অর্জুন এশিয়ায় জন্মানো মহা উপকারি ঔষধি বৃক্ষ

বৃক্ষ

অর্জুন

বৈজ্ঞানিক নাম: Terminalia arjuna. সমনাম: Pentaptera arjuna Roxb. ex DC. (1828), Terminalia urjan Royle (1835). সাধারণ নাম: arjuna or arjun tree in English, thella maddi in Telugu, kumbuk in Sinhala, marudha maram in Tamil and neer maruthu in Malayalam. বাংলা নাম: অর্জুন
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ/রাজ্য: Plantae বিভাগ: Angiosperms অবিন্যাসিত: Edicots অবিন্যাসিত: Rosids বর্গ: Myrtales পরিবার: Combretaceae গণ: Terminalia প্রজাতি: Terminalia arjuna

ভূমিকা: অর্জুন কমব্রেটাসি পরিবারের টারমিনালিয়া গণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি বৃক্ষ। পরিণত বয়সে গাছ ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এছাড়া এই গাছের উচ্চতা ১৫ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই বিশালাকৃতির পত্রমোচী বৃক্ষের গোড়া কখনও খুঁজযুক্ত হয়। গাছটির মাথার ছড়ানো, ডালগুলি নিচের দিকে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। বাকল পুরু, ধূসর ও মসৃণ হয়।[১] নিচে অর্জুন গাছের বিবরণ দেয়া হলো।

অর্জুন গাছের বিবরণ:

অর্জুন গাছ মধ্যম বা বৃহৎ আকৃতির বৃক্ষ, প্রায় ২৫ মিটার উঁচু, বাকল মসৃণ, সাদাটে বা ফ্যাকাশে লাল। ক্ষুদ্র শাখা অনেকটা আনুভূমিক, তরুণ শাখা রােমশ। পত্র ৬-১২ X ২.৫ -৪.৫ সেমি, প্রতিমুখ বা অর্ধপ্রতিমুখ, দীর্ঘায়ত থেকে বিডিম্বাকার দীর্ঘায়ত, চর্মবৎ, অঙ্কীয়পৃষ্ঠ হালকা বাদামী, শীর্ষ সূক্ষ্মাগ্র বা দীর্ঘাগ্র, মূলীয় অংশ তির্যক, গােলাকার বা সামান্য হৃৎপিন্ডাকার সাধারণত বিন্দু আকৃতির ১ জোড়া গ্রন্থিযুক্ত, প্রান্ত গােলাকার দন্ত যুক্ত, অঙ্কীয় পৃষ্ঠের শিরা উত্থিত, মসৃণ বা স্বল্পরােমশ, বৃন্ত ০.৩-১.৫ সেমি লম্বা, রােমশ বা মসৃণ। অগ্রহায়ন ও ফাল্গুন মাসে পাতা ঝরে এবং বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে নতুন পাতা গজায়।[২]

পুষ্পবিন্যাস স্পাইক, সাধারণত ২.৫-৬.৫ সেমি লম্বা, অক্ষীয় বা প্যানিকেল, মঞ্জরীঅক্ষ রােমশ, মঞ্জরীপত্র ছােট, ২ মিমি লম্বা, পর্ণমােচী, রৈখিক-ভল্লাকার। পুষ্প হলদে সাদা বা ফ্যাকাশে হলুদ, অবৃন্তক, বৃতি ২-৩ x ৩-৪ মিমি, বহির্ভাগ মসৃণ অভ্যন্তর রােমশ, খন্ড ত্রিকোণাকার, সামান্য বক্র, ১.০-১.৫ মিমি লম্বা। পুংকেশর ৩-৫-৫.০ মিমি লম্বা, গর্ভাশয় উপবৃত্তাকার, ১.৫২.০ মিমি লম্বা, গর্ভদন্ড ৪-৫ মিমি লম্বা, চাকতি রােমশ। অর্জুনের ফুল সুগন্ধি নয়। ফল নাট, ডিম্বাকার বা ডিম্বাকার-দীর্ঘায়ত ৫-পক্ষল, ৩.৫৫.০ x ২.৫-৩.২ সেমি, পক্ষ চর্মবৎ, মসৃণ, কর্তিতা, ১.৫ সেমি প্রশস্ত। ফল শক্ত ও শুষ্ক হয় ও আকারে কামরাঙ্গার মতো ডিম্বাকার এবং ৫ খাঁজযুক্ত। পাকা ফল তামাটে বর্ণের। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসে। [২] ক্রোমােসােম সংখ্যা: 2n = ২৪, ২৬ (Fedorov, 1969).

