টমাস মুর ( ইংরেজি: Thomas More, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৪৭৮ – ৬ জুলাই ১৫৩৫ খ্রি.) কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে টমাস মুরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখয্যোগ্য। মধ্যযুগের প্রতিক্রিয়ার প্রাচীর ভেঙে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদার ভাবের নবজাগরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে টমাস মুর ছিলেন অন্যতম মানবতাবাদী প্রাজ্ঞ পুরুষ। ১৫২৯-১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টমাস মুর ইংল্যাণ্ডের লর্ড চ্যান্সেলার হিসাবে রাষ্ট্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু ধর্ম এবং রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রে রাজা সার্বভৌম শক্তি, একথা টমাস মুর অস্বীকার করাতে তিনি রাজার রোষানলে পতিত হন। গির্জার উপর রাজার অধিকার অস্বীকার করার অপরাধে রাজার হুকুমে টমাস মুরের মাথা কেটে ফেলা হয় ।
টমাস মুরের রচনা ‘ইউটোপিয়া’ সুপরিচিত গ্রন্থ। ‘ইউটোপিয়া’ শব্দের অর্থ কাল্পনিক বা অস্তিত্বহীন। টমাস মুর তার ‘ইউটোপিয়া’তে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ছবি এঁকেছেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত মুরের ‘ইউটোপিয়া’ সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে বিবেচিত হয়েছে। মুর তার সমকালীন ইংল্যাণ্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভিত্তিক সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন। এই সমালোচনার ভিত্তিতে তিনি এমন একটি বিকল্প সমাজের ছবি অঙ্কন করেন, যেখানে জনসাধারণ যৌথভাবে সমস্ত সম্পত্তির মালিক। এই যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে সমষ্টিগত শ্রমের মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সাম্যবাদী নীতির সুবিস্তারিত কল্পনায় টমাস মুরের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়।
টমাস মুরের কাল্পনিক রাষ্ট্রে পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌল একক। উৎপাদনের প্রধান প্রক্রিয়া হচ্ছে হস্তশিল্প। এ রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক। নাগরিকমাত্রই শ্রমের ক্ষেত্রে এবং উৎপন্ন দ্রব্য ভোগের ক্ষেত্রে একে অপরের সমান। এই রাষ্ট্রে গ্রাম ও শহর জীবনের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, দৈহিক শ্রম এবং মানসিক শ্রমের মধ্যেও অধম-উত্তমের বৈরিতা নেই। এ-রাষ্ট্রে মানুষ অনুক্ষণ শ্রমের শেকলে বাধা নয়। মানুষ ছ ঘণ্টা কাজ করে এবং বাকি সময় সে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা এবং চিত্তবৃত্তির চর্চায় অতিবাহিত করে। এ রাষ্ট্রে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির সামগ্রিক উন্নতি বিধান। শিক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্ব এবং বাস্তবের মধ্যে কোনো বিচ্ছিন্নতা থাকবে না। তিনি এই মত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, “আমাদের সময়ের সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধানতম সমস্যাটি হচ্ছে অনেকেই স্কুলে যায়, কিন্তু তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই শিক্ষিত।” তাঁর মতে, তত্ত্ব এবং তথ্যের সমাহারের ভিত্তিতে শিক্ষিত হবে ব্যক্তি।
টমাস মুরের ইউটোপিয়ার এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকেও তার চিন্তাধারার প্রাগ্রসরতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য একথা সত্য টমাস মুর সেদিন অনুধাবন করতে পারেন নি, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উৎপাদনের এই যৌথ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজের বাস্তব জীবনে উৎপাদন কৌশলের অর্থাৎ তার যান্ত্রিক কলা-কৌশলের বিশেষ বিকাশ। টমাস মুর তাঁর পরিকল্পিত সমাজের বাস্তবায়নে সংগ্রামের আবশ্যকতাও উল্লেখ করেন নি। তিনি কল্পনা করতেন যে, সমাজের এই রূপান্তর শান্তিপূর্ণভাবে ঘটে যাবে।
মুর তাঁর দৃঢ়তা ও সাহস বজায় রেখেছিলেন, বিশেষ করে তাঁর ধর্মীয় আজ্ঞা। তাঁর কারাগারে অবস্থানকালীন মর্যাদা, তাঁর বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড তাঁকে বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিকদের মধ্যে আরও মরণোত্তর খ্যাতি অর্জনে সহায়তা করে। তাঁর বন্ধু ইরাসমাস মুরের চরিত্রকে “যে কোনও তুষারের চেয়েও বেশি বিশুদ্ধ” বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তাঁর প্রতিভাকে বর্ণনা করেছিলেন যে এমন প্রতিভা “ইংল্যান্ডে কখনও ছিল না এবং কখনও আবার হবে না।”[২]
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৮৮।
২. Daniel J. Boorstin (1999). The Seekers: The Story of Man’s Continuing Quest to Understand His World. Random House Digital, Inc. p. 154. ISBN 978-0-375-70475-8.
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।