানিসহ দু-তিন দিন খেলে রোগলক্ষণের উপশম হবে।
২. অরুচিতে: মিউকাস মিশ্রিত মল, ঝাল খেতে ইচ্ছে থাকলেই বুঝতে হবে কফসংশ্লিষ্ট অরুচিতে ধরেছে। এক্ষেত্রে তালীশ পাতা আধকাপ পানিতে ভালো করে ফুটিয়ে ঐ পানিটা সকাল-বিকাল দুবার খেলে উপকার হবে।
৩. শ্বাসরোগ সারাতে: বংশগত শ্বাসরোগ সারানো সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে তালীশপাতা চূর্ণ ১ গ্রাম মাত্রায় পানিসহ খেলে ঐ কষ্টটা অনেক লাঘব হবে। কেননা প্রাণবায়ু এবং উদান বায়ু সহজভাবে বইলে শ্বাসকষ্ট লাঘব হয় এবং তালীশপাতা সে ওষুধ যা ঐ বায়ুদ্বয়কে সহজ-সরল ভাবে বইতে সহায়তা করে।
৪. মুখের সমস্যায়: মুখরোগ বলতে গলা, দাঁতের যন্ত্রণা, মাড়ি ফোলা, তালুতে ঘা, দাঁতের মাড়িতে ঘা ইত্যাদি বোঝায়। এ সকল ক্ষেত্রে ১ গ্রাম পরিমাণ তালীশপাতা চূর্ণ মধুর সঙ্গে খেতে হয়। এ সঙ্গে ৩ থেকে ৪ গ্রাম পাতা ভালভাবে পরিষ্কার করে ৩-৪ কাপ পানিতে ভালোভাবে সেদ্ধ করে সে পানি ঈষদুষ্ণ অবস্থায় মুখে নিয়ে ৫-৭ মিনিট ধারণ করে ফেলে দিয়ে আবার মুখে রাখতে হবে। আয়ুর্বেদের ভাষায় এটাকে কবল ধারণ করা বলা হয়। এ প্রক্রিয়া দিনরাতে ২-৩ বার করলে দ্রুত উপশম হবে। আযুর্বেদে স্বীকৃত উপরোক্ত ব্যবহার ছাড়াও স্থানীয় উপজাতি বা অন্যান্য লোকজন স্থানীয়ভাবে তালীশ পাতা বা এর অন্য অংশ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে উপকার পান।
৫. জ্বরে: শিশুদের জ্বর এবং বক্ষব্যাধিতে তাজা পাতার রস খাওয়ানো হয়। শিশুদের দন্তোদমকালীন জ্বরে পাতার রস উপকারী।
৬. স্নায়ুপ্রদাহে: ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রসবের পর প্রসূতিকে টনিক হিসাবে পাতার রস খাওয়ানো হয়। বৃক্ষ থেকে সংগৃহীত রজন গোলাপ তেলের সঙ্গে মিশিয়ে স্নায়ুপ্রদাহে বাহ্যিক ব্যবহার করা হয়।
৭. গর্ভধারণ নিবারণ: ডাক্তার জর্জ ওয়াট ১৯০৮ সালে প্রকাশিত তার ‘কমার্শিয়াল প্রোডাক্টস অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে অবিবাহিত নাগা উপজাতির মেয়েরা সানন্দে গর্ভধারণ নিবারণের জন্য এ গাছের কচি ডাল গায়ে বেঁধে রাখে। এ প্রাচীনতম লোকায়তিক ব্যবহারের যৌক্তিকতা পরীক্ষায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। পরীক্ষাধীন শ্বেত ইঁদুরে পেট্রোলিয়াম ইথার , অ্যালকোহল এবং পানিতে তালীশপাতার নির্যাস তৈরি করে তা প্রয়োগ করে গর্ভধারণ নিবারণ হওয়া লক্ষ্য করা হয়েছে।
৮. অন্যান্য সমস্যায়: কচি ডাল দিয়ে তৈরি সুরাসার বা টিনচার যা মাথার যন্ত্রণা, নাড়ীর দৌর্বল্য, হাত-পায়ের শীতলতায়, অতিসার এবং পিত্তঘটিত রোগে ব্যবহৃত হয়।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. ড. সামসুদ্দিন আহমদ: ওষুধি উদ্ভিদ (পরিচিতি, উপযোগিতা ও ব্যবহার), দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা, ২৪-২৬।
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Sergey Ashmarin
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।