এটি আমাদের কাছে মালা নামে পরিচিত। এর সংস্কৃত নাম লিঙ্গিনী, অপস্তম্ভিনী প্রভৃতি ১৬ প্রকার। তাছাড়া এর আরও নাম আছে, যেমন— শিবলিঙ্গী, ভবলিঙ্গী। এ ভিন্ন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে, যেমন হিন্দী ভাষাভাষী অঞ্চলে পঞ্চগুরিয়া, গরগুণারু, শিবলিঙ্গী, দলিঙ্গী, গরুনরু প্রভৃতি এবং বাংলায় মালা, শিবলিঙ্গনী, শিবলিঙ্গী, ভবলিঙ্গী প্রভৃতি নামে পরিচিত। এটির বোটানিক্যাল নাম Bryonopsis laciniosa (Linn) Naud., পূর্বে এর নাম লিঙ্গিনী বীজ Bryonia laciniosa Linn., এটি Cucurbitaceae ফ্যামিলীভুক্ত।
বর্ষজীবী অপরাশ্রয়ী লতা, এই লতাটির পাতা ও তার আকর্ষী আকারে ও গঠনে উচ্ছে গাছের (Momordica charantia) মত। এর এই সাদৃশ্যই ভ্রমের কারণ, তবে আকর্ষীটি (tendril) ২ ভাগে বিভক্ত। পাতা খাঁজ কাটা, হাতের চেটোর মত ৫টি লতিতে বিভক্ত। কাণ্ড (লতাটি) খুবই নরম ও রোমশ। এই লতাটির মূল মাংসল হয় (এটি যে ফ্যামিলীর গাছ তার অধিকাংশ লতাগাছের মূল মাংসলই হয়), এর লতা ও পাতার সন্ধি বা সংযোগস্থল থেকে ফিকে হলদে রঙের ফুল বেরোয়। একসঙ্গে কয়েকটি থাকে। স্ত্রী পুষ্পের বোঁটা থেকে পুং পুষ্পের বোঁটা অপেক্ষাকৃত লম্বা। ফুলের পাপড়ি পাঁচটি। ফল আকারে দেশী কুলের মত হলেও খেলার মার্বেলের মত গোল; ফলের গায়ে সাদা ডোরাকাটা দাগ আছে। বর্ষা ঋতুতে গাছ হয়। বর্ষান্তে ফুল ও ফল হয়। পৌষ-মাঘ মাসের মধ্যেই পেকে যায়। এই ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে, পাকলে লাল রং হয়। প্রতি ফলে ৩টি বীজ থাকে, তার অবস্থানের আধারটির বৈশিষ্ট্য হলো— ঠিক যেন পিচ্ছিল ঘন জলীয় পদার্থ ভরা ক্যাপসুল , তার মধ্যে রক্ষিত। এই বীজের আকার অবিকল ‘পিণাকর্তৃক’ (শিবলিঙ্গ)। তবে এই ফল সুপক্ক হলে সংগ্রহ করা খুবই মুশকিল। কারণ এটি বুলবুলি, দোয়েল এই ধরনের ছোট পাখির খুবই প্রিয় খাদ্য।
এটি প্রধানভাবে জন্মে ভারতের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের ধারে, তবে সচরাচর দেখা যায় না। এই গণের (genus) দু’টি প্রজাতি সমগ্র পৃথিবীতে পাওয়া যায়। একটি প্রজাতি এই ভবলিঙ্গী, এটি ভারতবর্ষ ছাড়াও মরিশাস, আফ্রিকা, মালয়, ফিলিপিনস ও অস্ট্রেলিয়ার গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে পাওয়া যায়। আর একটি প্রজাতি পাওয়া যায় আফ্রিকার উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে, নরফোক দ্বীপে এবং অষ্ট্রেলিয়ায়। ঔষধার্থে ব্যবহার্য অংশ—সমগ্র লতা, ফল ও বীজ।
মালা লতা-র উপকারিতা