আরো পড়ুন:  আম বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ এবং দুনিয়ার প্রধান ফল

আবাসস্থল ও চাষাবাদ:

পথপার্শ্ব, উদ্যান, বাংলাের চতুর্দিকে।  বাংলাদেশের সর্বত্র রাস্তার দু’পাশে ও বনাঞ্চলে লাগানো হয়। স্যাঁতস্যাতে উর্বর দোআঁশ মাটি এ গাছ চাষের জন্য উপযুক্ত। গাছে৷ বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসে ফুল ফুটে এবং পৌষ ও ফাল্গুন মাসে ফল পাকে। বীজে বংশ বিস্তার। পৌষ ও ফাল্গুন মাসে বীজ সংগ্রহ করে ব্যাগে লাগিয়ে চারা উত্তোলন করা হয়। পরিপক্ক ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয় তারপর তা ভালভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে সেই বীজ ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বীজ বপনের পূর্বে কমপক্ষে ৪৮ ঘন্টা ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে বীজতলায় বপন করতে হয়। অঙ্কুরিত চারার বয়স ৮ থেকে ৯ মাস হলে তা রোপণ করা ভালো।

বিস্তৃতি: ভারত, শ্রীলংকা ও মালয় পেনিনসুলা। অর্জুন মধ্য ও দক্ষিণ ভারত, উপ-হিমালয় ও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ অর্জুনের আদিনিবাস। বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা যায়, এদের অধিকাংশই রােপণকৃত।

রাসায়নিক উপাদান : ছালে প্রচুর অ্যালকালয়ডীয় ও গ্লাইকোসাইডীয় উপাদান, স্যাপোজেনিন, ফ্ল্যাভোন, ল্যাকটোন, উদ্বায়ী তৈল ও জৈব এসিড বিদ্যমান।[৩]

অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

অর্জুন গাছের বাকল নিম্ন রক্তচাপে ভেষজ ওষুধ রূপে ব্যবহার করা হয়। এটি টনিক, সঙ্কোচক এবং শীতলতা দানকারী তাই আঘাত, অস্থিভঙ্গ, ঘা, রক্তসল্পতা, পৈত্তিক সমস্যা সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যাধি নিরসনে উপকারী । পাতার রস কর্ণশূল নিরাময়কারী। কাঠ খুব শক্ত ও টেকসই, গৃহ, গরুর গাড়ি, নৌকা, স্তম্ভ ইত্যাদি তৈরীর জন্য ব্যবহৃত। কৃষিযন্ত্রপাতি নির্মাণেও এই কাষ্ঠ টেকসই।

অর্জুন গাছের ওষুধি ব্যবহার :

অর্জুন গাছের ছাল, পাতা ও ফল ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গাতেই এদের দেখতে পাওয়া যায়, তবে বন এলাকায় কম দেখা যায়। বিশেষ করে নিচু ও স্যাতসেঁত জায়গায় অর্জুন ভালো জন্মে। বাকল থেকে হৃদরোগের ওষুধ ও পাতার রস আমাশয় রোগেরর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

আরো পড়ুন:  কাঁকুড় বা কাঁকড়ি খাওয়ার উপকারিতা ও ছয়টি ভেষজ গুণাগুণ

 অর্জুন গাছের উপকারিতা ও ভেষজ গুণাগুণ

যাদের বুক ধড়ফড় করে অথচ হাই ব্লাড প্রেসার নেই তারা কাঁচা অর্জুনের ছাল ১০ থেকে ১২ গ্রাম অথবা শুকনা ছাল পাঁচ থেকে ছয় গ্রাম একটু থেঁতো করে হাফ লিটার পানির সাথে দুধ দিয়ে একসঙ্গে সিদ্ধ করে ১২৫ মিলিলিটার হয়ে এলে নামিয়ে নিয়ে ঘেঁকে বিকালের দিকে খেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তবে পেটে যেন বায়ু না হয় সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। লো-ব্লাড প্রেসারের রোগীরাও উপকার পাবেন।

মাঝে মাঝে গলা সুড় সুড় করে হঠাৎ মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে তাদের পাঁচ গ্রাম ছাল রাত্রিতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেকে পানি খাওয়া অনেক কাল আগের চিকিৎসা ব্যবস্থা।[৪]

অন্যান্য তথ্য: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০) অর্জুন প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এরা বর্তমানে বাংলাদেশে সংকটাপন্ন (VU) হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে অর্জুন সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এদেরকে বেশি করে রোপণ প্রয়োজন এবং মাত্রারিক্ত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ জরুরি।। প্রজাতিটির সংকটের কারণ ও ভেষজ ওষুধ তৈরীর জন্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার।[২] 

তথ্যসূত্রঃ

১. দ্বিজেন শর্মা; ফুলগুলি যেন কথা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ মে ১৯৮৮, প্রথম পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০০৩ পৃষ্ঠা, ১২-১৩।

২. এম কে মিয়া  (আগস্ট ২০১০)। “অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস”  আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৭ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৪৮-২৪৯। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

৩. এ বি এম জাওয়ায়ের হোসেন, ওষুধি গাছগাছড়া, গ্রন্থনা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফাল্গুন ১৪১১, পৃষ্ঠা, ১৫।

৪.  শেখ সাদী; উদ্ভিদকোষ, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা, ৩৭-৩৮।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Lalithamba

আরো পড়ুন:  আতা বা নোনা আতা ঔষধি গুণেভরা বাংলাদেশের পরিচিত ফল

Leave a Comment

error: Content is protected !!