প্রলেতারিয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

৮ই অক্টোবর, ১৯২০

৮ই অক্টোবরের ‘ইজভেস্তিয়া’ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রলেতকুলত[১] কংগ্রেসে কমরেড লুনাচারস্কি[২] যা বলেছেন সেটা কাল তাঁর সঙ্গে আমরা যা স্থির করেছিলাম তার সরাসরি বিপরীত।

অতি দ্রুত একটা খসড়া সিদ্ধান্ত[৩] (প্রলেতকুলত কংগ্রেসের জন্য) রচনা করে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তা পাশ করিয়ে প্রলেতকুলতের এই অধিবেশনেই তা পেশ করতে পারা চাই। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে শিক্ষা জনকমিশারিয়েতে ও প্রলেতকুলত কংগ্রেসে পেশ করতে হবে আজকেই, কেননা কংগ্রেস আজই শেষ হচ্ছে।

খসড়া সিদ্ধান্ত:

১. সোভিয়েত শ্রমিক-কৃষক প্রজাতন্ত্রে যেমন সাধারণভাবে রাজনৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তেমনি বিশেষ করে শিল্পকলার ক্ষেত্রে শিক্ষার সমস্ত ব্যাপারটা প্রলেতারীয় একনায়কত্বের লক্ষ্য সফলভাবে কার্যকরী করার জন্য অর্থাৎ বুর্জোয়ার উৎখাত, শ্রেণিলোপ, মানুষের ওপর মানুষের সর্ববিধ শোষণ অবসানের জন্য প্রলেতারিয়েতের শ্রেণিসংগ্রামের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হওয়া চাই।

২. সেই কারণে প্রলেতারিয়েতকে যেমন তার অগ্রবাহিনী কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে তেমনি সাধারণভাবে সব ধরনের প্রলেতারীয় সংগঠনের সমগ্রতায় জনশিক্ষার সবকিছু, ব্যাপারে সবচেয়ে সক্রিয় ও প্রধানতম ভূমিকা নিতে হবে।

৩. সাম্প্রতিক ইতিহাস এবং বিশেষ করে কমিউনিস্ট ইশতেহারের আবির্ভাবের সময় থেকে বিশ্বের সমস্ত দেশের প্রলেতারিয়েতের অর্ধশতাধিক বছরের বিপ্লবী সংগ্রামের সমগ্র অভিজ্ঞতায় তর্কাতীতরূপে প্রমাণ হয়েছে যে, কেবল মার্কসবাদের বিশ্বধ্যানই হলো বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির সঠিক অভিব্যক্তি।

৪. বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের ভাবাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদ বিশ্ব-ঐতিহাসিক তাৎপর্য অর্জন করেছে এই জন্য যে, মার্কস কখনোই বুর্জোয়া যুগের মূল্যবান সুকৃতিকে বিসর্জন দেয় নি, বরং উলটে, মানব চিন্তা ও সংস্কৃতির দুই সহস্রাধিক বছরের বিকাশের মধ্যে যা কিছ, মূল্যবান ছিলো তাকে আত্মস্থ করেছে ও ঢেলে সেজেছে। এই ভিত্তিতেই ও এই ধারাতেই, সর্ববিধ শোষণের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের শেষ সংগ্রামস্বরপ তার একনায়কত্বের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরো যে কাজ চলবে, তাকেই সত্যকার প্রলেতারীয় সংস্কৃতির বিকাশ বলে স্বীকার করা যায়।

আরো পড়ুন:  প্রকাশিত হয়েছে অনুপ সাদি সম্পাদিত ভি আই লেনিনের প্রবন্ধগ্রন্থ “সাহিত্য প্রসঙ্গে”

৫. এই নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অটলভাবে দাঁড়িয়ে প্রলেতকুলতের সারা রুশ কংগ্রেস নিজেদের একটা বিশেষ সংস্কৃতি বানানো, নিজেদের বিচ্ছিন্ন সংগঠনে আত্মবদ্ধ হওয়া, শিক্ষা জনকমিশারিয়েত ও প্রলেতকুলতের কাজের ক্ষেত্র ভাগাভাগি করা, অথবা শিক্ষা জনকমিশারিয়েতের প্রতিষ্ঠানাদির অভ্যন্তরে প্রলেতকুলতের ‘স্বায়ত্তাধিকার’ স্থাপন ইত্যাদির সবকিছু, প্রচেষ্টাকে তত্ত্বের দিক থেকে ভ্রান্ত এবং ব্যবহারিকভাবে ক্ষতিকারক বলে দৃঢ়ভাবে বর্জন করছে। উল্টে বরং কংগ্রেস এই নির্দেশ দিচ্ছে যে, শিক্ষা জনকমিশারিয়েতের প্রতিষ্ঠান জালের পুরোপুরি সহায়ক সংস্থা হিসাবে নিজেদের গণ্য করতে এবং সোভিয়েত রাজ (বিশেষ করে শিক্ষা জনকমিশারিয়েত) ও রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ পরিচালনাধীনে প্রলেতারীয় একনায়কত্বের যে কর্তব্য তার একাংশ হিসাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করতে প্রলেতকুলতের সমস্ত সংগঠন বিনা শর্তে বাধ্য।