১. উদর বায়ুর প্রাবল্যে:— এই বায়ুর প্রাবল্যে নানাপ্রকার উপসর্গ দেখা। যখন-তখন পেটের ভেতর কোঁ কোঁ শব্দ, কখনো বা গুড় গুড় আওয়াজ, খোঁচা দেওয়া ব্যথা, পেটফাঁপা, ঢেকুর, নাভিটা ঘিরে ব্যথা, অরুচি, মাঝে মাঝে প্রস্রাবের বেগ না থাকা। বার বার পিপাসা, গলা-মুখ শুকিয়ে যাওয়া, জল খেলে পেটটা ভারিবোধ হয় অথচ প্রস্রাব পরিষ্কার হতে চায় না, অধোবায়ুর নিঃসরণ হয় না, জাং দুটি ভারি হয়ে যায়, কোমরের ওপরটা সেঁটে ধরে, বসলে ঊরুতে লাগে, মনে হয় বাতের কষ্ট, কখনো বা পিঠের খান থেকে উপরের দিকে চিড়িকমারা ব্যথা, কখনো বা আম সংযুক্ত নরম দাস্ত-এই সবই উদরে বায়ুর আধিক্য হলেই প্রকাশ পায়।
এক্ষেত্রে ভবলিঙ্গী পাতার রস ২ চা-চামচ নিয়ে ছেকে একটু গরম করে ঠাণ্ডা হলে সকালে খালি পেটে একবার খেতে হবে এবং এভাবে বৈকালেও একবার খেতে হবে। নিয়মিত কয়েকদিন খেলে উপসর্গগুলো চলে যাবে। তবে পায়খানাটা পরীক্ষা করে নেওয়া খুবই প্রয়োজন। যদি কোন ক্রিমির উপদ্রব এর কারণ হয়ে থাকে, তখন কিন্তু চিকিৎসার ধারা প্রয়োজনমত বদলাতে হবে।
২. যকৃতের রোগে:— পেটটা বড়, পিপাসা, গায়ের রং তামাটে, হলদেটে কিংবা সিটে, ঘুসঘুসে জ্বর, কখনো বা প্রস্রাবের মাত্রা কমে যায়, অগ্নিমান্দ্য, অরুচি, দাস্ত পরিষ্কার না হওয়া, খিটখিটে মেজাজ—এই যে ক্ষেত্র, এ ক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে মালা লতা পাতার রস মাসখানেক ব্যবহার করলে উপকারটা আপনা থেকেই বুঝতে।
৩. কোষ্ঠবদ্ধতায়: — নানা কারণে হতে পারে, অর্শের দোষ থাকলে, বহুমূত্র হলে, বাতের কষ্টে ভুগলে কোষ্ঠবদ্ধতার শিকার প্রায়ই হতে হয়; এসব ক্ষেত্রে ৮/১০টি মালা লতা পাতা হাল্কা সিদ্ধ করে তেলে সাঁতলে সকালের দিকে জলযোগের পর কয়েকদিন নিয়মিত খেলে দাস্তটা স্বাভাবিকভাবে হতে থাকে।
৪. দুর্বলতায়: — ভবলিঙ্গী পাতা উপরিউক্ত পদ্ধতিতে কিছুদিন খেলে স্বাভাবিকভাবে যে দুর্বলতাটা মাঝে মাঝে দেখা দেয়, সে দুর্বলতাটা ধীরে ধীরে চলে যায়। তবে বিশেষ কোন রোগের জন্য দুর্বলতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে ঐ রোগের চিকিৎসার সঙ্গে এটির ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে কোন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া ভাল।
৫. শুক্রধারণের অসামর্থ্যে :— সামান্য উত্তেজনাতেই স্খলিত হয়, এটা সাধারণতঃ আসে অনিয়মিত জীবন-যাপনের কুফল হিসেবে। এক্ষেত্রে ভবলিঙ্গী বীজচূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্রত্যহ সকালে একবারই আধ কাপ দুধ সহ খেতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে ২ বার খাওয়া যেতে পারে।
CHEMICAL COMPOSITION
Bryonopsis laciniosa (Linn.) Naud.
Whole plant contains: bitter principle, bryonin
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ৯, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ ১৪০৫, পৃষ্ঠা, ৩৬-৩৭।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।