টমাস হবস পুঁজিবাদী মতাদর্শের সমর্থনকারী দার্শনিক

টমাস হবস (ইংরেজি: Thomas Hobbes, ৫ এপ্রিল ১৫৮৮ – ৪ ডিসেম্বর ১৬৭৯ খ্রি.) ছিলেন সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের বস্তুবাদী দার্শনিক। ইংল্যাণ্ডে এই সময়ে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ-বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী বিপ্লবের এই পরিবেশ টমাস হবসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। হবসকে যান্ত্রিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা দানকারী বলা হয়। তার মতে সমগ্র জগৎ হচ্ছে বস্তুর সমষ্টি। মানুষও বস্তুমাত্র। জগৎ ও সমাজ, সর্বক্ষেত্রে একটি মাত্র মৌলিক বিধান কার্যরত রয়েছে। সে বিধান হচ্ছে বস্তুর যান্ত্রিক গতি।

মানুষ কিংবা অপরাপর জন্তু বস্তুর জটিল গ্রন্থনে সৃষ্ট যন্ত্রবিশেষ। কোনো যন্ত্র যেমন বাইরে থেকে দেওয়া শক্তির জোরে চলতে থাকে, মানুষ এবং জন্তুও বাইরের শক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছে। কাজে কাজেই মানুষ বা অপর প্রাণীর মধ্যে দেহের অতিরিক্ত অস্তিত্বসম্পন্ন আত্মা বলে কিছু নেই। বিধাতাকে আত্মার স্রষ্টা বলা হয়; কিন্তু বিধাতা মানুষের কল্পনার সৃষ্টি বৈ কোনো অস্তিত্ব নয়। বস্তু থেকে বস্তুর পার্থক্য কেবল সংখ্যা বা পরিমাণগত । হবস বিধাতাকে কাল্পনিক বলে বস্তুবাদের পরিপোষক হয়েছেন, কিন্তু বস্তুর গতি বস্তুর বাইরে থেকে আসে মনে করে বস্তুকে আর এক কাল্পনিক শক্তির উপর নির্ভরশীল করেছেন। বস্তু যে আপন শক্তিতেই গতিসম্পন্ন, এ ধারণা হবসের ছিল না।

জ্ঞানের প্রশ্নে হবস দেকার্তের জন্মগত ভাব বা ধারণাকে অস্বীকার করেন। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞান তৈরি হয়, অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে বা সহজাত কোনো ভাবের মাধ্যমে নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় শাসনের প্রশ্নে হবস রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের তত্ত্বকে নাকচ করে সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব সমর্থন করেন। তাঁর মতে মানুষের সম্মিলিত চুক্তির ভিত্তিতে সমাজ তৈরি হয়েছে এবং রাজাও চুক্তির ভিত্তিতে রাজ্য শাসন করেন। রাজার হাতে চুক্তির ভিত্তিতে অধিকার সমর্পণ করার পরে নাগরিকের রাজাকে অমান্য করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। একচ্ছত্র রাজতন্ত্র ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠিত হয় না, সমাজ দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং জনসাধারণের জন্য একমাত্র রাজতন্ত্রই সর্বোত্তম শাসন-ব্যবস্থা। কারণ, সমাজের ব্যক্তিমাত্রই স্বভাবগতভাবে স্বার্থপর এবং অপরের অধিকারের প্রতি ক্ষেপহীন। এর ফলে শক্তিশালী শাসক ব্যতীত সমাজে অরাজকতা বিরাজ করারই আশঙ্কা। শাসকের শক্তি সীমাবদ্ধ হলে শাসক সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে।

আরো পড়ুন:  গিওর্গি ভালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ ছিলেন প্রখ্যাত রুশ চিন্তাবিদ এবং মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা

হবস সরকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যুক্তি দিয়েছেন, “মানুষ স্বাভাবিকভাবেই খারাপ হবার কারণে সরকার প্রয়োজনীয় নয়, … বরং মানুষ স্বভাবতই যতটুকু সামাজিক তার চেয়ে অধিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বিধায় সরকার প্রয়োজন।” মূলত একচ্ছত্র শাসন সমর্থন করলেও হবস মনে করতেন, ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার প্রয়োজনে বিদ্রোহের অধিকারী। হবসের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বের বিস্তারিত প্রকাশ ঘটেছে ‘লেভিয়াথান’ নামক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৯৯-২০০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!