বিরোধাভাস বা বিরোধী সিদ্ধান্ত কাকে বলে?

বিরোধাভাস বা বিরোধী সিদ্ধান্ত-এর সমস্যা (ইংরেজি: Antinomy) হচ্ছে একই যুক্তি থেকে পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব হলে যে সিদ্ধান্তের সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্লেটো, এ্যারিস্টটল, জেনো প্রমুখ প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের রচনায় পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তমূলক দৃষ্টান্তের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গতি এবং সংখ্যার যুক্তিতে যে পরস্পর-বিরোধীতার অবকাশ রয়েছে, দর্শিনিক জেনো তা দৃষ্টান্ত সহযোগে প্রমাণ করেন। গতি সম্পর্কে জেনোর দৃষ্টান্ত বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। জেনো বলেন যে, একটি তীর গতিশীল বলার অর্থ তীরটির একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকা এবং না থাকা। তীরটি যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে তবে উক্ত মুহূর্তে তীরটি গতিশীল নয়। অপরদিকে তীরটি যখন গতিময়, তখন কোনো বিশেষ মুহূর্তে কোনো বিশেষ স্থানে তার অবস্থান ঘটতে পারে না। কারণ অবস্থিতি মানে গতিশূন্যতা। ফলে অবস্থান হলে গতি থাকে না। আবার গতি থাকলে অবস্থান থাকে না। এ-যুক্তিতে দেখা যায় যে, তীরের গতি আছে বা গতিময় তীর-এর সত্যটি আমাদের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

আধুনিক কালে কাণ্টের দর্শনে পরস্পর-বিরোধাভাস বা বিরোধী সিদ্ধান্ত-মূলক সমস্যার বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের পদ্ধতি দ্বারা কাণ্ট তাঁর সত্তার অজ্ঞেয়তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কাণ্টের সত্তার অজ্ঞেয়তার মূল কথা হলো এই যে, মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হচ্ছে বুদ্ধি। কিন্তু ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করতে পারে না। অপরদিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাই সত্তা নয়। চরম সত্তা ইন্দ্রিয় অতিক্রান্ত অস্তিত্ব। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেই চরমসত্তা বা বস্তুর বস্তৃত্ব অনুধাবন করার প্রচেষ্টায় বিশ্বজগৎ সসীম এবং অসীম, যা জটিল তা অ-জটিলের সংযোগ এবং কোনো কিছুই অ-জটিল নয়; বিশ্ব সংসারে মানুষ স্বাধীন; বিশ্বসংসারে মানুষ স্বাধীন নয় এবং বিশ্বের সৃষ্টির মূলে কারণ আছে; বিশ্বের সৃষ্টির মূলে কোনো কারণ নেই এরূপ পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব হয়।

পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উপরোক্ত সমস্যায় যেটি লক্ষ রাখা আবশ্যক সে হচ্ছে এই যে, জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় এরূপ সিদ্ধান্তের উদ্ভব কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। জ্ঞান মানুষের একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। উক্ত প্রক্রিয়ায় এক সময়ে যা সত্য অপর সময়ে তা অসত্য হয়ে যেতে পারে। সত্য এবং অ-সত্যের দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই জ্ঞান অগ্রসর হয়। মানুষ সসীম। আবার সেই সসীম মানুষের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, বিশ্ব অসীম। এখানে আপাতদৃষ্টিতে একটি পরস্পর-বিরোধীতার উদ্ভব ঘটছে সসীম যদি অসীমকে জানতে না পারে তা হলে ‘বিশ্ব যে অসীম’ এ কথা সে জানল কি করে; আবার সে যদি জেনেই থাকে যে, বিশ্ব অসীম তা হলে সে জ্ঞাত বিশ্বকে আর অসীম বলা যায় কেমন করে?

আরো পড়ুন:  এনিসিডেমাস খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতকের গ্রিক দার্শনিক

বস্তুত  মানুষ যা জেনেছে তাই তার জ্ঞাত; যা সে জানে নাই তাই অজ্ঞাত এবং অসীম। কিন্তু যা অসীম তাকে মানুষ জ্ঞাত হয়ে যে অসীম বলছে একথা যেমন সত্য নয়, তেমনি যা জ্ঞাত তাতেই জ্ঞেয় জগতের শেষ নয়; জ্ঞাত-র বাইরে রয়েছে অজ্ঞাত অর্থ্যাৎ অসীম জ্ঞানের জগৎ। সে জগৎও মানুষ ক্রমান্বয়ে জ্ঞাত হবে। এ বিচারে জ্ঞানের জগৎ সসীম এবং অসীম, উভয় কথাই সত্য। এখানে পরস্পর-বিরোধীতার সমস্যা যথার্থ নয়, বাহ্য। দর্শনের ইতিহাসে এই পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত দ্বারা অজ্ঞেয়বাদকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস বিভিন্ন যুগে দেখা গেছে। ভাববাদ যে এরূপ দৃষ্টান্ত দ্বারা চরম সত্তাকে জ্ঞানের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছে, কাণ্টের মধ্যেই তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ মেলে।

তথ্যসূত্র:

১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৬৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!