***

কমরেড লুনাচারস্কি বলছেন যে তার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত তাহলে তো আরো জরুরী।[৪]

টিকা:

১. প্রলেতকুলত (সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক সংগঠন) প্রচার করে মার্কসবাদ বিরােধী দৃষ্টিভঙ্গি, অতীতের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে কার্যত অস্বীকার করে, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘ল্যাবরেটরি পদ্ধতিতে’ এক বিশেষ ‘প্রলেতারীয় সংস্কৃতি’ সৃষ্টির চেষ্টা করে। মুখে মার্কসবাদ স্বীকার করলেও প্রলেতকুলতের প্রধান মতপ্রবক্তা বগদানভ আসলে প্রচার করেন আত্মমুখী ভাববাদী মাকপন্থী দর্শন। প্রলেতকুলতের সাংগঠনিক চরিত্র সমরুপ ছিল না। তার নানা সংগঠনে কতৃত্বকারী বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক তরুণদলও যােগ দেয়, যারা অকপটেই সােভিয়েত রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক নির্মাণে সাহায্যদানে সচেষ্ট ছিল। প্রলেতকুলত সংগঠন সবচেয়ে বিকাশ লাভ করে ১৯১৯ সালে। বিশের দশকের গােড়ায় সেগুলির পতন শুর হয়; ১৯৩২ সালে প্রলেতকুলত তার ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দেয়।

২. লুনাচারস্কি, আনাতোলি ভাসিলিয়েভিচ (১৮৭৫-১৯৩৩) – পেশাদার বিপ্লবী, পরে বিখ্যাত সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় কর্মী।

৩. ‘প্রলেতারীয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ খসড়া সিদ্ধান্তটি ভ. ই. লেনিন লিখেছিলেন প্রলেতকুলতের প্রথম সারা-রুশ কংগ্রেস উপলক্ষে, এটি অনুষ্ঠিত হয় মস্কোয় ১৯২০ সালের ৫ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। লেনিনীয় খসড়া সিদ্ধান্তই ছিল রুশ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরাের অধিবেশনে প্রলেতকুলত সম্বন্ধীয় প্রশ্ন আলােচনার বুনিয়াদ। অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালের ৯ ও ১১ অক্টোবরে। প্রলেতকুলতের প্রথম কংগ্রেসের কমিউনিস্ট গ্রুপের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, কেন্দ্রে ও মফস্বলে প্রলেতকুলতপন্থীদের শিক্ষা জনকমিসারিয়েতের প্রতিষ্ঠানসমূহের অধীন করা সম্বন্ধে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হােক। লেনিনের সরাসরি নির্দেশে তৈরী এই সিদ্ধান্তটি প্রলেতকুলতের কংগ্রেসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তবে, কংগ্রেসের পর প্রলেতকুলতের কিছু সংখ্যক নেতা গৃহীত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাঁদের অসম্মতি প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন এবং সংগঠনের সাধারণ সদস্যদের সামনে সিদ্ধান্তের অর্থ এমন বিকৃতাকারে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন, যাতে লােকে মনে করতে পারে যে, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটি যেন শিল্পসাধনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের আত্মাদ্যোগ সীমিত করছে ও প্রলেতকুলত সংগঠন তুলে দিতে চাইছে। প্রলেতকুলত সংগঠনসমূহ প্রসঙ্গে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটির পত্রে এসব মিথ্যাচার ও বাগাড়ম্বরের তীব্র সমালােচনা করা হয় (২৭০ নং ‘প্রাভদা’, ১ ডিসেম্বর, ১৯২০)। পত্রে প্রলেতকুলতপন্থীদের ভ্রান্ত ধারণার বিশদ বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছিল।

আরো পড়ুন:  বড়-রুশীদের জাতীয় গর্ববোধ

৪. লেনিন রচনাটি লেখেন ৮ই অক্টোবর, ১৯২০ তারিখে এবং প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। ‘ক্রাস্নায়া নভ’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায়; ভ. ই. লেনিন রচনাবলী, পঞ্চম রুশ সংস্করণ ৪১শ খণ্ড, পঃ ৩৩৬-৩৩৭। এখানে ভি. আই. লেনিনের বই সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৯৮-১০০ থেকে নেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!